somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

দিন শেষের কাব্য

০২ রা এপ্রিল, ২০১৬ দুপুর ১:০৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



সময়টা সুবহ সাদেক তবে শীতের এই রাত এখনো মনে হয় অনেক গভীর। গাঢ় কুয়াশায় বিশ্ব চরাচর যেন ঢাকা পড়ে আছে। কাঁথাটা গা থেকে ফেলে অনেক কষ্টে উঠে বসলো মায়মুনা বিবি। সে জানে এখন ফজর নামাজের সময়। আরেকটু দেরী করলে নামাজের ওয়াক্ত পার হয়ে যাবে ।

আদিগন্ত ফসলী ক্ষেতের পাশেই তাল- সুপাড়ী আর আম- কাঠালের ছায়ায় ছায়ায় কয়েক ঘর ছন আর টালি ছাওয়া মাটির ঘর। তাতে তার শ্বশুড়দিকের আত্নীয় পরিজনেরই বসবাস। তাদের এই ছোট্ট গাঁয়ের ত্রি সীমানায় কোন মসজিদ নেই । এই এলাকায় যা একটা টিনের দোচালা মসজিদ তাও সেটা মাইল তিনেক দূরে সেই যাকে বলে বড় বাজারের লাগোয়া। তাই এ বাড়ীর লোকজন আজান শুনে নামাজ পড়ার কথা চিন্তাও করতে পারে না। বহু বছর ধরে গত হয়ে যাওয়া তার স্বামী সুর্য্যের আলোর নিশানা দেখে দেখে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়েছে।

অন্ধকারের মাঝেই হাতড়ে হাতড়ে দিয়াশলাই এর বাক্সটা খুজে কুপি বাতিটি কয়েকবারের চেষ্টায় জ্বালিয়ে ধরে। সলতেয় আগুন পড়তেই দপ করে লাফিয়ে উঠে তার শিখা আর খানিকটা কেরোসিনের গন্ধওয়ালা ধোঁয়া ভুস করে গলায় ঢুকে পড়ে মায়মুনা বিবির। সাথে সাথে খঁক খঁক করে কেশে উঠে আর তার ধাক্কা গিয়ে লাগে বুকের পাজরে। কাশির দমকে মনে হচ্ছে বুকের ক্ষয়ে যাওয়া হাড়গুলো যেন এবার ভেংগেই পড়বে ।

আঁচলটা মুখে চেপে ধরে সেই ধোঁয়া উঠা ঝাপসা আলোয় দরজার দিকে এগিয়ে যায় মায়মুনা বিবি। বাইরে আসতেই মনে হলো প্রচন্ড শীত যেন ধাক্কা তাকে দিয়ে ফেলে দেবে। তাড়াতাড়ি বারান্দার খুটিটা হাতে ধরে সামলে নিল প্রৌঢ়া। ঘুট ঘুটে এই অন্ধকারের মাঝে খানিকটা দূরে দেবর গনি মুন্সীর বাড়ী থেকে সামান্য আলোর রেখার সাথে সাথে অস্পষ্ট কথাবার্তাও ভেসে আসছে।

ফরসা রঙ আর মাথা ভরা পাকা চুল মায়মুনা বিবির বয়সের ভারে ধনুকের মত বাকা হয়ে আসা মোটাসোটা শরীরটা নিয়ে মাটির দাওয়া থেকে নেমে আসে, তারপর আন্দাজে আন্দাজে এগিয়ে চলে ছোট পুকুরটির দিকে। পুকুরের ঐ পাশে চটের ঘের দেয়া একটুখানি বাথরুম। সেখানের কাজ সেরে অনেকগুলো মাটির সিড়ি হাতড়ে হাতড়ে নেমে খেজুর গাছের কান্ডের উপর বসে মায়মুনা বিবি অজু করার জন্য।শীতকালতো তাই পানিও কমে তলানীতে এসে ঠেকেছে। শীত থাকলে কি হবে পুকুরের পানি কিন্ত ওম গরম। ওজু করে ঘরে এসে ছেড়া পাটিটা বিছিয়ে নামাজ পড়তে বসে নিকানো মেঝের এক কোনায়।

নামাজ শেষ করে ত্যাড়াব্যকা এলুমিনিয়ামের বাটিতে একটুখানি গুড় আর এক মুঠ মুড়ি নিয়ে বসে মায়মুনা বিবি । মাটির পাতিলে পানি দেয়া ভাত ঢাকা আছে তাই আরেকটু বেলা হলে কাচা মরিচ আর ভর্তা দিয়ে খেয়ে নেয়া যাবে।

“এই জরিনা, জরিনা, উঠো বুবু নামাজের সময় হইছে” । নানীর ডাকে কাঁথাটা আরো ভালো করে মুড়িসুড়ি দিয়ে পাশ ফিরলো কিশোরী নাতনী । দুদিন হলো পাশের গ্রাম থেকে নানীর কাছে বেড়াতে এসেছে ছোট মেয়ে রহিমার বড় মেয়েটি। মায়মুনা বিবির দুটিই মেয়ে, কোন ছেলে নেই। স্বামী বেচে থাকতেই মেয়েদের বিয়ে হয়ে গেছে পাশের গ্রামের স্বচ্ছল দুই গৃহস্থ পরিবারে। জুলেখা আর রহিমা মায়ের মতই ডাকসাইটে সুন্দরী। মেয়ে দুটোকে বিয়ে দিতে আমিনুদ্দিন মুন্সীর কোন যৌতুক লাগেনি । তারা বলতে গেলে সেধেই নিয়ে গেছে।

তাছাড়া জামাই দুজনই বেশ শক্ত সমর্থ খাটিয়ে পুরুষ, মেয়েরা খেয়ে পরে ভালোই আছে। তবে ছোট মেয়েটির শশুড়- শাশুড়ী, দেবর ননদ নিয়ে ভর ভরন্ত সংসার, তাই খাটুনিটা একটু বেশি। গ্রামের মাঝেই অনেক বিধবা বা গরীবের মেয়ে আছে যারা এবাড়ী ও বাড়ী গিয়ে কুটোবাছা বা ধান শুকানো, সেদ্ধ করা, ঢেকিতে বাড়া বাঁধা এসব ঘর গৃহস্থালির কাজে ঝি বৌদের হাতে হাত মিলিয়ে সাহায্য করে। বিনিময়ে তারা কিছু ধান চাল পায় কখনো বা এক সানকী ভাতও জুটে যায় বৈকি ।

ছোট মেয়ের শাশুড়ী একটু কৃপন স্বভাবের, তার এসব পছন্দ নয় । আসলে এক সময় অনেক কষ্ট করেছে তাই এটা তার কাছে অপচয় । “ধান-চাল দিয়াই যদি কাজ করাইতে হয় তবে পুতের বিয়া দিছি ক্যান” ? গজ গজ করতে থাকে ঘরের ভেতর রহিমার শাশুড়ী?

মাঝে মাঝে ছোট ছেলেটিকে কোলে নিয়ে মায়ের কাছে ঘন্টা খানেকের জন্য বেড়াতে আসে রহিমা, এসব কথা বলে দুঃখ করে। মায়মুনা বিবি তিন বছরের নাতির হাতে একটি মুড়ির মোয়া ধরিয়ে দিতে দিতে মেয়েকে সান্তনা দেয়,
‘সবুর কর মা, সবুর কর, সবুর যারা করে তাগো আল্লাহও পছন্দ করে। তাছাড়া জামাইতো ভালো মানুষ, হ্যয়তো আর তরে মাইর ধইর করেনা বইল্যাই জানি’।
মা এর কথায় চুপ করে যায় রহিমা । এটা সত্যি জরিনার বাপ তারে অনেক সোহাগ করে। হাটে গেলেই তার জন্য লুকায় লুকায় এইডা ঐডা কিন্না আনে। মায়ের স্বভাবটা বোঝে কিন্ত কিছু বলতে পারে না। হাজার হইলেও তো তার মা।

বাইরে এখনো অন্ধকার,ফর্সা হয়নি, মাদুরে পা ছড়িয়ে বসে গুড় মুড়ি খেতে খেতে মায়মুনা বিবির মন সুদুর অতীতে চলে যায়। মনে পড়ে একটা ছেলের জন্য তারা স্বামী- স্ত্রী আল্লাহর কাছে কত যে আহাজারি করেছে তার হিসাব নেই। আল্লাহ মায়মুনা বিবি আর তার স্বামীর মনের আশা পুরন করে নাই। মুন্সী বৌকে স্বান্তনা দিয়ে বলতো,
“পোলা নাই বইলা কান্দিস না বৌ, এইডা আল্লাহর হুকুম, মনে রাখিস তাঁর হুকুম ছাড়া গাছের পাতাডাও লড়ে না”।

স্বামী মারা যাবার পর থেকে একলাই থাকে নিজের এই বাড়ীতে। ছেলে থাকলে বৌ আর নাতি-নাতকুড় নিয়ে তার বাড়ী এখন ভর-ভরন্ত থাকতো। জমিগুলোও আর অন্য মানুষকে বর্গা দেয়া লাগতো না, ছেলে নিজেই হালটি কাজ করতো আর সবার মত। যা হওয়ার না তা নিয়ে আর চিন্তা করতে চায়না সে, দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠে পরে মায়মুনা বিবি ।

মেইল দেড়েক দূরে স্টেশনের কাছে থাকা বাসা বাড়ী থেকে ভোর সকালে পাঁচ ছটি ছেলে মেয়ে তার কাছে আরবী পড়তে আসে । অবস্থাপন্ন মানুষের ছেলে মেয়ে হলে কি হবে গাঁয়ের মানুষ মায়মুনা বিবিকে তারা খুব ভালোবাসে, নানী বলে ডাকে। ছোটগুলো তো মাঝে মাঝে তার কোলে উঠে বসে থাকে। সেও তাদের নিজের নাতি নাতনীর মতই আদর করে ।

মাটির কলস থেকে টিনের ঘটিতে পানি ঢেলে খেয়ে নেয় এক চুমুকে। এরপর সুন্দর করে লেপা মাটির বারান্দায় খেজুর পাতার বড় পাটিটা বিছিয়ে দেয়।তখনো চারিদিক কুয়াশায় ঘেরা, সুর্য্যের এখনো দেখা নাই। কিন্ত কাওসার, তারেকদের আসার সময় হয়ে গেছে প্রায়। তার কাছে ছিপারা পড়তে আসে ওরা।

মাঝখানে সরু মাটির রাস্তা আর তার দুদিকে নাবাল জমি জুড়ে সবুজ ধানের মাঠ। সেই চিকন মাটির পথের দুধারে আশ শ্যাওড়া আর কাল কাসুন্দের ঝোপ । সেই পথ নাকি চলে গেছে দূরে বহু দূরে । বুকে কায়দা/আমপারা নিয়ে মেঠো পথ ধরে হেটে চলেছে গুটি কয়েক ছেলে মেয়ে মায়মুনা বিবির বাড়ীর উদ্দেশ্যে।

খোলা মাঠে শীত যেন আরো জেঁকে বসেছে আর সে কাঁপুনীতে দাতে দাত লেগে ঠক ঠক করে আওয়াজ হচ্ছে। এরপর ও সেই কুয়াশার মিহি চাদর ঠেলে এগিয়ে চলেছে তারা । কত বার তারা নানীকে অনুরোধ করেছে আরেকটু বেলা করে পড়ানোর জন্য । নানী রাজী হয়না বলে,
“বুঝলা নাতি এই বিয়ান বেলা ছিপারা পড়লে বেশী সোয়াব হয়। আর সোয়াব বেশী হইলেই তো তোমরা এক্কেবারে বেহেস্তে যাইতে পারবা”। বেহেস্তে যে কত সুখ তার বিবরণ সে তুলে ধরে মাঝে মাঝে ওদের কাছে।

সেই বেহেস্তে যাবার আশাতেই হোক আর তাদের বাবা মাকেও টলাতে না পেরেই হোক চুপ থাকে তারা। তাছাড়া নয়টা থেকে সবার স্কুল ও আছে ।

এই দলের মাঝে শুধু বয়স আর সৌন্দর্য্যেই নয় শরীর স্বাস্থ্যেও সবার চেয়ে বড়সর কাওসার তার দু বছরের পুরনো সোয়েটারটা একটু টেনে টুনে দেয়। হাতাটা একটু ছোট হয়ে গেছে। সস্তার ঊলে তৈরী খয়েরী রঙ এর এই হাল্কা সোয়েটারে শীত মানে না, জায়গায় জায়গায় জমে গেছে। মাকে বলেছে একটা নতুন সোয়েটার যেন বানিয়ে দেয়। কিন্ত আট ভাই বোনের সংসার রোজগেরে বলতে রেলওয়ের চতুর্থ শ্রেনীর কর্মচারী বাবা। তাদের জন্য বছর বছর নতুন সোয়েটার চুড়ান্ত বিলাসিতা ।

মাথার ওড়নাটা টানতে গিয়ে কাওসারের চোখ পড়ে তুলির দিকে। হলদের উপর লাল ফুল ফুল ডিজাইন করা সোয়েটার পড়া তুলির পায়ে চামড়ার স্যন্ডেল। দ্রুত নিজের আধ ক্ষয়ে যাওয়া স্পঞ্জের স্যন্ডেলের দিকে চোখ চলে যায় কাওসারের। দীর্ঘঃশ্বাস বেড়িয়ে আসে বুক চিড়ে, কবে কবে একটু স্বচ্ছল জীবন হবে তাদের ! এত টানাটানি আর ভালোলাগে না ?

ভাবতে ভাবতেই নানীর বাড়ীর সামনে চলে আসে তারা । মাদার গাছ এর বেড়া দেয়া নানীর বাড়ীতে গেটের বালাই নেই । হেলে পরা বাঁশ বাখারির আগড় ঠেলে হৈ হল্লা করতে করতে সামনের উঠোনে এসে দাঁড়ায় ছেলে পুলের দল । তাদের গলার আওয়াজ পেয়ে মায়মুনা বিবিও বেড়িয়ে আসে ঘর থেকে,
“ আইছো নি ? যাও যাও জলদি জলদি পুকুর থিকা ওজু কইরা আসো” ।
“ ওজু করা লাগবো না, বাসা থিকা ওজু কইরা আসছি নানী” বছর নয়েকের আবু শীতে কাপতে কাপতে আবাদারের গলায় বলে ঊঠে।
“না না ঐ ওজুতে হইবো না , রাস্তা ঘাটে কত শিয়াল কুত্তার গু পাড়াইয়া আইছো”।
বাধ্য ছেলে মেয়ের মত ওরা লাইন দিয়ে পুকুর ঘাটের দিকে এগিয়ে যায় ।

কোরান শরীফ পড়া শেষে দৌড়ে বাসায় আসে কাওসার । ছোট ছোট ভাইবোনগুলোকে হাত মুখ ধুইয়ে দেয়। প্রতিবছরই তার নতুন নতুন ভাই বোন আসে আর সংসারের অভাবও বেড়ে চলে। তুলিদের কথা মনে পড়ে, সামনের বাসায়ই তিন ছেলে মেয়ে নিয়ে তুলির বাবা মা এর সুখের সংসার। ওর বাবা খুব সৌখিন মানুষ। ঘরে কি সুন্দর কারুকাজ করা খাট। কাওসারদের মত ঘর জোড়া চৌকি না। আর খাবার জন্য কি সুন্দর টেবিল তার মাঝখানে পিতলের ফুলদানীতে প্লাস্টিকের গোলাপ সাজানো। তুলিদের বাসায় গিয়ে বসে থাকতেও ভালো লাগে কাওসারের।

যেদিন প্রথম তুলির বাবা রেডিও কিনে এনেছিল ওরা সবাই গিয়েছিল। ঐ সময় একটা গান বাজছিল গায়িকার নামটা পরিস্কার মনে আছে কাওসারের। নাম ফেরদৌসী বেগম। কাওসার খুব গান পছন্দ করে। নিজে গাইতেও পারে দু একটা গান। তাই বলে তাদের বাসায় রেডিও কিনার কথা স্বপ্নেও ভাবে না সে ।

তুলির মা ও খুব ভালোমানুষ, একটুও অহংকারী নয়, কাজ না থাকলে ওর সাথে অনেক গল্প করে। ওর মা ভাই বোনদের কথা জিজ্ঞেস করে। সময় পেলে ওদের বাসায় বেড়াতে আসে। সারাদিন রান্না ঘরে থাকা আধ ময়লা শাড়ী পরা কাউসারের মা্যের সাথে রান্নাঘরের সামনেই মোড়ায় বসে গল্প করে পান খায়। ওর তিন নম্বর বোনের নামও রেখেছিল খালাম্মা। মাঝে মাঝে কাওসারের লজ্জা করে তাদের দারিদ্রতার জন্য।

দুমাস পর পনের বছরে পা দেবে কাওসার, এখন সে ক্লাশ সিক্সে পড়ে। পড়াশোনাতেও সে অনেক ভালো। প্রতিবছর ক্লাশে প্রথম হয়। পুকুরে গোসল করে ভাত খেয়ে ওরা কয়েকজন দল বেধে স্কুলের দিকে রওনা হয়। হাসি খুশী কাওসার আপাকে ছোট ছোট ছেলে মেয়েরা অনেক পছন্দ করে। একসাথে স্কুলে যাবে বলে সবাই অপেক্ষা করে। বুনো জঙ্গলের মাঝে লাল লাল থোপায় ফুটে থাকা অশোক আর চালতে গাছের পাশ দিয়ে হেটে যায় ওরা, মাটির সেই পথের দুপাশে ফুটে থাকে গাঢ় সবুজ পাতার মাঝে গোছা ধরা সাদা সাদা ভাঁটফুল।

এরই মধ্যে কত যুবকের নজর কাওসার আপার দিকে। আপাকে উদ্দেশ্য করে কথাবার্তা আর হাসি ঠাট্টায় আপার প্রশ্রয় দেখে দশ বছরের তুলি অবাক হয়ে যায়। ছেলেগুলোর উপর আপা রাগতো হয়ই না আরো উলটো হাসে। পাড়ার বড় বড় মেয়েরা আপাকে নিয়ে বাজে বাজে কথা বলে । পুরোটা না বুঝলেও কিছুতো বুঝে আর তা শুনে তুলির অনেক খারাপ লাগে।

কাওসার আপা কি সুন্দর দেখতে, ফর্সা গায়ের রঙ, চোখের মনিগুলো তুলিদের মত কালো নয়, কেমন যেন কটা কটা , অনেকটা ছবিতে দেখা মেম সাহেবদের মত লাগে। লালচে লম্বা চুলগুলো নকশী শাড়ির ছেড়া পাড় দিয়ে সব সময় দুটো বেনী বেধে রাখে। সবাই বলে আপার নাকি ভারী মিষ্টি গলা, হয়তো তারা ঠিকই বলে তুলি মনে মনে ভাবে। নাহলে এত সুন্দর গান গাইতে পারতো!স্কুল থেকে ফেরার পথে মাঝে মাঝে ওদের গান গেয়ে শোনায়। শুধু গানই নয় সুন্দর নাচতেও পারে কাওসার আপা। তুলির মনে আছে একবার কি একটা অনুষ্ঠানে আপা নেচেছিল মোমেরও পুতুল মোমের দেশের মেয়ে গানটার সাথে। সাজগোজ করা আপাকে সেদিন মোমের পুতুলের মতই লেগেছিল।

আজ কদিন হলো কাওসার আপা আর তুলিদের বাসায় আসে না। স্কুলেও যায় না।আপাকে তুলি অনেক ভালোবাসে। কিন্ত মা এর কাছে শুনেছে ওর আব্বার সাথে তুলির আব্বার কি জানি হয়েছে। কাওসার আপার আব্বা আমাদের নিষেধ করে দিয়েছে তাদের বাসায় যেতে । এটা শোনার পর তুলিরা আর কেউ ভয়ে ঐ বাসায় যায় না । কিন্ত তুলির খুব ইচ্ছে করে কাউসার আপার কাছে যেতে।

আজ স্কুল ছুটি ছিল। তুলি এতক্ষন পারভীনের বাসায় ওর সাথে রান্নাবাটি খেলে বাসায় ফিরছে। গেট দিয়ে ঢুকতেই ডান দিকে লম্বামত একটা টিনের ঘরের দুটি রুম নিয়ে কাওসার আপারা থাকে। নিজেদের বাসার দিকে এক পা এগুতেই কাওসার আপার চাপা গলার ডাকে তুলি চমকে তাকায়। “এই তুলি এদিকে আয় না”। তাকিয়ে দেখে জানালা ধরে কাওসার আপা হাসি হাসি মুখে চেয়ে আছে। তুলি চুপি চুপি এগিয়ে যায়।

“কি ব্যপার আপা তুমি আর আমাদের সাথে স্কুলেও যাওনা, আরবী পড়তেও যাওনা কি হয়েছে তোমার” ?
‘কি করে যাবো বল ? দেখনা আমায় বেঁধে রেখেছে ওরা’ ।
“বেধে রেখেছে”? হতভম্ব তুলি জানালার শিক ধরে পায়ের আঙ্গুলের উপর ভর দিয়ে ঘরের ভেতরটা দেখতে চেষ্টা করে। সত্যি একটি মোটা পাটের দড়ি দিয়ে তার এক পা বেঁধে রাখা আছে ঘরের খুটির সাথে। কাঁধ পর্যন্ত এবড়ো খেবড়ো করে কাটা মাথার চুলের সাথে একটা তাবিজ বেনী করে বাঁধা। কাওসার আপাকে কেমন অন্য রকম লাগছিল দেখতে।
‘বুঝলি আমার উপর নাকি জ্বীনের আছর আছে’ সুন্দর মুখে বড় বড় চোখ নিয়ে করুন গলায় বলে উঠে কাওসার আপা।
“জ্বীনের আছর কি আপা”! অদ্ভুত এই নতুন কথাটি শুনে তুলি অবাক হয়ে যায় ।
‘যা তুই একটা আস্ত গাধা , জীনের আছরও বুঝিস না’! খিল খিল করা অপার্থিব এক হাসিতে ভেঙ্গে যেন লুটিয়ে পড়ে কাওসার আপা, সেই হাসির দমকের সাথে সাথে তার শরীরটাও যেন দুমড়ে মুচড়ে উঠে। ঘোলাটে হয়ে আসা কটা চোখের তারায় ফুটে ওঠে এক বন্য চাহনী ।

“কিরে কাওসার কার সাথে কথা কস” ? দরজার দিকে এগিয়ে আসা মায়ের ডাকে ভীত কাওসার বিছানায় বসে পড়ে, আর তুলিও টুপ করে নীচু হয়ে জানালার কাছ থেকে সরে যায়। বুকটা কেমন ঢিপ ঢিপ করতে থাকে তুলির।

তাড়াতাড়ি বাসায় এসে দেখে বাবা অফিসে চলে গেছে আর মা রান্না ঘরে লম্বা বুড়ির সাথে কি নিয়ে জানি কথা বলছে। লম্বা বুড়ি আগে ওদের বাসায় কাজ করতো মাসখানেক হলো এক বুড়োকে বিয়ে করে সংসার পেতেছে।
“কি এতক্ষনে বাসায় ফেরার সময় হলো আপনার? ছিলেন কোথায়”? তুলি আস্তে আস্তে দম নিয়ে কাওসার আপার কথা বল্লো। শুনে মা গম্ভীর হয়ে বল্লো আর কখনো যেওনা অমন করে।

রাতে পড়তে বসে তুলি শুনলো মা বাবাকে বলছে, ‘বুঝলে তুলির বাবা, কাওসারের বাবা জামান সাহেব মানুষ না, ডাক্তার কবিরাজ না দেখিয়ে এমন সুন্দর মেয়েটাকে মেরে ধরে দড়ি দিয়ে বেঁধে রেখে পাগল বানিয়ে ছাড়বে একদিন’।
বাবা চুপ করে থেকে একটু পরে বল্লো ‘এ রোগের নাম হিস্টিরিয়া, চিকিৎসা করলেই ভালো হতো কিন্ত ওর ঐ বজ্জাত বাবাকে কে বলতে যাবে’।
তুলির বাবা মা দুজনাই চুপ করে যায়।

স্কুলে পরীক্ষা থাকায় কদিন আর আরবী পড়তে যাওয়া হয়নি তুলির। পরীক্ষার পর প্রথম যেদিন সবার সাথে তুলি সেই সবুজ ধান ক্ষেত পেরিয়ে কায়দা পড়তে গেলো, সেদিন নানীও ওর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে ‘কিরে নাতনী কাউসার আর আসবো না’।
“নানী ওকে নাকি জ্বিনে ধরেছে” তুলি বলে উঠে।

“হইতেও পারে, মাইয়াডা যেমন ডবকা আর সুন্দর দেখতে হইছিলো। এই সব মাইয়াগো উপরেই তো খারাপ জ্বীনেরা কুনজর দেয়, আপসোস কোরান শরীফ পুরাডা শেষ করতে পারলো না।, দশ পারা পর্যন্ত পড়ছিল”।

লাল টুকটুকে ঠোটের কষ বেয়ে গড়িয়ে পড়া পানের রস আঁচল দিয়ে মুছতে মুছতে মায়মুনা বিবি বলে উঠে “কিরে তরা পড়া থামালি ক্যান । ঐ আবু জোরে জোরে পড় আলিফ যবর আ, বে যবর বা” ……
সমাপ্ত

ছবিটি নেট থেকে


সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই এপ্রিল, ২০১৬ সকাল ১১:০৩
৬১টি মন্তব্য ৬০টি উত্তর পূর্বের ৫০টি মন্তব্য দেখুন

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

=বেনারসী রঙে সাজিয়ে দিলাম চায়ের আসর=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২২ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৫২



©কাজী ফাতেমা ছবি
মনে কি পড়ে সেই স্মৃতিময় সময়, সেই লাজুক লাজুক দিন,
যেদিন তুমি আমি ভেবেছিলাম এ আমাদের সুদিন,
আহা খয়েরী চা রঙা টিপ কপালে, বউ সাজানো ক্ষণ,
এমন রঙবাহারী আসর,সাজিয়েছি... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিজ্ঞানময় গ্রন্থ!

লিখেছেন জ্যাক স্মিথ, ২২ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:৪২

একটু আগে জনৈক ব্লগারের একটি পোস্টে কমেন্ট করেছিলাম, কমেন্ট করার পর দেখি বেশ বড় একটি কমেন্ট হয়ে গেছে, তাই ভাবলাম জনস্বার্থে কমেন্ট'টি পোস্ট আকারে শেয়ার করি :-P । তাছাড়া বেশ... ...বাকিটুকু পড়ুন

অস্ট্রেলিয়ার গল্প ২০২৪-৪

লিখেছেন শায়মা, ২২ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৩:৪৫


চলে যাবার দিন ঘনিয়ে আসছিলো। ফুরিয়ে আসছিলো ছুটি। ছোট থেকেই দুদিনের জন্য কোথাও গেলেও ফিরে আসার সময় মানে বিদায় বেলা আমার কাছে বড়ই বেদনাদায়ক। সেদিন চ্যাটসউডের স্ট্রিট ফুড... ...বাকিটুকু পড়ুন

আপনি কি বেদ, উপনিষদ, পুরাণ, ঋগ্বেদ এর তত্ত্ব বিশ্বাস করেন?

লিখেছেন শেরজা তপন, ২২ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:৫২


ব্লগে কেন বারবার কোরআন ও ইসলামকে টেনে আনা হয়? আর এই ধর্ম বিশ্বাসকে নিয়েই তর্ক বিতর্কে জড়িয়ে পড়ে সবাই? অন্য ধর্ম কেন ব্লগে তেমন আলোচনা হয় না? আমাদের ভারত... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমার ‘অন্তরবাসিনী’ উপন্যাসের নায়িকাকে একদিন দেখতে গেলাম

লিখেছেন সোনাবীজ; অথবা ধুলোবালিছাই, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১:২৫

যে মেয়েকে নিয়ে ‘অন্তরবাসিনী’ উপন্যাসটি লিখেছিলাম, তার নাম ভুলে গেছি। এ গল্প শেষ করার আগে তার নাম মনে পড়বে কিনা জানি না। গল্পের খাতিরে ওর নাম ‘অ’ ধরে নিচ্ছি।

... ...বাকিটুকু পড়ুন

×