somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

মানব ইতিহাসে যুদ্ধ

২৭ শে জুন, ২০২৫ রাত ১২:৩২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

ইতিহাসে যুদ্ধ শুধু রক্তপাত নয় — এটা ছিল শাসন প্রতিষ্ঠার মাধ্যম, ধর্ম প্রচারের বাহন, অর্থনৈতিক আধিপত্যের হাতিয়ার। ইউভাল নোয়া হারারি তার বই Sapiens‑এ লিখেছেন, মানুষ যুদ্ধ করে কারণ তারা একসঙ্গে কিছু বিশ্বাস করে—যেমন জাতি, দেবতা, ভূমি বা রাজত্ব। যুদ্ধ, তার ভাষায়, মানব ইতিহাসের অন্যতম ‘নির্মাণশীল ধ্বংস’।

সত্যি বলতে, যুদ্ধ একদিকে যেমন শহর ধ্বংস করেছে, মানুষ মেরেছে, অন্যদিকে সভ্যতা গড়ে তুলেছে, আইন সৃষ্টি করেছে, প্রযুক্তিকে ত্বরান্বিত করেছে।

মানবেতিহাসে প্রাচীনতম যে যুদ্ধের কথা জানা যায় তা সুমেরীয় গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে, খ্রিস্টপূর্ব প্রায় ২,৭০০ সালের দিকে। ওসব যুদ্ধের কারণ ছিল জমির নিয়ন্ত্রণ ও জলাধারের মালিকানা। এই অঞ্চল ছিল ইউফ্রেটিস ও টাইগ্রিস নদীর মোহনায় — ফার্টাইল ক্রেসেন্টের প্রাণকেন্দ্র, বর্তমানে ইরাক।

খ্রিস্টপূর্ব ১২৭৪ সালে (প্রায় ৩৩০০ বছর পূর্বে) মিশরের রামেসিস দ্বিতীয় ও হিত্তি সম্রাট মুউওয়াতাল্লির মধ্যে হয় কাদেশ যুদ্ধ। এটাই ইতিহাসের প্রথম বড় যুদ্ধ যা বিশদভাবে নথিভুক্ত আছে এবং এটির শেষে একটি শান্তিচুক্তি হয়—ইতিহাসের প্রথম লিখিত যুদ্ধ-পরবর্তী সন্ধিচুক্তি। এই যুদ্ধে প্রায় ৫,০০০ সৈন্য নিহত হয় বলে অনুমান করা হয়, কিন্তু সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল যুদ্ধের মাধ্যমে রাষ্ট্রগুলো প্রথমবার কূটনীতি এবং রাজনীতি শিখতে শুরু করে।

রোমান সাম্রাজ্যের সময়, বিশেষত জুলিয়াস সিজারের গৃহযুদ্ধে (৪৯ খ্রিঃপূ), যুদ্ধ হয়ে উঠে এক রাজনৈতিক বিপ্লবের হাতিয়ার। রোমের ক্ষমতা দখলের লড়াইয়ে শুধু হাজার হাজার সৈন্যই মারা যায়নি, রোমান প্রজাতন্ত্র থেকে সাম্রাজ্যের দিকে রূপান্তরের ভিত্তিও স্থাপিত হয়। সিজার গৌল অভিযানে প্রায় ১০ লক্ষ মানুষ নিহত হয়, যেখানে সে বর্তমানের ফ্রান্স, বেলজিয়াম, সুইজারল্যান্ড ও জার্মানির পশ্চিমাঞ্চল দখলের চেষ্টা করে। এই যুদ্ধে জয় তার ব্যক্তিগত প্রতিপত্তি ও ‘আইনের ঊর্ধ্বে’ হয়ে ওঠাকে প্রতিষ্ঠিত করে।

মধ্যযুগে ধর্মযুদ্ধ, বিশেষত ক্রুসেড (১০৯৫–১২৯১)। খ্রিস্টান ইউরোপের রাজারা ও পোপরা দাবি করেন, পবিত্র ভূমি (জেরুজালেম) মুসলিমদের দখলে থাকা ঈশ্বরের বিরুদ্ধে অপরাধ। প্রথম ক্রুসেডেই আনুমানিক ৭০,০০০ মুসলমান ও ইহুদি জেরুজালেমে নিহত হয়।
ইসলামি ইতিহাসেও খিলাফতের যুদ্ধগুলো (৬৩২–৭৫০) অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নবীর (সা.) মৃত্যুর পর থেকে শুরু হয় উত্তরাধিকার নিয়ে দ্বন্দ্ব, পরবর্তীতে করবালার ট্র্যাজেডিতে। ইসলামের প্রথম শতাব্দীতে মুসলিমরা বাইজেন্টাইন ও পারস্য সাম্রাজ্যকে পরাজিত করে বিশাল অঞ্চল জয় করে। বলা হয়, এ সময় শত শত যুদ্ধ হয়েছিল এবং কমপক্ষে কয়েক লাখ মানুষ নিহত হয়।

১৬১৮–১৬৪৮ সাল পর্যন্ত ইউরোপে ঘটে ‘থার্টি ইয়ার্স ওয়ার’—একটি ধর্মীয় ও রাজনৈতিক যুদ্ধ যা ক্যাথলিক ও প্রোটেস্ট্যান্টদের মধ্যে শুরু হলেও পরে ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলোর আধিপত্য বিস্তারের লড়াইয়ে পরিণত হয়। এতে আনুমানিক ৮০ লক্ষ মানুষের মৃত্যু হয়, যা ইউরোপের জনসংখ্যার প্রায় এক-তৃতীয়াংশ। যুদ্ধ শেষে ওয়েস্টফালিয়া চুক্তির মাধ্যমে আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থার ধারণা (sovereign state system) জন্ম নেয়।

আর উনবিংশ ও বিংশ শতাব্দী তো যুদ্ধের শিল্পায়ন দেখেছে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ (১৯১৪–১৯১৮) ছিল আধুনিক অস্ত্র, ট্রেঞ্চ যুদ্ধ, এবং ব্যাপক হতাহতের যুদ্ধ। এতে প্রায় ২ কোটির মতো মানুষ প্রাণ হারায়। যুদ্ধের কারণ ছিল উপনিবেশগত লড়াই, সাম্রাজ্যবাদ, ও জাতীয়তাবাদ। ধারণা করা হয়েছিল, এটিই ‘সব যুদ্ধের শেষ যুদ্ধ’।

কিন্তু মাত্র ২০ বছরের মধ্যেই শুরু হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ (১৯৩৯–১৯৪৫)। হিটলারের নাৎসি জার্মানি, সাম্রাজ্যবাদী জাপান ও ফ্যাসিস্ট ইতালি বিশ্বের মানচিত্র বদলে দিতে চেয়েছিল। শুধু হিটলারের আগ্রাসনে ইউরোপে প্রাণ যায় ৬ কোটির বেশি মানুষের। যুদ্ধের শেষ দিকে যুক্তরাষ্ট্র পারমাণবিক বোমা ব্যবহার করে হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে, তৎক্ষণাৎ ২ লক্ষ মানুষ নিহত হয়।
ইউভাল হারারি বলেন, “মানুষ যুদ্ধ করে কারণ তারা ভবিষ্যতের জন্য আশা করে।” এই ভবিষ্যত হতে পারে—জমি, ধর্ম, জাতি, শ্রেষ্ঠত্ব বা নিরাপত্তা। কিন্তু যুদ্ধের প্রকৃত রূপ বোঝা যায় যখন এক পক্ষের আশা আরেক পক্ষের জন্য হয়ে ওঠে ভয়ংকর।

পরবর্তীতে, যদিও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বিশ্বের বড় শক্তিগুলোর মধ্যে সরাসরি যুদ্ধ হয়নি, তবুও ছায়া যুদ্ধ এবং তথ্য যুদ্ধ নতুন এক যুদ্ধ বাস্তবতা তৈরি করেছে। ভিয়েতনাম, আফগানিস্তান, ইরাক, সিরিয়া, ইয়েমেন—সবগুলো যুদ্ধই ছিল শক্তিধরদের রাজনৈতিক কৌশলের অংশ।

আজকের দিনে যুদ্ধ হয় হয়তো মারণাস্ত্র নিয়ে নয়, কিন্তু সাইবার আক্রমণ, তথ্যের বিকৃতি, অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা—সব মিলিয়ে যুদ্ধ এখন এক বহুমাত্রিক বাস্তবতা।

যুদ্ধ ইতিহাসের অমোঘ এক সঙ্গী। এটা না চাইলেও আসে, কারণ যুদ্ধ মানুষের ভয়, আশা, এবং শক্তির প্রতিচ্ছবি। বর্তমানে পৃথিবীর নানা প্রান্তে কয়েকটি দেশ যুদ্ধে লিপ্ত থাকলেও, গত পাঁচ হাজার বছরের ইতিহাসে মানবজাতি সবচেয়ে কম যুদ্ধের মধ্যে আছে এই মুহুর্তে। সুতরাং ভয় বা নৈরাশ্যের কিছু নেই, পিপীলিকার মত হরে দরে মানুষ মরেই এই সভ্যতা গড়েছে।

১৯ জুন ২০২৫
জাহিদ কবীর হিমন
বার্লিন থেকে
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে জুন, ২০২৫ রাত ১২:৩২
৪টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

জামাত কি দেশটাকে আবার পূর্ব পাকিস্তান বানাতে চায়? পারবে?

লিখেছেন ঋণাত্মক শূণ্য, ১৭ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৭:২৮

অন্য যে কোন সময়ে জামাতকে নিয়ে মানুষ যতটা চিন্তিত ছিলো, বর্তমানে তার থেকে অনেক বেশী চিন্তিত বলেই মনে করি।



১৯৭১ এ জামাতের যে অবস্থান, তা নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের অস্তিত্বের বিরুদ্ধে... ...বাকিটুকু পড়ুন

১৯৭১ সালে পাক ভারত যুদ্ধে ভারত বিজয়ী!

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ১৭ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৯


দীর্ঘ ২৫ বছরের নানা লাঞ্ছনা গঞ্জনা বঞ্চনা সহ্য করে যখন পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বীর বাঙালী অস্ত্র হাতে তুলে নিয়ে বীরবিক্রমে যুদ্ধ করে দেশ প্রায় স্বাধীন করে ফেলবে এমন সময় বাংলাদেশী ভারতীয়... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইন্দিরা গান্ধীর চোখে মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশ-ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক: ওরিয়ানা ফলাচির সাক্ষাৎকার

লিখেছেন শ্রাবণধারা, ১৭ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১১:৫৫


১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ইতালীয় সাংবাদিক ওরিয়ানা ফলাচি ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সাক্ষাৎকার নেন। এই সাক্ষাৎকারে মুক্তিযুদ্ধ, শরনার্থী সমস্যা, ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক, আমেরিকার সাম্রাজ্যবাদী পররাষ্ট্রনীতি এবং পাকিস্তানে তাদের সামরিক... ...বাকিটুকু পড়ুন

=যাচ্ছি হেঁটে, সঙ্গে যাবি?=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ১৭ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সন্ধ্যা ৭:০৬


যাচ্ছি হেঁটে দূরের বনে
তুই কি আমার সঙ্গি হবি?
পাশাপাশি হেঁটে কি তুই
দুঃখ সুখের কথা ক'বি?

যাচ্ছি একা অন্য কোথাও,
যেখানটাতে সবুজ আলো
এই শহরে পেরেশানি
আর লাগে না আমার ভালো!

যাবি কি তুই সঙ্গে আমার
যেথায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

আগামী নির্বাচন কি জাতিকে সাহায্য করবে, নাকি আরো বিপদের দিকে ঠেলে দিবে?

লিখেছেন জেন একাত্তর, ১৭ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৮:১২



আগামী নির্বচন জাতিকে আরো কমপ্লেক্স সমস্যার মাঝে ঠেলে দিবে; জাতির সমস্যাগুলো কঠিন থেকে কঠিনতর হবে। এই নির্বাচনটা মুলত করা হচ্ছে আমেরিকান দুতাবাসের প্রয়োজনে, আমাদের দেশের কি হবে, সেটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

×