মনে আছে আব্বার বদলীর সুত্রে ঢাকা থেকে সীতাকুন্ডে যখন হাজির হোলাম তখন আমাদের মত ছানাপোনাদের বেশ রাত। কম পাওয়ারের হলদেটে বাতির আলোয় শুধু নজরে এলো চারিদিকে বারান্দা ঘেরা বেশ পুরনো একতালা একটা বিল্ডিং।
ঘরে ঢুকে ফ্রেশ হতেই আম্মা বাবুর্চির রান্না ভাত আর মুরগীর মাংস ডাল দিয়ে মাখিয়ে একটি প্লেটে নিয়ে আমাদের মুখে তুলতে না তুলতেই আমরা ছোট ছোট চার ভাইবোন ঘুমিয়ে কাদা। তখন আমাদের কিইবা বয়স! কেউ স্কুলেও ভর্তি হইনি। তবে বড় ভাই ঢাকার একটা স্কুলে মাত্র ভর্তি হয়েছিল এটা আমার মনে আছে।
যাইহোক পরদিন খুব ভোরে প্রকৃতি প্রেমিক আব্বার ডাকে ঘুম ভাংলো। আমরা পরমরি করে দৌড়ে বারান্দায় আসলাম। বারান্দার বাইরে চারিদিক ঘিরে অসংখ্য নয়নতারা ফুটে আছে, সাথে সবুজ পাতার মাঝে সন্ধ্যামালতীর নত হয়ে পরা ফুল। সামনে বিশাল দিঘি যার বুকে শাপলারা মাত্র পাতা মেলছে। আমরা অবাক নয়নে দেখছি সেই অচেনা পরিবেশ আর তার রূপকে।
আব্বা ডেকে বল্লো "ফুল পরে দেখো, ওইদিকে তাকাও" বলে পুর্ব দিকে হাতের ইশারা করলো। বিস্ময়াভিভূত আমরা বড় দুই বোন মেঘে ঢাকা সবুজ শ্যমল সীতাকুণ্ড পাহাড়ের দিকে চেয়ে রইলাম। সমতল থেকে আসা কত ছোট আমরা তাও উপলব্ধি করলাম সেই বিশাল পাহাড়ের মহিমা আর তার সৌন্দর্য । যতদূর চোখ যায় সেই গাঢ় থেকে হাল্কা সবুজ ঘেরা সুউচ্চ পাহাড় টানা চলে গেছে উত্তর থেকে দক্ষিনে। পরে সেই পাহাড়ে অনেক চড়েছি কিন্ত প্রথম দিনের সেই রূপ আর কখনোই দেখিনি।
আসার সময় আমার এক কাজিন আমাদের দু বোনকে দুটো খেলনা সানগ্লাস উপহার দিয়েছিল সাথে কিছু রাশিয়ান উপকথা। বানান করে দুই এক লাইন পড়ি আর ছবি দেখি। দুদিন পর সকালে আমি আর আমার বোন সেই সানগ্লাস পরে প্ল্যাটফর্মের পাশ দিয়ে হাটছি। পাশে দাঁড়ানো এক মালবাহী ট্রেন। হঠাৎ সেই থেমে থাকা ট্রেন এর ইঞ্জিন রুম থেকে তেলচিটচিটে ইউনিফর্ম পরা এক লোক লাফ দিয়ে নেমে আসলো আর তার সেই তেল মবিল লাগানো হাত দিয়ে আমাদের দুজনের হাত ধরে হাসি মুখে বলে উঠলো,"আরে চশমেওয়ালী, চশমেওয়ালী"।
এখন মনে হয় লোকটা কি রবীন্দ্রনাথের কাবুলিওয়ালা ছিল যে কি না তার ছোট মেয়েকে অনেক দূর দেশে রেখে এসেছিল জীবিকার তাগিদে। আমাদের দেখে কি তার মেয়েদের কথা মনে পরেছিল! উত্তর জানা হয়নি কারন কুউউউ করে ট্রেন ছাড়ার বাশি বেজে উঠল লোকটা লাফিয়ে ইঠে জানালায় হাত রেখে চেয়ে রইলো আমাদের দিকে যতদুর দেখা যায়।
আর সব ছবি আমার মোবাইল
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই জুন, ২০২৩ সকাল ১০:৫৬