শাহ সুজা
তাজমহল এক সমাধি সৌধ, শ্বেত পাথরের উপর দামী রত্ন খচিত পৃথিবীর এই বিস্ময়কর স্থাপত্যটির অতুলনীয় নির্মানশৈলীর জন্য পৃথিবীর সপ্তম আশ্চর্য্যের অন্যতম এক আশ্চর্য্য হিসেবে চিনহিত । তাজমহলকে ঘিরে রচিত হয়েছে অসংখ্য কবিতা, গান আর ছায়াছবি। তাকে সামনাসামনি এক নজর দেখার দুর্নিবার আকর্ষনে আজও সারা পৃথিবীর রাজা বাদশাহ থেকে শুরু করে সব শ্রেনীর মানুষই ছুটে ছুটে আসে।
আগ্রা নগরীর মাঝে বয়ে যাওয়া স্রোতস্বীনি যমুনা তীরের এই সৌধটি ছিল প্রিয়তমা পত্নীর বিয়োগ ব্যাথায় ব্যথাতুর এক সম্রাটের অর্ঘ্য নিবেদন। সে ছিলেন মুঘল বংশের পঞ্চম বাদশাহ সম্রাট শাহজাহান। আর সমাধিটি তাঁরই অকাল প্রয়াত স্ত্রী আর্জুমান্দ বানু বেগমের। রাজকীয় উপাধী মুমতাজ মহল নামেই যিনি ইতিহাসে সমাধিক পরিচিত।
এই সেই তাজমহল যার মর্মরে গাঁথা কবির অশ্রুজল, পৃথিবীর এক বিস্ময়
সম্রাট শাহজাহান এবং মুমতাজ মহলের গর্ভে জন্ম নেয়া চৌদ্দটি সন্তানের মাঝে তাঁর চার সন্তান মুঘল সিংহাসনের দাবীতে যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে লিপ্ত হয়েছিল তা ইতিহাসের এক কলংকময় অধ্যায়। পরস্পর যুদ্ধ ও রক্তপাতে সেই বিশাল সাম্রাজ্যের অলি গলিই শুধু নয় তাদের পিতা নির্মিত তাজমহলের শ্বেত শুভ্র রঙও যেন রক্তিম বর্নের হয়ে উঠেছিল।
সেই চার ভাই ছিলেন যথাক্রমে শিল্প ও সংস্কৃতির অনুরাগী, প্রপিতামহ আকবরের মতই উদার ধর্মাবল্মবী বড় ভাই দারাশিকোহ, পিতা ও পিতামহ সম্রাট জাহাংগীরের নয়নের মনি নাম তার শাহ সুজা, ন্যায়পরায়ন, নিষ্ঠুর ও একই সাথে দ্বৈত চরিত্রের অধিকারী সম্রাট আওরংজেব এবং ছোট ভাই বলখের সুবাদার মুরাদ বক্স ।
১৬৫৭ খৃষ্টাব্দে সম্রাট শাহজাহান যখন বার্ধক্যে উপনীত হলেন সাথে ছিল বিভিন্ন অসুস্থতাও তখন তৃতীয় পুত্র দাক্ষিনাত্যের সুবাদারর আওরংজেব নিজেকে সম্রাট হিসেবে ঘোষনা করলেন। সম্রাট শাহজাহান আগেই তার প্রিয় পুত্র দারাশিকোকে উত্তরাধিকারী হিসেবে মনোনীত করে রেখেছিলেন। কিন্ত এটা তাঁর বাকি তিন ছেলে মনে মনে মেনে নিতে পারেনি। ফলে আওরংজেবের সাথে তার দ্বিতীয় পুত্র বাংলা বিহারের সুবেদার শাহ সুজাও নিজেকে মুঘল সিঙ্ঘাসনের অন্যতম দাবীদার হিসেবে ঘোষনা করেন। চতুর্থ পুত্র মুরাদ বক্স এই দাবী জানিয়ে প্রথমেই আওরংজেবের হাতে পরাজিত হয়ে তার হাতের পুতুলে পরিনত হন যাকে আওরংজেব পরে হত্যা করেন।
১৬৫৮ সনে শাহ সুজা সিংহাসনের বসার পথ পরিস্কারের জন্য সিংহাসনের অন্যতম দাবীদার বড় ভাই দারাশিকোর বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ন হন। কিন্ত সেই যুদ্ধে পরাজিত হয়ে তিনি বাংলা বিহার উড়িষ্যার একটি বিশাল অংশের শাসনভার দারাশিকোহর হাতে অর্পন করে তার সাথে এক মিত্র চুক্তিতে আবদ্ধ হন। এর পরই আওরংজেব পর পর দুটি যুদ্ধে দারাশিকোকে পরাজিত করেন। পলায়নপর দারাশিকোকে এক সময়ে তারই অনুগৃহিত বিশ্বাসঘাতক এক আফগান দলপতি মুঘল সৈন্যদের হাতে ধরিয়ে দিলে শিরোচ্ছেদের মাধ্যমে তাঁর মৃত্যু নিশ্চিত করেন আওরংজেব।
মুঘলদের সময়কার বিখ্যাত মিনিয়েচার পেইন্টিং এ ঘোড়ায় আরোহী তিন ভাই বাঁ থেকে যথাক্রমে শাহ সুজা, আওরংজেব ও মুরাদ
ভেনিসের বিখ্যাত পর্যটক মানুচ্চি্র লেখা থেকে জানা যায় আগ্রা দুর্গে গৃহবন্দী পিতা শাহজাহানের খাবারের সময় লোক মারফত লাল মখমলে ঢাকা সোনার থালা পাঠিয়ে আওরঙ্গজেব বলেছিলেন "তোমরা গিয়ে বলো আওরংজেব তাঁর পিতাকে ভুলে যায় নি”। ছেলে যে তাকে ভুলে যায়নি ভেবে খুশীতে সেই লাল মখমলের কাপড় সরিয়ে বড় আদরের পুত্র দারাশিকোহর কাঁটা মাথাটি দেখে সেদিন সম্রাট জ্ঞ্যান হারিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পরেন ।
ইতিহাসে পড়েছি সম্রাট আওরঙ্গজেব নাকি ব্যাক্তি হিসেবে ভীষন ন্যায়পরায়ন ছিলেন, রাজকীয় কোষাগার থেকে একটি পয়সাও না নিয়ে কোরান শরীফ লিখে সংসারের ব্যয় নির্বাহ করতেন,নিজ হাতে কাপড় সেলাই করে পরতেন। আর পুত্রকে শিক্ষকের পা ধুয়ে দিতে বলেছিলেন। কিন্ত ক্ষমতার লোভে আপন তিন ভাই সহ অসংখ্য মানুষের রক্তে হলিখেলা সহ পিতা ও বোন জাহানারার সাথে তার নিষ্ঠুর আচরন আমার কাছে পরস্পর বিরোধী বলেই মনে হয়। আশাকরি এ ব্যাপারে যদি কারো কিছু জানা থাকে তবে অবশ্যই শেয়ার করার অনুরোধ রইলো। তাঁর দীর্ঘ উনপঞ্চাশ বছরের রাজত্বকালের পর থেকেই মুঘল সাম্রাজ্যের পতন শুরু হয়।
আজ আমার লেখা কিন্ত শাহ সুজাকে নিয়ে।আসল লেখায় আসতে গিয়ে বেশ বড় একটা ভুমিকাই দিতে হলো পাঠকদের সুবিধার জন্য ।
বড় ভাই দারাশিকোর মৃত্যুর পর শাহ সুজা এবার তার সৈন্যবাহিনী নিয়ে আওরংজেবের বিরুদ্ধে যুদ্ধের উদ্দেশ্যে বাংলা থেকে দিল্লীর উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করেন। ১৬৫৯ সনের ৫ই জানুয়ারী উত্তর প্রদেশের ফতেহপুরে দু ভাইয়ের মোকাবেলা হলো। শাহ সুজা আওরংজেবের হাতে পরাজিত হয়ে বাংলায় ফিরে গিয়েও রেহাই পেলোনা। আওরংজেবের নির্দেশে বাংলার নতুন সুবেদার মুঘল সেনাপতি মীর জুমলা শাহ সুজার পিছু ধাওয়া করতে থাকেন তাঁর। কঠোর প্রতিরোধ গড়ে তুলেও মুঘল সৈন্যদের বিরুদ্ধে শাহ সুজা ১৬৬০ খৃস্টাব্দে শেষবারের মত পরাজিত হন আর সেই সাথে ইতি ঘটে তাঁর দিল্লীর সিংহাসনে বসার স্বপ্নের।
প্রতিটি যুদ্ধের পরই শাহ সুজা তার ভেঙ্গে পড়া সৈন্যদলকে নতুন করে সাজিয়ে তুলতেন। কিন্ত শেষ যুদ্ধের পর তিনি বুঝেছিলেন তাঁর পক্ষে সৈন্য বাহিনী সাজিয়ে তোলা আর সম্ভব নয়। ভেঙ্গে যাওয়া হৃদয় নিয়ে সম্রাট পুত্র সব দিক ভেবে চিন্তে আরাকান রাজের আমন্ত্রনে সেদেশে আশ্রয় নেয়ার সিদ্ধান্ত নেন। সে সময় আরাকানের রাজা ছিলেন বৌদ্ধধর্মের অনুসারী Sanda Thudama । খানিকটা শান্তি আর নিরিবিলি জীবনের আশায় আরাকান যাওয়াই ছিল শাহ সুজার জীবনের এক চরম ভ্রান্তিজনক অধ্যায়।
পরিবারের সদস্য ও অনুগত কিছু সৈন্য সামন্ত, সেই সাথে প্রচুর সোনা, রূপা, হীরা জহরত সহ অস্ত্র শস্ত্র নিয়ে শাহ সুজা নদীপথে হাজির হলেন বর্তমানের চিটাগাং নগরীতে। সেখানে কিছুদিন অবস্থানের পর তিনি স্থলপথে আরাকানের উদ্দেশ্যে রওনা হন। যে পথে তিনি আরাকান যাত্রা করেছিলেন সে পথটির নাম এখনো সুজা রোড। সেই যাত্রা পথে পবিত্র ঈদের দিন পরায় এক জায়গায় থেমে তিনি ঈদের নামাজ পরেছিলেন। কক্সবাজার যাবার পথে বর্তমান দুলাহাজরার সেই স্থানটি সেই স্মৃতির স্মরণে আজও ঈদগাহ নামেই পরিচিত ।
বিচলিত চিত্ত শাহ সুজা স্থলপথে তেরো দিন, তেরো রাত চলার পর নাফ নদীর পুর্ব পাড়ে মংডু নগরীর আধা কিলোমিটার দূরে এসে থামলেন। স্থানীয় লোকজন বর্তমান এই গ্রামটিকে এখনো সুজা গ্রাম নামেই ডেকে থাকে।
১৬৬০ এর ৫ই জুন থেকে ২৬ শে অগাষ্ট এই দীর্ঘ যাত্রার শেষদিনটিতে তিনি স্থলপথ ত্যাগ করে সমুদ্র পথে আরাকানের রাজধানীতে উপনীত হলেন। আরাকান রাজ প্রতিনিধি পাঠিয়ে তাদের রাজকীয় অতিথিদের বরন করে নিলেন বটে তবে প্রথমেই শর্ত দিলেন তাদেরকে সকল অস্ত্র শস্ত্র জমা দিতে হবে। রাজপ্রাসাদের অদুরে তাদের জন্য তৈরী আলাদা প্রাসাদে পরিবার পরিজন আর তার সহযাত্রীদের নিয়ে উঠলেন শাহ সুজা।
বিশিষ্ট ইংরেজ স্থাপত্য ও ইতিহাসবিদ জন হার্ভে যিনি শাহ সুজার উপর বই লিখেছিলেন। তার লেখা থেকে জানা যায় শাহ সুজার আরাকানে আসার একটি বড় কারন ছিল পবিত্র মক্কা শারীফ যাওয়া ও সেখানেই তাঁর জীবন কাটিয়ে দেয়া। নিজস্ব সমুদ্রগামী জাহাজ বহরে রাজকীয় অতিথির শেষ ইচ্ছা পুরন করবেন বলে ইতিমধ্যে ধুর্ত আরাকান রাজ প্রতিশ্রুতিও দিয়েছিলেন।
হার্ভের মতে শাহ সুজা যখন সেই হাতী ঘোড়া বোঝাই বিশাল ধন সম্পদের পাহাড় নিয়ে আরাকান উপস্থিত হলেন তখন তা দেখে লোভী বর্মী রাজ তার সব প্রতিশ্রুতি ভুলে গেল। শুধু ধন সম্পত্তি লুট করে নেয়াই নয়, লম্পট রাজ Sanda Thudama শাহা সুজার অপরূপ সুন্দরী কন্যা বিবাহিতা গুলরুখকে দেখেই তাকে ভোগ করার জন্য উম্মাদ হয়ে ওঠে।
চরম বিশ্বাসঘাতক আরাকান রাজ এই লক্ষ্যে এগিয়ে আসলে অস্ত্র-সস্ত্রহীন শাহ সুজা ও তাঁর দলবল নিজেদের নিয়ন্ত্রন করতে ব্যার্থ হয়। যার ফলশ্রুতিতে তারা আরাকান রাজপ্রাসাদ আক্রমন করে আগুন লাগিয়ে দিতে ব্যার্থ চেষ্টা করে । প্রতি উত্তরে আরাকান রাজ তার নিরস্ত্র অতিথিদের উপর ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ চালায়। সময় ছিল ১৬৬০ সনের ডিসেম্বর। সেদিনও আরাকানের মাটি আশ্রিতদের রক্তে ভিজে উঠেছিল যেমন আজও উঠছে সেখানে যুগ যুগ ধরে বাস করে আসা রোহিঙ্গাদের রক্তে।
শাহ সুজার মৃত্যুর দিন তারিখ নিয়ে ঐতিহাসিকদের মাঝে কিছুটা মতভেদ আছে। কারো কারো মতে আরাকান রাজের হাতে সেদিনই শাহ সুজার মৃত্যু হয়েছিল, আবার কারো মতে রাজধানীর বাইরে ম্রহং এলাকার জঙ্গলে পরিবার পরিজন নিয়ে পালিয়ে থাকা শাহ সুজাকে ১৬৬১ সনের ৭ই ফেব্রুয়ারী হত্যা করেছিল আরাকান সৈন্যরা। শাহ সুজার তিন ছেলেকে বন্দী করে নিয়ে পরে মাথা কেটে হত্যা করা হয়েছিল মুঘল ইতিহাসের সেই নিষ্ঠুরতম দিনেই লম্পট আরাকান রাজের লালসার শিকার হয়েছিল মুঘল সুবাদারের প্রিয় কন্যা গোলাপ সুন্দরী গুলরূখ বানু বেগম। সেই অপমান সহ্য করতে না পেরে আত্নহত্যার পথ বেছে নিয়েছিল ধর্ষিতা গুলরূখ।
মুঘল সিংহাসনের প্রতি লোভের এক চরম মুল্য দিয়েছিলেন সম্রাট শাহজানের চার পুত্র।
তবে আরেকটি সুত্র মতে শাহ সুজা সেদিন আরাকানে মারা যান নি। প্রচুর স্বর্নালংকারের বিনিময়ে পর্তুগীজ জলদস্যুদের সহায়তায় শাহ সুজা তাঁর অবশিষ্ট পরিবার পরিজন নিয়ে ১৬৬১ সনের ১৬ ই মে বর্তমান ভারতের ত্রিপুরায় পালিয়ে যান । সেখান থেকে সেই বছর ডিসেম্বর মাসেই তিনি মনিপুর রাজার আশ্রয় গ্রহন করেন। এই ঘোরতর বিপদের সময় স্বাধীন রাজ্য ত্রিপুরা এবং মনিপুর রাজারা তাঁকে সর্বাত্মক সহায়তা করেছিলেন। কারন তারাও আওরংজেবের রাজ্যজয়ে আক্রমনাত্নক এক ভুমিকায় শংকিত ও উদবিগ্ন ছিল।
আওরংজেবের গোয়েন্দা বাহিনী শাহ সুজা সম্পর্কে খবর জানার জন্য হন্যে হয়ে ওঠেছিল এবং সেই লক্ষ্যে ঐ অঞ্চল চষে ফিরেছিল। একটি সুত্র মতে তাদের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্যই শাহ সুজা আরাকানেই মারা গেছেন বলে প্রচার করা হয়। দীর্ঘ পথ ছুটে ছুটে ক্লান্ত বিদ্ধস্ত এবং ভাগ্যের হাতে চরম বিপর্যস্ত শাহ সুজা লোক চক্ষুর অন্তরালে খুব সাধারন এক সন্তের জীবন কাটিয়ে গেছেন মনিপুর রাজ্যে। আবার কারো মতে তিনি নিজ পরিচয় গোপন করে শেষ পর্যন্ত মক্কা শরীফেই চলে যান এবং সেখানেই তাঁর মৃত্যু হয় । তাঁর শেষ জীবন ও করুন মৃত্যু নিয়ে একাধিক কাহিনী প্রচলিত রয়েছে যার সমাধান আজো হয়নি।
তবে ইতিহাসের পাতায় পাতায় কান পাতলে শোনা যায় অতিথির প্রতি আশ্রয়দাতা আরাকান রাজের চরম বিশ্বাসঘাতকতার এক ঘৃন্য কাহিনী যার ধারা আজও অব্যাহত আছে তাদের আচারে-ব্যাবহারে আর সংস্কৃতিতে।
ছবিঃ নেট