চোখের কোণ দিয়ে আস্তে করে তাকালাম। দেখি আম্মু ঘুমুচ্ছে। কি যে ক্লান্ত আম্মু! গায়ের চাদরটা আস্তে করে টেনে গলা পর্যন্ত ঢেকে দিলাম আম্মুর। হাল্কা করে বিছানা থেকে পা টিপে টিপে উঠলাম। জানালার পর্দা সরিয়ে বাইরে তাকাতেই দেখি ঝুরঝুর করে বরফ পড়ছে। সাদা আর সাদায় ওই বিরাট চাঁদটার আলো কেমন গলে গলে পড়ছে। নানুর মুখটা ভেসে উঠলো, গলার কাছে কি যেন একটা দলা পাকাচ্ছে, চোখ জ্বালা করছে। আচ্ছা, এই শহরে কি আমার কান্না ঝরে পড়লেই ফ্রিজের বরফের মতো গালের উপর জমে যাবে? সাথে সাথে চোখ মুছলাম। আমার এমনিতেই অনেক ঠান্ডা লাগছে। গালে বরফের আস্তর পড়লে আরও ঠান্ডা লাগবে, আমি হাঁচি দেব, আম্মু উঠে যাবে। আমার পিংক নাইটড্রেসের কলার টানতে টানতে নিয়ে একগাদা কম্বল দিয়ে আমাকে মুড়ে দেবে। বকবক্ করতে থাকবে অনেক....আম্মুটার আসলে অনেক কষ্ট। নিজের ডিউটি, আমাকে নিয়ে হসপিটালে দৌড়াদৌড়ি, আমার রুটিন ওষুধ খাওয়া, খাবার খাওয়া, পড়াশোনা করানো এসব তো একার হাতে আম্মুকেই করতে হয়। আম্মু আসলে অনেক ভালো। কিন্তু আমি কি করবো? আমি তো আম্মুকে এই কষ্ট দিতে চাই না।
মনে পড়ে গেল,যেদিন প্রথম আম্মু জানতে পারলো আমার অনেক বড় একটা অসুখ, সে কি কান্না আম্মুর! আমি কিন্তু ভয় পাইনি, মনে হয়েছে, এখন আর আম্মু আমাকে ছেড়ে বিদেশ চলে যাবে না, আমি অনেক খুশী হয়েছিলাম। কিন্তু আম্মু কোন সময় দেয়নি কাউকে। নানু-খালামণি-মামা-আব্বু সবাইকে ফেলে আমাকে প্লেনে করে সিঙ্গাপুর নিয়ে গেছে। ওখান থেকে দিন পনেরো পর ইংল্যান্ড। আমি আর খালামণির সাথে ঘুরতে বেরুতে পারিনি। নানার সাথে স্কুলে যেতে পারিনি। আমার বেস্ট ফ্রেন্ড মারিয়ামের সাথে খেলতে পারিনি। নানুর বুকে মুখ গুঁজে ঘুমাতে পারিনি। শুধু হসপিটালের সাদা চাদর, নার্সদের ভাবলেশহীন দায়িত্ব, সাদা চামড়া ডাক্তারদের শক্ত মুখ আর আম্মুর ক্ষয়ে যাওয়া চোখে আদরের হাসি দেখতে দেখতে আমার রাত ভোর হযে দিন কেটে দিন এসেছে...
এখন আমি স্বাভাবিকতায় ফিরতে চাই। এই অন্ধকার অথচ পরিচ্ছন্ন প্রাণহীন অথচ বিত্তশালী শহরে আমি আর থাকতে চাই না। নানুর কোলে ঝাঁপিয়ে পড়তে চাই, খালূর সাথে খেলতে চাই, খালামণির শরীরের গন্ধ নিয়ে ওর গায়ে লেপ্টে থাকতে চাই। মারিয়ামকে বলতে চাই 'You are my best friend”| । বুকে লাগানো ক্যামো লাইন খুলে আর দশজনের মতো ঐ নোংরা, ভীড়ে ভরা, আমার প্রিয় ঢাকায় ঘুরতে চাই। আমি আবার বুক ভরে হাসতে চাই...
***তুমিনের সাথে আমাদের প্রায়ই ফোনে কথা হয়। উপরের কথাগুলো তুমিনের কথার সারাংশ। তুমিনের কথা আপনাদের নিশ্চয়ই মনে আছে। সেই যে ২০০৭ এর ফেব্রুয়ারির শেষে ৭বছর বয়সী তুমিনের ননহজকিন্স লিম্ফোমা ধরা পড়লো! আমার ছোট্ট ভাগ্নি (আদতে আমার মেয়েই) তুমিনের কথার সুরগুলো আমি এভাবেই প্রতিদিন বুঝি, টের পাই। ও বর্তমানে চিকিতসাধীন আছে লন্ডন এর Chesterfield Hospital এর অধীনে Leukamiae বিভাগে। তুমিন মোটামুটি ৮০ শতাংশ ভালো এখন। সবাই বেশি বেশি করে তুমিনের জন্যে দোয়া করবেন, প্লীজ। আমি আমার আত্মা ছেঁড়া ধনকে আমার বুকে ফেরত চাই, আবার...

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




