সিনব্যুমি বা টেরাস প্যাগোডা
হাসিখুশী গাইড মিস ট্যান্ডা আগের রাতেই জানিয়ে দিয়েছে সে পরদিন সকাল আটটার সময় আমাদের হোটেল থেকে তুলতে আসবে।
যাত্রা হলো শুরু , এমন একটি জলযান শুধু আমাদের জন্যই
এখন গ্রীষ্মকাল, মান্দালয়ে এ সময় তীব্র তাপদাহে শরীরের চামড়া পুড়ে যাওয়ার উপক্রম। তাপমাত্রা প্রায়ই ৪২/৪৩ ডিগ্রী সেলসিয়াস পর্যন্ত উঠে যাচ্ছে। তাই সকাল সকাল বের হওয়ার পরিকল্পনা ।
আজ আমাদের প্রথম গন্তব্য মিনগুইন স্তুপা ও তার আশে পাশে অন্যান্য আকর্ষনীয় ঐতিহ্য দেখা । যেতে হবে ছোট লঞ্চে করে এসময় শান্ত শিষ্ট নদী ইরাবতীতে ভেসে ভেসে।
বিখ্যাত ইরাবতী নদী
মান্দালয়ের পাশ দিয়ে বয়ে চলা ইরাবতী নদী। শহরের পশ্চিম তীর অর্থাৎ বিপরীত দিকে ১১ কিঃমিঃ উপরের দিকে বিখ্যাত সেগাই অঞ্চলের এক শহর, নাম তার মিনগুইন। সেগাই এর কথা আমি প্রথম পর্বেও উল্লেখ করেছি। জেটি থেকে আমাদের নির্ধারিত লঞ্চে উঠলাম গাইড ট্যান্ডা সহ আমরা দুজন।
কর্তা মশাই ছবি তুলছে সাথে আমাদের গাইড, ইরাবতী নদীতে
নদীর বুকে জেগে উঠেছে চর। তাতে মুলত জেলেদের অস্থায়ী নিবাস। বর্ষায় চর ডুবিয়ে ঘর ডুবিয়ে দুকুল জুড়ে উপচে পড়ে ইরাবতীর পানি। ঐ যে দূরে ঝাপসা মত পাহাড় দেখা যাচ্ছে তার গোড়া পর্যন্ত বিস্তৃত হয়ে উঠে মায়ানমারের মাথা থেকে পা পর্যন্ত কুলু কুলু রবে বয়ে চলা এই ইরাবতী নদী।
ইরাবতীর বুক জুড়ে জেগে ওঠা চর
ঐ যে ঐ দূরে দেখা যাচ্ছে সেই অর্ধ সমাপ্ত স্তুপাটি
দূর থেকে স্তুপার সাথে মিলিয়ে গেট ।
গাইড জানালো এই গেটের নাম লায়ন গেট। তবে কাছে গিয়ে দেখলাম লায়ন নয়, আমরা হাতীর সাথেই মিল পেলাম বেশি।
হাতীর পেছন দিকের মত লাগছে লায়ন গেটটি
জলযান ছেড়ে এবার ডাঙ্গায় ঊঠার পালা । তীরে পা দেয়ার আগেই দেখি ঠিক আমাদের দেশের মত দুটো গরুর গাড়ী এগিয়ে আসছে । ভাবলাম স্থানীয় বাসিন্দাদের হয়তো। নাহ তা নয়, দেখুন আমাদের চোখে।
ট্যাক্সি
পর্যকটকরা বিশেষ করে পশ্চিমা বিশ্ব থেকে আগত প্রচুর ট্যুরিষ্ট এতে ঘুরে ফিরে খুব মজা পায়। পায়ে হেটেই উঠে যাচ্ছি স্তুপার চত্বরের দিকে । ডান দিকে তাকিয়ে দেখি বাঁশের তৈরী বিভিন্ন ডিজাইনের টুপি পর্যটকদের দৃষ্টি আকর্ষনের জন্য সাজিয়ে রাখা।
স্থানীয় নান্দনিক ডিজাইনে তৈরী বাঁশের টুপী
এসব দোকান পাট ছাড়িয়ে আসলাম স্তুপা চত্বরে। দেখলাম টিকেট ঘর। মায়ানমারের অনেক শহরে প্রবেশ করতেও আমাদের মাথাপিছু ২০ ডলার করে টিকেট কাটতে হয়েছে। কারন সে শহরগুলো পুরোটাই এক মিউজিয়াম। যাক তবে এখানে তত নয় । স্থানীয় তিন হাজার চেস মানে তিন ডলার।
টিকেট ঘর
ততক্ষনে চোখের সামনে সশরীরে তার পুরো অবয়ব নিয়ে হাজির সেই ইতিহাস বিখ্যাত অর্ধনির্মিত মিনগুইন স্তুপা। উল্লেখ্য মন্দিরের মত স্তুপার ভেতরে কোন কক্ষ থাকে না । পুরোটাই ইট বা মাটির তৈরী সলিড একটি স্থাপনা।
মিনগুইন স্তুপা
১৭৯০ সালে তৎকালীন রাজা বোধপায়া হাজার হাজার বন্দী সৈন্য আর ক্রীতদাসদের সাহায্যে মিনগুইন এ এক দৈত্যাকৃতির স্তুপা তৈরীর কাজ শুরু করেন। এর উচ্চতা ১৫০ মিটার নির্ধারন করা হয় যা শেষ হলে চীন দেশ থেকেও দেখা যেত।
স্তুপার বিশাল প্রাঙ্গন
কিন্ত ৫০ মিটার তৈরীর পর রাজ জ্যোতিষীরা জানালো এই স্তুপা যেদিন শেষ হবে সেদিনই রাজা মৃত্যুমুখে পতিত হবে অথবা তার রাজত্বের সমাপ্তি ঘটবে। একথা শুনে রাজা তৎক্ষনাৎ বাতিল করলেন তার সেই বিশাল কর্মযজ্ঞ। পড়ে রইলো এক অর্ধনির্মিত স্তুপা।
নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে লোকজন এই ভাঙ্গা স্তুপার চুড়া বেয়ে উঠছে
১৮৩৯ সালের ২৩ মার্চ মান্দালয়ে ঘটে যাওয়া শক্তিশালী এক ভুমিকম্পের ফলে বিশাল বিশাল লম্বা লম্বা ফাটল সৃষ্টি হয় তার গা জুড়ে যা অনেকদূর থেকেই দেখা যায়।
ভুমিকম্পে তৈরী হওয়া ফাটল
আস্তে আস্তে বিশাল সেই চত্বর পুরোটা একবার ঘুরে আসলাম। সাথে চলছিল গাইডের ধারা বর্ননা । এবার সামনে সামিয়ানা খাটানো সাময়িক চা এর স্টল থেকে চা খেয়ে এগিয়ে গেলাম ঘন্টা ঘরের দিকে।
এখানে উল্লেখ্য যে অনেক দেশের চা খাওয়ার সৌভাগ্য বা দুর্ভাগ্য যাই বলেন হয়েছে। খোদ চা আবিস্কারক চীন দেশে পর্যন্ত বিভিন্ন নামে পাতলা লিকারই জুটেছে কপালে । কিন্ত সত্যিকারের আমাদের মত ঘন দুধের চা এই মিয়ানমারেই খেলাম। অপুর্ব তার স্বাদ । ওরা অবশ্য জিজ্ঞেশ করে ' কি খাবে লিপটন নাকি মায়ানমার টি '? লিপটন অর্থ টি ব্যাগ চুবানো লিকার। আর মায়ানমার টি বলে চাসেক বললে ওরা সেই ঘন চা তৈরী করে দেয়।
কাঁচা মাটির পথ
চা খেয়ে রাস্তার পাশে বিভিন্ন দোকানে ঢু মারছি আর এগিয়ে চলেছি পরবর্তী গন্তব্য বিখ্যাত মিনগুইন বেলের দিকে। মিয়ানমার যে চিত্রকলায় এত অগ্রসর আমার জানা ছিল না। রাস্তার পাশে খাবার সহ বিভিন্ন দোকানের পাশাপাশি সহবস্থান করছে স্থানীয় চিত্রশিল্পীদের আঁকা ছবির আর্ট গ্যালারী । বিক্রীর জন্য সাজিয়ে রাখা ছবি দেখতে দেখতে এগিয়ে চলেছি । সেখানে শিল্পীরা জলরং আর তৈল চিত্র আকায় অত্যন্ত দক্ষ।
এমন চমৎকার ছবি একে বিক্রী করছে এক বৃদ্ধ শিল্পী
এই ফাঁকে একটি জলরং এ আঁকা ছবিও কিনলাম।
মিনগুইন স্তুপার সাথে মিলিয়ে তৈরী ঘন্টার ঘর
রাজা বোধপায়া এই বিশাল স্তুপার সাথে মিলিয়ে এক বিশাল ঘন্টাও তৈরী করেন যার ওজন ৯০ টন। যা বর্তমানে পৃথিবীর বৃহত্তম বাজনাদার ঘন্টার মর্যাদা লাভ করছে।
মিঙ্গুইন ঘন্টা
এই ঘন্টার নীচে যাবার জন্য গাইড আমাকে অনুরোধ করলে আমি সম্মত হইনি । কারন একবার ছিড়ে পরলে এই ৯০ টন ঘন্টা কতক্ষনে তুলে ধরবে !
বিশাল সেই ঘন্টার একটি অংশ
এরপরের যাত্রা সিনব্যুমি /মায়াথেইন্ডান প্যাগোডার দিকে। বাংলাদেশের গ্রামের মতই লাগছে চারিদিক । গাছে গাছে অজস্র সবুজ কাচা আম ঝুলে আছে । মেয়েরা এই অলস মধ্য দুপুরে বন্ধ দোকানের সামনে বেঞ্চে বসে গল্প করছে।
গল্প করার এইতো দিন
হঠাৎ আমাদের চোখের সামনে ভেসে উঠলো এক সফেদ, শুভ্র প্যাগোডা। যার উপর রোদ পড়ে এক অপুর্ব দৃশ্যের সৃষ্টি করেছে। আমরা দুজন মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম । রাজা বোধপায়ার নাতি বাগিদা তার প্রধান রক্ষিতা প্রিন্সেস সিনব্যুমিকে চির স্মরণীয় করে রাখার জন্য ১৮১৬ খৃষ্টাব্দে নির্মান করেন এই অনিন্দ সুন্দর প্যাগোডাটি। সাতটি ধাপে ধাপে নেমে এসেছে মাটিতে।দেখুন সেই নয়নজুড়ানো মনমুগ্ধকর প্যাগোডা ।
Hsinbyume or Myatheindan pagoda
সব কিছু স্বৃতিপটে গেথে ফিরে আসলাম মান্দালয় আর খেতে বসলাম তাদের ট্র্যাডিশনাল ফুড । এখনো কিন্ত আসল খাবার দেয়া হয়নি । আমাদের অর্ডার ছিল শুধু মাছ এর তরকারী আর ভাত । এগুলো সব সাইড ডিশ ।
ট্র্যডিশনাল মায়ানমার খাবার ।
অত্যন্ত সুস্বাদু এই সাইড ডিসের মাঝে রয়েছে, আলুর দম, বেগুনের তরকারী, বুটের ডাল আর এচোড় অর্থাৎ কাঁচা কাঠালের তরকারীও।
ভেবেছিলাম এখানেই শেষ করবো মান্দালয় ভ্রমন তা আর হলো না

চলবে ।
ছবি সব আমাদের তোলা ।
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে জুন, ২০১৫ রাত ১০:১২