বিখ্যাত লায়ন সিংহাসনে বসে আছেন রাজা মিনডন ও তার স্ত্রী
মিঙ্গুইন স্তুপা দেখে ফিরে এসে খেতে বসলাম , গাইড ট্যান্ডা জানালো আমাদের পরবর্তী সুচী কুথোদ প্যাগোডা। আমি জিজ্ঞেস করলাম ' ঐ যে রয়েল প্যালেস যার লাল ইটের সুউচ্চ দেয়াল সেই সাত সকালেই নজর কেড়েছিল মিঙ্গুইন যাবার জন্য জেটিতে যাবার পথে, সেখানে যাবো না '?
না ওটা নাকি আমাদের ভ্রমন সুচীতে নেই। শুনে মনটা খারাপ হয়ে গেল । আমাদের অনুরোধে শেষ পর্যন্ত রাজী হলো গাইড আর দেখা হলো আমাদের এক ঐতিহাসিক নগরীর রাজপ্রাসাদ । গাইড এর কাছ থেকে এই প্রাসাদের খন্ড খন্ড কিছু ইতিহাস জেনেছিলাম । বাকিটা বিভিন্ন সুত্রের সাথে গেথে গেথে লিখলাম আমার মান্দালয় ভ্রমনের তৃতীয় পর্ব।
রাজতন্ত্রের দেশ মায়ানমারের শেষ উল্লেখযোগ্য রাজা ছিলেন মিনডন মিন। ১৮০৮ সালের ৮ই জুলাই রাজধানী অমরাপুরায় জন্মগ্রহন করেন তিনি। তাঁর বাবা ছিলেন মায়ানমারের বিখ্যাত কনবং বংশজাত রাজা থারাওয়াদ্দি।রাজার মৃত্যুর পর তার সৎ ভাই পাগান সিংহাসনে বসেন। ১৮৫২ সালে বৃটিশরা রাজা পাগানকে পরাজিত করে লোয়ার বার্মা দখল করে নেয়। কিন্ত আপার বার্মার ক্ষমতা বার্মিজদের হাতেই থেকে যায়। ১৮ই ফেব্রুয়ারী ১৮৫৩ সনে মিনডন তার ছোটা ভাই কনং এর সহায়তায় চাচা পাগানকে ক্ষমতাচ্যুত করে সিংহাসনে বসেন।
অত্যন্ত জনপ্রিয় এবং প্রজাদের চোখে সন্মানীয় রাজা মিনডন আমৃত্য তার রাজ্য আপার বার্মাকে বৃটিশদের লোলুপ দৃষ্টি থেকে রক্ষা করে যান।সে সাথে দেশকে একটি আধুনিক রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তুলতে মনপ্রান ঢেলে দেন।
রাজা মিনডনের মুর্তির সামনে স্থানীয় পর্যটক
এ উদ্দেশ্যে তিনি বিভিন্ন জনহিতকর কাজে আত্ননিয়োগ করেন। তার ছোট ভাই রাজপুত্র কনং দক্ষ প্রশাসক ছাড়াও ছিলেন যুগের তুলনায় অনেক এগিয়ে, তার দৃষ্টিভঙ্গী ছিল সুদুরপ্রসারী। এই কনং এর সহায়তায় রাজা মিনডন রাজ্যের বিভিন্ন ক্ষেত্রে ব্যাপক সাফল্যের অধিকারী হয়েছিলেন।তার মধ্যে উল্লেখযোগ ছিল অমরাপুরা থেকে রাজকার্য্যের জন্য সুবিধাজনক স্থান মান্দালয়ে রাজধানী স্থানান্তর(১৮৫৭)।
মান্দালয় রাজপ্রসাদ
ঢেলে সাজিয়ে ছিলেন আভ্যন্তরীন প্রশাসনকে।অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে যুগপযোগী এবং উন্নত করার বেতন কাঠামো গঠন করা, বিচার ফি ধার্য্য, যন্ত্রের মাধ্যমে মুদ্রা তৈরী করার আধুনিক টাকশাল প্রতিষ্ঠা, সে সময় প্রচলিত বানিজ্য বাধা দূর এবং রাজস্ব কর অপসারন করেছিলেন। নতুন পুলিশবাহিনীও গড়ে তোলা ছাড়াও সৈনবাহিনীকে করেছিলেন আধুনিক যার প্রধান ছিলেন রাজপুত্র কনং।
এমনকি সুয়েজ খাল খননের পর তিনি বৃটেনের সাথে ব্যাবসা বানিজ্য করার জন্য সুদক্ষ এক স্টিমার বহর চালু করেন।।শিল্প বিপ্লবের প্রত্যক্ষ ফলাফল ছিল উন্নত দেশে শিল্প কারখানার ব্যাপক প্রতিষ্ঠা। এই ব্যপারে জ্ঞ্যান লাভের জন্য রাজা মিনডন কনং এর পরামর্শে একদল শিক্ষার্থী পাঠিয়েছিলেন বৃটেন, ফ্রান্স ইতালী এমন কি আমেরিকা পর্যন্ত।
রাজপ্রাসাদের ভেতরে বাঁধানো রাজা মিনডন ও পরিবারের অন্যান্যদের ছবি
বৌদ্ধধর্মের প্রতি গভীরভাবে নিবেদিত রাজা মিনডন মান্দালয় পাহাড়ের পাদদেশে নির্মান করেন বিখ্যাত কুথোদ বৌদ্ধ বিহার, আর এই মঠ প্রাঙ্গনে তিনি রচনা করেন পৃথিবীর অন্যতম এক আশচর্য্য যা বেঁচে থাকলে পরবর্তী পোষ্টে লিখবো আশাকরি।
যাই হোক রাজা মিনডন তার শাসন কাজ চালাচ্ছে কিন্ত উত্তরাধিকারী ঘোষনা করার ব্যাপারে তাঁর কোন সাড়া শব্দ নেই। এনিয়ে সম্ভাব্য উত্তরাধিকারী মাঝে শুরু হয় চাপা অসন্তোষ, যার ফলাফল ছিল এক ভয়ানক প্রাসাদ ষড়যন্ত্র।
১৮৬৬ সালের জুন মাসে দুই রাজপুত্র তাদের পথের কাঁটা চাচা কনং যিনি নিয়ম অনুযায়ী রাজা মিনডনের প্রকৃত উত্তরাধীকারী ছিলেন তাকে নির্মমভাবে হত্যা করেন। তাকে নিয়ে বার্মার এক অংশে ঘাটি গেড়ে বসা বৃটিশ সৈন্যবাহিনীরাও চিন্তিত ছিল।কনং কে হত্যার পর দুই রাজপুত্র পালিয়ে বৃটিশ বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পন করে। রাজা মিনডন নিজেও মৃত্যুর হাত থেকে অলৌকিকভাবে রক্ষা পান।তাকে মারার জন্য ষড়যন্ত্রকারীরা যাকে পাঠিয়েছিল সে রাজার সামনে এসে নতজানু হয়ে পড়ে, ফলে রাজা প্রানে বেচে যান।
প্রচন্ড শীতের ভোরেও কম্বল পেঁচিয়ে কারখানায় যে ছুটে যেতেন, কর্মচারীদের খবর নিতেন, কাজ কর্ম ঠিকমত হচ্ছে কি না দেখার জন্য, যন্ত্রপাতি সব ঠিক আছে কি না জানতে চাইতেন।দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবার যিনি রূপকার,আধুনিক মায়ানমারের জনক কনং আজও মায়ানমারের জনগনের মনে চির জাগরুক হয়ে আছেন ।
পরিখা ঘেরা রাজপ্রাসাদের সুউচ্চ দেয়াল
এদিকে রাজা মিনডনের আনুষ্ঠানিক ভাবে ঘোষিত ৬২ রানীর গর্ভে ১১০ জন সন্তান ছাড়াও অগনিত রক্ষিতা এবং দাসীর গর্ভেও অগনিত সন্তান জন্মলাভ করে।এমনি এক রক্ষিতার ঘরেই জন্ম নিয়েছিলেন রাজপুত্র থিবো। তার বিয়ে হয়েছিল সৎ মা রানী স্যিনব্যুমাশিন এর মেয়ে সুপেলাত অর্থাৎ সৎ বোনের সাথে। পরবর্তীতে থিব তার তিন শালিকেও বিয়ে করেন।
জীবনের শেষ প্রান্তে এসে উপস্থিত রাজা মিনডন,রাজত্ব পরিচালনায় শারিরীক এবং মানসিক ভাবে এখন তিনি অক্ষম।যথারিতী রাজ্য পরিচালনার ব্যাপারে সব সিদ্ধান্ত নিতে শুরু করলেন থীবোর শাশুড়ী অর্থাৎ রানী সিনব্যুমাশিন।স্বাভাবিক ভাবেই তিনি চাইলেন তার জামাতা থীবো যেন সিংহাসনের উত্তরাধিকারী হয়।
হোটেল আমাদের রুমে বাধানো রাজা থীবো ও তার চার রানীর ছবি। আর আমি ভেবেছিলাম কিনা হোটেল মালিক
উদ্দেশ্য সফলের জন্য এক ভয়ংকর রক্তের হোলি খেলায় নামেন রানী সিনব্যুমাশিন। রাজার অনুগত রাজবংশজাত, অভিজাত ছাড়াও সেনা বাহিনীর উচুপদে যারা ছিলেন সকল বয়সী নারী পুরুষদের তার নির্দেশে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়।রক্তপিপাশু রানী যুক্তি দেখান যে বৃদ্ধ রাজা মিনডন বিদায় নেয়ার আগে তাদের বিদায় দেখতে চাইছেন।
১লা অক্টোবর ১৮৭৮ সনে মায়ানমারের সর্বশেষ জনপ্রিয় রাজা মিনডনের মৃত্যু হলে থিব অগনিত মানুষের রক্তে ভেসে যাওয়া সিঙ্গহাসনে বসেন।তবে মাত্র সাত বছর পরই ১৮৮৫ সালে বৃটিশবাহিনীর কাছে বার্মা সম্পুর্ন ভাবে পরাজিত হলো। রাজা থিবো স্ত্রী সন্তান নিয়ে বৃটিশ সরকারের নির্দেশে বাকী জীবনের জন্য নির্বাসিত হন ভারতের রত্নগিরিতে ।সেই সাথে অস্তমিত হলো মায়ানমারের রাজতন্ত্র।
রাজা থীবো ও তার প্রধান মহিষী
মান্দালয় পাহাড়ের পাদদেশে ইয়াদানাবন এলাকায় ২৫.৫ স্কয়ার মাইল জায়গা জুড়ে চৌকোনা নকশায় গড়ে তোলা নতুন রাজধানীর একদম বুকের মাঝখানে রাজা মিনডন তৈরী করেন তার স্বপ্নের রাজপ্রাসাদ। দ্বিতীয় এংলো বার্মিজ যুদ্ধের ফলে রাজকোষে ঘাটতি দেখা দিলে রাজা মিনডন প্রাক্তন রাজধানী অমরাপুরার বিভিন্ন স্থাপনা ভেঙ্গে এনে এখানে স্থাপন করেন।এই সব বিশাল বিশাল মালপত্র হাতীতে করে নিয়ে আসা হয়েছিল। অমরাপুরার প্রাচীর গুড়িয়ে এনে মান্দালয় প্রাসাদ তৈরীতে ব্যবহার করা ছাড়াও রাস্তাঘাট নির্মানে ব্যাবহার করা হয়েছিল।
প্রাসাদের সীমানা ও নিরাপত্তা দেয়াল
৪১৩ হেকটর জায়গা জুড়ে অত্যন্ত জাঁকজমক এর সাথে গড়া এই প্রাসাদের রূপ আমাকে চীনের রাজপ্রাসাদ ফরবিডেন সিটির কথা মনে করিয়ে দিল। তেমনি ঢেউ তোলা সব ঘরের নকশা, ভেতরের চেহারাটাও তেমনি।খাট পালংকের যে দু একটা নমুনা সাজিয়ে রাখা আছে তাতে সবই চৈনিক নকশার প্রতিফলন। আসলগুলো জাতীয় যাদুঘরে রাখা আছে।
দরবারের সামনে স্বর্নালী হলঘর। গাইড ট্যান্ডা মাথা ঝাকিয়ে বার বার বলছিল যা দেখছো সবই রেপ্লিকা ।
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় জাপানী সৈন্যরা এই প্রাসাদ দখল করে নিয়েছিল যা কিনা পরে মিত্র বাহিনীর বোমাবর্ষনে সম্পুর্ন্ভাবে ধ্বংস হয়। শুধু টিকে থাকে সেই আধুনিক টাকশাল আর একটি ওয়াচ টাওয়ার।বৃটিশরা একে সেনা দফতর হিসেবে ব্যাবহার করে যা আজও সেই কাজেই ব্যাবহার করা হচ্ছে। পরবর্তীতে সেই আদলে পুনির্মান করার চেষ্টা করা হয় যা আমরা দেখতে গেলাম সেই প্রচন্ড রোদ্দুর মাথায় নিয়ে গাইড মিস ট্যান্ডার সাথে। টিকিট কেটে ভেতরে ঢুকলাম আর দেখলাম বার্মার শেষ রাজবংশের স্মৃতি বিজড়িত সেই রাজপ্রাসাদ যা আমাদের ট্যুর কোঃ তৈরী করা দেখার তালিকায় ছিল না । আসুন আমার চোখে আপনারাও দেখে নিন মান্দালয়ে রাজা মিনডনের রাজপ্রাসাদ।
রাজপ্রাসাদের ভেতরে ঢোকার গেট
লাল রঙ করা বিশাল সেগুন গাছের গুড়ি দিয়ে তৈরী পিলারের ঘর । রাজা মিনডনের জন্য তৈরী
রাজার জন্য স্বর্নের খাট
এক নজরে রাজপ্রাসাদ
প্রাসাদের আঙ্গিনায় ছবি তুলতে ব্যাস্ত বিদেশী পর্যটক
হেটে চলেছি প্রাঙ্গনে
রাজপ্রাসাদের আঙ্গিনায়, লাল লাল ঘর সব রাজবাড়ীর বিভিন্ন সদস্যের জন্য
গাইড ট্যান্ডার কাছে হারিয়ে যাওয়া ঘটনা শুনতে শুনতে এগিয়ে যাওয়া
রানীদের থাকার ঘর
কার জন্য এ ঘর কে জানে ?
প্রাসাদের এক দিকে অসাধারন কাঠের কারুকাজ করা মনেস্ট্রি
ব্যাতিক্রমী নকশ করা মনেস্ট্রির গেট
সেই মনেস্ট্রিটাই
দোতলার বারান্দা থেকে কাঠের কারুকাজ করা মনেস্ট্রির দেয়াল
ভেতরে বুদ্ধের মুর্তি
মনেস্ট্রির ভেতরে
বৃটিশ সৈন্যরা রাজা থীবোকে তার চার রানী সহ গরুর গাড়ী করে নির্বাসনে ভারত পাঠাচ্ছেন আলোকচিত্র
ছবি সব আমাদের ক্যামেরায় তোলা ।
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে মে, ২০১৫ সকাল ১০:০৯