লাবণি তাহলে গল্পের মুডে আছে! আমি মনে মনে একটু চাঙ্গা হই। অসুখের টেনশন আর টাকা পয়সার দুঃশ্চিন্তায় আমার মাথা খারাপ হওয়ার জোগাড়। লাবণির তো নিশ্চয়ই আরও খারাপ অবস্থা। তো হোক না গল্প। এক মিনিটও যদি আমরা দুজন কোনো গল্পে মেতে হো হো করে হেসে উঠতে পারি তা কি কম? জীবনের একটা অনিন্দ্য মুহূর্তের দাম অনেকগুলো ম্রিয়মাণ সময়ের চেয়ে বেশি। লাবণি গল্প বলতে শুরু করে।
ঐ যে, হোজ্জার বাড়ি রাতে চোর ঢুকে সব জিনিসপত্র একটা চাদরে রেখে গাটরি বাঁধলো। হোজ্জা চুপি চুপি চেয়ে সব দেখলো। তারপর চোর যখন গাঁটরি মাথায় বাইরে বেরিয়ে এলো তখন হোজ্জাও বালিশ বগলে চেপে চোরের পিছু পিছু চোরের বাড়ি এসে হাজির। চোর তো অবাক। হোজ্জা বলে, আমার সব জিনিসপত্রই তো তোমার বাড়িতে নিয়ে এলে, তো আমি আর বাকি থাকি কেন!
এ গল্পের পরে আর লাবণির থালাবাটি কেনার যুক্তি ব্যাখ্যা করার দরকার পড়ে না। হাসতে হাসতে লাবণি বলে, সরোজিনী মাসীর পুজার থালায় আর ভাত খাওয়া লাগবে না। আর কী গ্লাস! মনে হয় ফ্যাক্টরি থেকে বের হওয়ার পর ওদের আর ওজু গোসল হয়নি। আমরা দুজন খুব হাসি। আমাদের হাসিতে ঠাকুরপুকুরের ‘ক্ষণিকের অতিথি’ নামের বারোয়ারি গেস্ট হাউসের এই ছোট ঘরটি কিছুক্ষণের জন্য জলতরঙ্গ ধ্বনিতে দুলতে থাকে।
ঢাকা থেকে আসার সময় একটা ছোট ইলেকট্রিক কেটলি নিয়ে এসেছিলাম। লাবণি সেটা অন করেছে। পানিটা ফুটতে ফুটতে বাথরুমে ঢুকে ঘাড়ে মুখে পানি দিয়ে ফ্রেশ হয়ে এলো। এখন লাবণির মুখে সতেজ তারুণ্য খেলা করতে থাকে। ধুমায়িত চায়ের কাপ হাতে নিয়ে আমরা গেস্ট হাউসের বারান্দায় এসে বসি। এখানে কয়েকটা মলিন সোফা আর চেয়ার পাতা একটা বহু ব্যবহৃত লবি আছে। তবে এখানে বসার পর বিবর্ণ বারান্দার কথা আর মনে থাকে না। কারণ বাইরেটা গাছপালা ছাওয়া সবুজ বনবীথি। গাছপালার তলা দিয়ে চলে গেছে লাল সুরকি ঢালা রাস্তা। পাখপাখালির ডাক শোনা যায়। কেমন একটা নির্জনতা। গাছপালার ফাঁক দিয়ে দেখা যায় বড় বড় ভবনের মাথা। বিশ মিনিটের হাঁটা পথ পেরুলেই ঠাকুরপুকুর ক্যান্সার হাসপাতালের বিশাল ক্যাম্পাস চোখে পড়বে।
লাবণি চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে কাপটি একটু ঘুরিয়ে দেখে।
ঢাকার মতো ট্রান্সপারেন্ট প্লেন ডিজাইনের কাপ খুঁজছিলাম। কিন্তু পেলাম না। এটা কেমন বেঢপ ডিজাইন। তাই না? থাক গে। কয়দিনেরই বা সংসার! বারো তারিখে অপারেশন হলে মাঝে আর পাঁচটা দিন।
চায়ে চুমুক দিতে দিতে আপনমনে কথা বলে লাবণি।
হঠাৎ আমার গায়ে হাত ছুঁইয়ে একটা আলতো ঠেলা দিয়ে বলে, আচ্ছা অপারেশনের পর আর কয়দিন থাকতে হবে, ডক্টর কিছু বলেছে? সিনথির জন্য বুকটা কেমন কাঁপে গো। রেহানা কি দেখে রাখতে পারবে ঠিকমতো!
লাবণি বুকে হাত রেখে কথা বলে। ছয় বছরের মেয়েটিকে তার বয়স্ক নানী আর কলেজ পড়–য়া খালার তত্ত্বাবধানে রেখে আমরা এক সপ্তাহ হলো কোলকাতা এসেছি।
আমি লাবণির মমতাকাতর মুখটির দিকে তাকিয়ে থাকি। আচমকা একটু কুঁচকে ওঠে ওর ভুরু। দু চোখ চেপে বন্ধ করে নাক টেনে জোরে জোরে দম নেয়।
কী হলো? ব্যথা করছে নাকি খুব?
তখনও লাবণির বুকে হাত। আমার কথায় আলতো করে স্তনে চাপ দেয় লাবণি।
নাহ্, তেমন ব্যথা না। সহনীয়। কত ওষুধ খাচ্ছি! ব্যথা আর কী থাকবে। দুদিন বাদে তো থাকবেই না....
লাবণি নিজের স্তনের ওপর মমতায় হাত বোলাতে থাকে।
ঢাকায় ফোন করবো নাকি এখন? কথা বলবে সিনথির সাথে?
আমি লাবণির মনোযোগ সরিয়ে আনতে চাই। আমি চাই, লাবণি তার সুডৌল স্তন দুটি থেকে আদুরে হাত দুটো সরিয়ে নিক। বছরখানেক আগে প্রথম যেদিন লাবণি তার বাম বগলের নিচে একটা ব্রেস্ট লাম্প-এর অস্তিত্ব খুঁজে পেলো সেদিন থেকে লাবণির হাত বুকের ওপর। বারবার নানা দিক থেকে আঙুলে টিপে টিপে পরখ করে। আমাকে দিয়ে বহুবার চামড়ার তলায় পিছলে যাওয়া জলপাইয়ের বিচির মতো পিণ্ডটির অস্তিত্ব অনুভব করতে দিয়েছে। ডাক্তারের কাছে গিয়েছি আমরা। মেমোগ্রাফিতে প্রথমে কোনো খারাপ রিপোর্ট এলো না।
ডক্টর বললেন, বিবাহিত মেয়েদের ব্রেস্ট-এ এমন লাম্প হার্মলেসও হতে পারে। অনেক সময় আপনাআপনি মিলিয়ে যায়। নিজে নিজে পরীক্ষা করার কিছু পদ্ধতি শিখিয়ে দিলেন লাবণিকে, যাতে বুঝতে পারা যায় কোনো ম্যালিগন্যান্ট গ্রোথ হচ্ছে কি না। তার পরেও একটা বায়োপসি করিয়ে নিতে বললেন ডক্টর। সবাই পরামর্শ দিলেন দেরী না করিয়ে বায়োপসি করাতে। লাবণিও ওর বান্ধবী ডাক্তার সোহেলার সাথে যোগাযোগ করতে লাগলো। তবে তার পরেও নানা ঝামলোয় বেশ কয়েকমাস পেরিয়ে গেল। একদিন রাত্তিরে লাবণি বিছানায় যাওয়ার আগে আমাকে ওর সামনে দাঁড় করায়। মাথার ওপর দিয়ে টেনে বের করে আনে রাত পোশাক। আমাকে টেনে নিয়ে যায় একেবারে টিউব লাইটের কাছাকাছি জায়গায়। উজ্জ্বল আলোয় লাবণির জমাট মাখন কেটে বের করে আনা শরীরটিকে আমি যেন ঘিয়ের মতো গলে যেতে দেখি। ওর সুডৌল গম্বুজের মতো বুক জোড়া মিথুনপিপাসু কবুতরের মতো পালক ফুলিয়ে থরথর করে কাঁপতে থাকে। আমার শরীরের ভেতর পাগলা ঘোড়ার দাপাপাপি। ওকে জড়িয়ে ধরি আমি। খোলা স্তনে ঠোঁটের আলতো ছোঁয়া দিয়ে কামার্ত করে তুলতে চাই লাবণিকে। কিন্তু লাবণি আমাকে ধাক্কা দিয়ে ঠেলে দেয়। ওর চোখে কেমন ভুতুড়ে দৃষ্টি। ও বাঁ দিকের স্তনটি আলগা করে ধরে আমার দিকে এগিয়ে আনে। এ ভঙ্গিটি আমাদের উভয়েরই খুব পরিচিত। এই মুহূর্তে আমারও এগিয়ে আনার কথা আগুন তপ্ত ঠোঁট। লাবণির এগিয়ে ধরা চাঁদের বাটি থেকে আমার জিভের মধ্যে গড়িয়ে পড়ার কথা পদ্মমধু।
কিন্তু লাবণির চোখে অচেনা আলো আমাকে থমকে দেয়। ও তখন ভুতুড়ে গলায় ফ্যাঁস ফ্যাঁস করে বলেÑ সরে যাও। সাবধান। এই দেখো, আমার নিপল রিট্রাকশন হচ্ছে।
আমার জিজ্ঞাসু চোখের সামনে লাবণি ওর বাম স্তনের বোঁটাটি দু আঙুলে চেপে ধরে একটু একটু মুচড়ে দিতে থাকে। দেখেছো, কুঁচকে যাচ্ছে নিপল! সোহেলা বলেছে, নিপল রিট্রাকশন ক্যান্সার-এর একটা সাইন। আরও ছড়িয়ে পড়লে ধীরে ধীরে চামড়া কুঁচকে ভিতরে ঢুকে যেতে পারে। সেটাকে বলে পিয়া ডু অরেঞ্জ অ্যাপেয়ারেন্স। সোহেলা তাড়াতাড়ি ডাক্তার দেখাতে বলেছে। বায়োপসি করাতে হবে।
লাবণির চোখ থেকে ঝরঝর করে জল পড়তে থাকে ওর খোলা বুকের ওপর। জলের ছোঁয়া পেয়ে ডানদিকের স্তনের ওপর ছোট্ট গোলাপ কুঁড়ির মতো লালচে বৃন্তটি ঘুমঘুম চোখে তাকিয়ে থাকে। সেটি মসৃণ। কোমল। বাম দিকের স্তনবৃন্তটি চারপাশের লালচে বৃত্তসহ দুমড়ানো কাগজের গুলির মতো কুঁচকে আছে। ওটার চোখে যেন ঘুম নেই।
তার পরের ঘটনাগুলো খুব তাড়াতাড়ি ঘটে। আরও ডাক্তার। আরও মেমোগ্রাফি। আলট্রাসোনো। এফ-এন-এ-সি। আরও বায়োপসি। ডক্টর বলেন, মেটাসটেসিস হয়ে পড়েছে ক্যানসার। শরীরের অন্য প্রান্তকে রক্ষা করতে চাইলে, হার লেফট সাইডেড ম্যাসটেকটমি শুড বি ডান ইমিডিয়েটলি।
মানসিকভাবে খুব ভেঙে পড়েছিলো লাবণি। চল্লিশটি বসন্ত এখনও পেরুতে পারেনি লাবণি। আটত্রিশ ঋতুপরিক্রমায় রঙমাতাল দেহটিকে প্রতিদিন কতরকম পরিচর্যায় সুন্দর আর অনন্য করে তোলে ও। সেই প্রিয় দেহটি থেকে একটা প্রিয় অঙ্গ ছেঁটে ফেলতে হবে! ডাক্তার প্রবোধ দেন, সারা বিশ্বে হাজার হাজার নারী এই অপারেশন করাচ্ছেন। প্যাড লাগানো ভালো বিদেশী ব্রা পাওয়া যায়। পরলে বাইরে থেকে দৈহিক সৌন্দর্যের কোনো ঘাটতি মনে হবে না। একদিকের স্তন সুস্থ থাকলে পরবর্তী সন্তানের জন্যও কোনো অসুবিধা হবে না।
তোমার অসুবিধা হবে না? একান্তে আমাকে এ প্রশ্ন করেছে লাবণি।
আমি লাবণিকে মানবিক বোধসম্পন্ন একজন দায়িত্বশীল স্বামীর মতোই সান্ত্বনা আর আশ্বাস যোগাতে চেয়েছি। লাবণির বেঁচে থাকাটাই আমার আর সিনথিয়ার জন্য জরুরি। তা যেভাবেই হোক। তাকে ছাড়া আমাদের পৃথিবী অচল।
আচ্ছা অপারেশনের পর কতদিন এখানে থাকতে হবে?...।
চলবে...