শহরে তো এখন ঘাসই উধাও। আবার কাশ? কাশফুল এখন শুধু কাব্যিক শব্দ। গ্রাম থেকেও কাশবন বিলুপ্ত হচ্ছে। নদীর তীরগুলো সর্বত্র বেদখল হয়ে যাচ্ছে। কলকারখানা দোকানপাট বাণিজ্যকেন্দ্রের দ্রুত বিস্তার নদীতীরের দৃশ্যপট প্রতিদিন বদলে দিচ্ছে। নদীতে জেগে-ওঠা চরগুলো শরতে কাশবনে ছেয়ে যেতো। মাইলের পর মাইল জুড়ে সাদা রেশমের সমুদ্রে শারদীয় হালকা হাওয়া ঢেউ তুলে যেতো। রেশমি পাখনা মেলা সাদা সাদা কাশফুলে ছেয়ে যেতো নদীর তীরভূমি। মনে হতো আকাশ থেকে পরীর দল নেমে এসেছে। আমরা ছোটো বেলায় দুলে দুলে কবিতা মুখস্থ করতাম Ñ ‘নদী তীরে কাশফুল, শ্বেত শাড়ি পরা পরীদল বলে হয় যেন মনে ভুল।’ আর শরতে নৌকা চড়ে যখন কোথাও যেতাম তখন নদীর পাড়ে লাইন ধরে দাঁড়িয়ে থাকা অজস্র ফুলে ছাওয়া কাশবন দেখে মনে হতো সাদা পরী ছাড়া আসলেই এদের আর কোনো নামে ডাকা যায় না।
চরাঞ্চলে বড় গাছ বলতে গেলে থাকে না। খোলা আকাশের প্রেক্ষাপটে কাশফুলের ফিনফিনে ওড়না ঢাকা রহস্যময়ী শরতরানীর রূপ এখন তো গবেষণার বিষয়। চর এখন দখলদারদের কবলে পড়ে হয় বালু উত্তোলনের ড্রেজারের ঘাই খেতে থাকে অথবা ইটভাঁটির আগুনে পুড়তে থাকে।
শহরে তো ‘কাশ’ আর ‘আকাশ’ দুটোই ‘নিকাশ’ হয়ে গিয়েছে। শহরের বাইরের দিকে কিছুদিন আগেও কোথাও কোথাও কিছুটা খোলা জায়গা ছিল। কিন্তু উপশহর প্রকল্প, হাউজিং প্রকল্প, শিল্পকারখানা, এসব এসে ঝড়ের গতিতে দখল করে নিচ্ছে খোলা জায়গা, ধানী জমি সব। রবিবাবু যদি বেঁচে থাকতেন তাহলে হয়তো টের পেতেন যে, ‘আমরা এনেছি কাশের গুচ্ছ আমরা এনেছি শেফালি মালা, নবীন ধানের মঞ্জরি দিয়ে সাজিয়ে এনেছি ডালা’ অথবা “আজি ধানের ক্ষেতে রৌদ্রছায়ায় লুকোচুরি খেলা, নীল আকাশে কে ভাসালে সাদা মেঘের ভেলা।”Ñ তাঁর এসব লেখা আর ধোপে টিকবে না। ধানের খেত কোথায়? ধানী জমিও নেই, ধান চাষও উঠে যাচ্ছে। ঘরের ভেতর খড় বিছিয়ে ব্যাঙের ছাতা গজানো শিখে গেছে বাংলার ধানচাষী। বাড়ির পালানে গর্ত খুড়ে নীল পলিথিন বিছিয়ে তাতে পানি ঢেলে ছোট্ট ডোবা তৈরী হচ্ছে। আর পাটচাষী কাঁচা পাটকে চড়চড় করে চিকিয়ে নিয়ে সেই ডোবায় রেখে পচিয়ে নিতে শিখে গেছে। ইঁটের চৌবাচ্চায় পোনা ছেড়ে মাছ বানিয়ে নিচ্ছে নদীখালবিলের প্রাকৃতিক জেলে। মানুষ এখন শিখে নিচ্ছে কী করে অল্প জমিতে অল্প পানিতে অল্প আকাশে অল্প রোদ্দুরে চাষবাস করতে হয়।
বলছিলাম শহরের আকাশের কথা। আকাশ, আহা শহরের আকাশ! তোর জন্য রোজই কাঁদি রে জাদু! নগরবাসী আমরা কী অসহায়।
আমাদের দৃষ্টিকে প্রতিদিন লুণ্ঠন করা হচ্ছে।
অবারিত দৃষ্টির অধিকার কেড়ে নেয়া হচ্ছে।
আকাশ দেখার সাধ ঘুচিয়ে দেয়া হচ্ছে।
প্রতিদিন নগরের দিগন্তকে বিদ্ধ করে ধাঁ ধাঁ করে উঠে যাচ্ছে অসংখ্য দালান।
আকাশ জুড়ে শুনিনু ওই বাজে তোমারি নাম! কে বলে! আকাশ জুড়ে দেখিনু ওই রাজে ধনপতিদের নাম!
তারপরও ফাঁকফোকরে যেটুকু আকাশ উঁকি মারে সেটুকু চলে যাচ্ছে পণ্যবাণিজ্যের দখলে। বিশাল বিশাল বিলবোর্ডে ঢাকা পড়ে যাচ্ছে শহরের দিগন্ত। সূর্যের আলো যদিও এখনও পাওয়া যাচ্ছে তবে চাঁদ আটকা পড়ে গেছে সেই ঢাকনা তোলা আকাশ আর আর বেড়া দেওয়া দিগন্তের ফাঁদে।
দু বছর আগেও আমার দোতলার ঘরের ভেতরে বসেই দেখা যেত পূর্ণিমা চাঁদ। একদিন দেখা গেল সামনে টপাটপ করে লাফিয়ে উঠে যাচ্ছে বহুতল। তার পিলারের রডের খাঁচার ফাঁকে প্যাঁচা মুখ করে এক পূর্ণিমা আমায় বললো, শেষ দেখা দেখে নাও। তাড়তাড়ি মোবাইল ফোনের ক্যামেরায় সেই পাংশু পূর্ণিমার ছবি তুলে রাখলাম। পরের মাসে আর দেখা গেল না বেচারা চন্দ্রকে। আগে ‘চন্দ্রচূড় পাহাড়’ বলে একটা কথা ছিল। পাহাড়ের চুড়ায় পূর্ণিমা চাঁদের অপার্থিব সেই দৃশ্য প্রকৃতিতে যে মোহময়ী সৌন্দর্য সৃষ্টি করতো তা কি মনে রেখেছে নগরের চাঁদ! তা হলে তো তার আত্মহত্যা করার কথা! কয়েকদিন আগে আমার শারদীয় পূুর্ণিমা দেখার বড়ই পিয়াস হলো। আমরা কয়েকজন বন্ধু উঠে বসলাম সাত তলা এক ভবনের ছাদের ওপর। এ ছাড়া তো আকাশ দেখার উপায় নেই! ছাদের ওপর গিয়ে বেশ খানিকটা খোলা আকাশ পাওয়া গেল। আকাশে সত্যিই রুপোর চাকতির মতো গোল চাঁদ!
প্রথমে সেই চাঁদ দেখে আমরা তো আনন্দে আত্মহারা। গলা ছেড়ে গান ধরলাম ‘চাঁদের হাসি বাঁধ ভেঙেছে উছলে পড়ে আলো...।’ কিন্তু গানে আমাদের মন কেন যেন ভরে উঠছে না। কোথায় কী যেন একটা গলতি রয়ে যাচ্ছে! আসমানের রুপোর চাকতিখানায় যেন ছাৎলা পড়েছে। অথচ আলোটা দেখ, কেমন কচকচ করছে! পূর্ণিমা চাঁদের সেই মায়াবী নীলাভ জোছনা তো এটা নয়! তবে কি শহরের জোছনাও দুনম্বরী! একটু বাদেই এ রহস্য উদঘাটন হয়ে গেল। হঠাৎ করে চাঁদখানা বড়সড় একটা মেঘের আড়ালে ঢাকা পড়ে গেল। কিন্তু জোছনা রয়েই গেল! সেই কচকচে আলো আমাদের চারপাশেÑ যাকে আমরা চাঁদের আলো ভেবে পান করছিলাম! চাঁদ-এর অন্তর্ধানের পরেও সে আলো দিব্যি রয়ে গেছে! এ আলো আসলে আমাদের চারপাশের কয়েকটি বহুতল ভবনের বিভিন্ন ফ্লোরে জ্বালিয়ে রাখা উজ্জ্বল বিজলি বাতি থেকে আসছে। এক একটি ভবনে ত্রিশচল্লিশটি করে ফ্লাট। এগুলোর সবটাতেই আলো জ্বলছে। আকাশে রীতিমত ইলেকট্রিক আলোর দেয়ালি জ্বলছে! কাজেই শরতের চাঁদের আলো শহুরে ফ্লাড লাইটের দাপটের কাছে মার খেয়েছে। আলাওলের পদ্মাবতী কাব্যে পড়েছি অপরূপ সুন্দরী পদ্মাবতীর চোখের সৌন্দর্য দেখে নাকি ‘কাননে কুরঙ্গ জলে সফরী লুকিত’ হয়েছিল, আর আমাদের শারদচন্দ্র তার পূর্ণ তিথিতে আকাশ ভরা বিজলিবাতির আলো দেখে লজ্জায় মেঘের আড়ালে মুখ লুকিয়েছে।
এখন লোকে লাল চাঁদ, নীল চাঁদ, কাছের চাঁদ, দূরের চাঁদ দেখার জন্য টেলিস্কোপে চোখ পাতে। এ যেন ডিসেকশন টেবিলে রেখে চাঁদকে উল্টেপাল্টে দেখা!
রাতের আকাশ থেকে চাঁদ তো পালিয়ে বাঁচলো, কিন্তু দিনের আকাশে সাদা মেঘের ভেলার কী হলো? শরতের আকাশ! সেই ঝকঝকে ফটফটে নীল আকাশ! রোদ্দুর যেখানে নীল কাচের মতো ঝিলমিল করতে থাকে, আর তার ওপর দিয়ে সাদা পাল তোলা নায়ের বহরের মতো ভেসে যায় মেঘমালা। এ হলো শরতের সাদা মেঘের ভেলা। কখনো মনে হয় আকাশের বুকে কাপাশ তুলোর প্রাসাদ গড়ে চলছেন কোনো শিল্পী। এই আশ্চর্য মেঘমালার শ্বেতপ্রাসাদ আমরা কোথায় কেমন করে দেখবো! নিত্যনতুন গগনচুম্বি অট্টালিকার ভিড়ে মেঘের প্রাসাদের কোনাকুনচি হয় তো দেখা যায় কিন্তু তা মানেুষের মনে শরতের অমল ধবল আবহের কোনো সংকেত সৃষ্টি করে না। সাদা মেঘের ভেলা খাবি খেতে খেতে ভেসে যায় উঁচু উঁচু বিলবোর্ডের আড়াল দিয়ে, অথবা হাইরাইজ বিল্ডিং-এর মাথায় ধাক্কা খেয়ে পলকা মেঘের ভেলাগুলো ছত্রভঙ্গ হয়ে ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু যাঁরা গ্রামে অথবা একটু খোলামেলা জায়গার বাসিন্দা, তারা জানেন, এই শরতে নারকেল গাছের ফাঁকে ফাঁকে, বড় বড় গাছের শাখাপ্রশাখার বাহারি কারচুপির মধ্যে অথবা মাঠপ্রান্তরের ওপরে মুক্ত আকাশে নানান আকারে নানান ছন্দে ভেসে চলা সাদা মেঘের শোভা কী অদ্ভুত সুন্দর!
চলবে,,,