somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

মুদ্রার এপিঠ ওপিঠ ( ছবি + ইতিহাস )

২১ শে মে, ২০১৫ বিকাল ৩:০০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


ওয়ার সিমেট্রি, রেঙ্গুন

১৫ দিনের সফর ছিল মায়ানমারে আমাদের, রেঙ্গুন নেমেই পরদিন উড়ে গেলাম মান্দালয়। এরপর ছিল তিনটি শহর যার একটি আবার ছিল শান প্রদেশে, তো সেখানে ঘুর ঘুর শেষে ফিরে এলাম আবার রেঙ্গুনে যেখানে মোট ৫ দিন ছিলাম। তার মাঝে অবশ্য দুদিন প্যাকেজ ট্যুরের আওতায় সিটি ট্যুরই হলো । এখন হাতে রইলো তিন দিন, কি করা যায় ভাবতে ভাবতে গাইড বই এর শরণাপন্ন হোলাম। খুজতে গিয়ে চোখে পড়লো ওয়ার সিমেট্রির নাম। ইতিহাসের ছাত্রী হিসেবে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের ঘটনাবলী আমার পড়াই ছিল । সেই সাথে আরো দু দেশের তিনটি সিমেট্রি আমি দেখেছি। সুতরাং এখানে যাবার ব্যাপারে আমার ভীষন আগ্রহ।



আমাদের হোটেলের সামনে খোলা চত্বরে সব সময় বসে থাকে কিছু ট্যাক্সি ড্রাইভার । তাদের দুজনার সাথে আমাদের ভালো একটা সম্পর্ক গড়ে উঠেছিলো । ঘোরা ফেরার ফাঁকে ফাকে তাদের সাথে বসে সামনের খোলা রেস্টুরেন্টে বিনে পয়সার চা খাওয়া, স্থানীয় বিষয় নিয়ে গল্প করা ইত্যাদি । পরস্পর বন্ধু দুজন খুব ভালো ইংরাজী বলতে পারে এটাই ছিল হয়তোবা আমাদের সাথে গল্প করার একটি কারন। এদের একজন ছিল দারুন আমুদে, আরেকজন বেশ চুপচাপ। তাদের সাথেই সন্ধ্যার অবসরে টুকটাক আলাপের মাঝে জানতে চাইলাম ওয়ার সিমেট্রি আমাদের হোটেল থেকে কত দূর ? কি ভাবে যাবো? তবে সেই আমুদে ড্রাইভারের যে কথায় আমরা দুজন সবচেয়ে চমকে উঠেছিলাম সেটা হলো বিখ্যাত সেই ওয়ার সিমেট্রির কাছেই নাকি জাপানী সৈনিকদের একটি অখ্যাত সিমেট্রি রয়েছে।


গেটের বাইরে সবুজ সাইনবোর্ডে লেখা ক্ষুদ্র ইতিহাস

দুই বন্ধুর একজন পরদিন আমাদের নিয়ে যাবে সেখানে । সকাল আটটায় রওনা দেবো । কারন বেশি দেরী করলে প্রচন্ড রোদ আর তীব্র গরমে শরীর পুড়ে যাবো বলে সতর্ক করে দিল চালকদ্বয়। দুটো সিমেট্রিতে যাওয়া, যতক্ষন লাগে ঘুরে দেখে আবার হোটেলে ফিরিয়ে আনবে ভাড়া ২৫ হাজার চেস। অর্থাৎ বাংলাদেশী টাকায় আড়াই হাজার টাকা ।


গেটের ভেতরের দিকে দেয়ালে লেখা ছোট ইতিহাস


সুদৃশ্য স্থাপত্যটি ভেতর থেকে


সারি সারি সৈনিকের সমাধি

রেঙ্গুন থেকে দক্ষিনে পঁচিশ কিলোমিটার দূরে তকিয়ান গ্রামে ওয়ার সিমেট্রি। পুর্ব দিকে এই মহাযুদ্ধের একটি প্রধান রণাঙ্গন ছিল সে সময়কার বৃটিশ উপনিবেশ বার্মা ।সেখানে বিভিন্ন স্থানে নিহত সৈনিকদের শেষ আশ্রয়স্থল হিসেবে সৃষ্টি করা হয়েছে এই দৃষ্টি নন্দন এবং ভাবগম্ভীর পরিবেশের ওয়ার সিমেট্রি । এখানে রয়েছে মোট ৬,৩৭৪ কবর যারা প্রান দিয়েছিল দুটি ভয়াবহতম যুদ্ধে । এদের মধ্যে ৮৬৭ টি কবরবাসীকে চিনহিত করা যায় নি। যাদের সমাধির উপর এপিটাফে লেখা আছে ইশ্বর তোমার পরিচয় জানে।।


ইশ্বর তোমার পরিচয় জানে

এছাড়াও আছে প্রথম মহাযুদ্ধে নিহত ৫২ জন সৈনিকের দেহাবশেষ। রয়েছে ২৬ হাজার কমনওয়েলথ সৈনিকদের নাম, যার মাঝে আছে ভারতীয় ১৮১৯ জন সৈনিক এবং আফ্রিকার সৈনিক।


কমনওয়েলথভুক্ত দেশের সৈনিকদের নাম



সমাধিগুলো দেখাশোনার দায়িত্ব কমনওয়েলথ এর একটি সংগঠন এর।



ভারতীয় এক সৈনিকের কবর


১৯ বছরের বালক সৈনিক ডব্লিউ আর টাউন সুদুর বার্মার মাটিতে শুয়ে আছে, বুকে তার মা এর আশীষ বানী লেখা


বিশ বছরের এক তরুন সৈনিকের কবরে হয়তো তার ঘনিষ্ঠ কারো লেখা



মর্মস্পর্শী এক এপিটাফ



হাজারো অতৃপ্ত আত্মার হাহাকার ভরা নিঃশাস বাতাসের সাথে মিশে বয়ে চলে এখানে এই ওয়ার সিমেট্রিতে


নির্জন কিন্ত বুকে ঘা দিয়ে যায়


সবুজ গাছ এর কুঞ্জ পথ


এখানে শুয়ে আছে ২১ বছরের যুবক ডব্লিউ টিমস। আর কালো লোহার পাতে লেখা আছে তার বাবা মা এর অশ্রু সজল কান্নায় লেখা দুটি চরন।


স্বামী হারা এক বিধবার আর্তি



প্রতিদিন প্রচুর পর্যটক বিশেষ করে ইউরোপিওরা সেখানে আসে

১৯৫১ সালে দর্শনার্থীদের জন্য খুলে দেয়া হয়েছে এই ওয়ার সিমেট্রি। আসুন আমাদের চোখে দেখে নিন সেই দুরদেশের মাটিতে আত্মীয় পরিজন ছাড়া মাটির গভীরে শুয়ে থাকা কত শত তরুন যুবক এর দেহাবশেষ। সারি সারি কবরের উপর লোহার পাতে সৈনিকদের পরিচয় আর তাতে লেখা তাদের মা বাবা ভাই বোন স্ত্রী পরিজনের দু এক লাইন কবিতা যাকে এপিটাফ বলে । সেগুলো পড়লেই বোঝা যায় কি রক্ত ক্ষরণ তাদের বুকে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত ঝরে চলেছে ।এসব সিমেট্রির এপিটাফগুলো পড়লে চোখের পানি ধরে রাখা মুশকিল । ।



আগেই বলেছি বাংলাদেশের ময়নামতী আর চট্টগ্রাম ছাড়াও থাইল্যান্ডের কাঞ্চনাবুড়ির ওয়ার সিমেট্রি দেখার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল। কিন্ত কোথাও জাপানী সৈনিকদের কবরের কথা শুনি নি । তাদেরও তো কত সৈনিক নিহত হয়েছিল বিভিন্ন রনাঙ্গনের সেই প্রানঘাতি যুদ্ধে। বার্মার মান্দালয় পাহাড়ের উপর বৃটিশ বাহিনীর হাতে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে পরাজিত হয়েছিল জাপান। ইরাবতী নদীর পানি রক্তে লাল হয়ে উঠেছিল। শুধু বার্মাতেই জাপানের ২ লক্ষ সৈন্য মৃত্যু বরন করে। এ কারনে আজও ইতিহাসের পাতায় তারা খল নায়ক হিসেবে চিনহিত হয়ে আছে ।

আসুন জাপানী সিমেট্রিতে যাওয়া যাক।ওয়ার সিমেট্রির তুলনায় ক্ষুদ্র একটি জায়গায় গড়ে উঠেছে জাপানী সৈন্যদের কবরস্থান ।


মিত্র বাহিনীর সিমেট্রি থেকে অক্ষ বাহিনীর সিমেট্রির পথে


মলিন অনাড়াম্বর গেট


গেটের ভেতর দিয়ে এগিয়ে চলুন সোজা এই পথ ধরে

নায়ক নয় খল নায়ক সেই সব জাপানী সৈনিকদের সিমেট্রি দেখার ভাগ্যও আমাদের হলো । একটি ছবিতে দেখলাম জাপানী প্রধানমন্ত্রী শ্রদ্ধা জানাতে এসে সমালোচনার মুখে পরেছিলেন ।


গেট দিয়ে ঢুকে সোজা এক পথ শেষ হয়েছে চারিদিক খোলা এই সাদামাটা স্থাপনায় ।

সেখানে মাঝখানে করা এক গোল গর্তের মাঝে একটি চ্যাপটা পাথর কাত করে রাখা, তার মাঝে জাপানী ভাষায় লেখা কয়েকটি অক্ষর । হয়তো মৃতদের উদ্দেশ্যে কিছু লেখা । এক কিশোরী আর এক বৃদ্ধা ম্লান মুখে সেখানে দাঁড়িয়ে আছে । তারা কোন জাতি বুঝতে পারলাম না । আমাদের দেখে ব্যাগ থেকে একটি স্মারক খাতা বের করলো । সেখানে আপনি স্বাক্ষর করতে পারেন, কিছু লিখতে পারেন। সেই খাতায় প্রচুর লেখা দেখলাম তবে বেশিরভাগই জাপানী ভাষায় লেখা। আমিও লিখে আসলাম দু কলম ইতিহাসের সেই সব তথাকথিত খল নায়কদের আত্মার শান্তির উদ্দেশ্যে।


এখানে দু একজন ফুল বা ধুপ জালিয়ে দিয়ে যায় হয়তো বা ।

মানবতার বিরুদ্ধে যুদ্ধে পরাজিত এই সব সৈনিকরা ইতিহাসের আস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত হলেও যখন মনে হয় তারাও তো কারো সন্তান কারো স্বামী কারো বা ভাই। নিজের ইচ্ছেয় নিশ্চয় সবাই তারা যুদ্ধ করতে আসে নি। তাদের দেশের রাজার হুকুমেই এসেছিল। তাদের সব কিছুই সংঘটিত হয়েছিল উপর এর নির্দেশে।


এটা মনে হয় জাপানী সরকারের সহযোগিতায় বর্তমানে তৈরী করা


সিড়িতে আমি বসে আছি

জাপানীরা কত সৌন্দর্য্য প্রিয় জাতি আমরা যারা জাপান যাইনি তারাও বিভিন্ন মাধ্যমে দেখেছি । সামান্য জিনিসকেও তারা কত শৈল্পিকভাবে উপস্থাপনা করে । সেক্ষেত্রে অনাদরে অবহেলায় বিদেশের মাটিতে পড়ে থাকা তাদের দেশের সৈনিকদের সাদামাটা সমাধিগুলো দেখে খারাপই লাগলো।


পথের দু দিকে নতুন করে এমন কিছু পাথরে লেখা স্মৃতি চিনহ । জাপানী ভাষায় লেখা বলে পড়তে পারলাম না ।


এমন অযত্ন অবহেলায় জাপানী সৈনিকদের সার সার কবর









শ্যাওলা ধরা সমাধির সারি


ফিরে চলা এই পথ ধরে।

সেই সাথে দেখা হলো আমার মুদ্রার এপিঠ ওপিঠ।

ছবি আমাদের ক্যামেরায় তোলা
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই নভেম্বর, ২০১৮ দুপুর ২:৫২
৪৮টি মন্তব্য ৪৭টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমি হাসান মাহবুবের তাতিন নই।

লিখেছেন ৎৎৎঘূৎৎ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



ছোটবেলা পদার্থবিজ্ঞান বইয়ের ভেতরে করে রাত জেগে তিন গোয়েন্দা পড়তাম। মামনি ভাবতেন ছেলেটা আড়াইটা পর্যন্ত পড়ছে ইদানীং। এতো দিনে পড়ায় মনযোগ এসেছে তাহলে। যেদিন আমি তার থেকে টাকা নিয়ে একটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতীয় পণ্য বয়কটের কেন এই ডাক। একটি সমীক্ষা-অভিমত।।

লিখেছেন সাইয়িদ রফিকুল হক, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৩:১৫



ভারতীয় পণ্য বয়কটের কেন এই ডাক। একটি সমীক্ষা-অভিমত।।
সাইয়িদ রফিকুল হক

বিএনপি ২০২৪ খ্রিস্টাব্দে দেশে অনুষ্ঠিত “দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে”-এ অংশগ্রহণ করেনি। তারা এই নির্বাচনের বহু আগে থেকেই নির্বাচনে অংশগ্রহণ... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তিযোদ্ধাদের বিবিধ গ্রুপে বিভক্ত করার বেকুবী প্রয়াস ( মুমিন, কমিন, জমিন )

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৫:৩০



যাঁরা মুক্তিযদ্ধ করেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে লেখা তাঁদের পক্ষে মোটামুটি অসম্ভব কাজ। ১৯৭১ সালের মার্চে, কৃষকের যেই ছেলেটি কলেজ, ইউনিভার্সিতে পড়ছিলো, কিংবা চাষ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো, সেই ছেলেটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। সাংঘাতিক উস্কানি মুলক আচরন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৪



কি সাঙ্ঘাতিক উস্কানিমুলক আচরন আমাদের রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর । নাহ আমি তার এই আচরনে ক্ষুব্ধ । ...বাকিটুকু পড়ুন

একটি ছবি ব্লগ ও ছবির মতো সুন্দর চট্টগ্রাম।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৮:৩৮


এটি উন্নত বিশ্বের কোন দেশ বা কোন বিদেশী মেয়ের ছবি নয় - ছবিতে চট্টগ্রামের কাপ্তাই সংলগ্ন রাঙামাটির পাহাড়ি প্রকৃতির একটি ছবি।

ব্লগার চাঁদগাজী আমাকে মাঝে মাঝে বলেন চট্টগ্রাম ও... ...বাকিটুকু পড়ুন

×