"খঞ্জর! এত রাইতে তুমি কই থিকা আসলা! নানু বিস্মিত গলায় প্রশ্ন ছুড়ে দেয়। "আসো আসো জলদি ঘরে আসো"।
"হ আসতে আসতে একটু রাইতই হইয়া গেল বুজান। রওনা দিছিলাম দুফুর বেলা, পথে লঞ্চডা একটু নষ্ট হইছিল তাই দেরী হইছে, তবে আরেকটু পরেই কিন্ত ফজরের আজান পরবো। এখন আর ঘরে আসমুনা, রান্না ঘরের চাবিডা দ্যান আমি ঐখানে টুলের উপর বসি না হয়। ওহ হ্যা ভুইল্ল্যাই গেছিলাম এই নেন কলসডা ধরেন, শেফালী আপনেগো লিগা একটু রস জ্বাল দিয়া পাঠাইছে বুজান, লগে আবার দুইডা নাইরকোলও দিছে"। কয় "সবই তো তাগো গাছের, আমরা বইয়া বইয়া খাইতাছি," বলতে বলতে কাধে ঝোলানো ব্যাগ থেকে দুটো নারকেল বের করে দেয় খঞ্জর।
অন্য ঘর থেকে খালামনিদের আর বড় মামার নীচু গলা শোনা যাচ্ছে। এত সাধের ঘুম ভাংগানোয় চরম বিরক্তি ঝরে পরছে তাদের গলায়। নানু তাড়াতাড়ি এক হাতে হারিকেন আর একটা চাবি নিয়ে বের হয়ে গেল ঘর থেকে। রান্নাঘরটা কয়েক পা দূরে, তালা লাগানো থাকে। যদিও নেবার মতন কিছুই নেই তারপর ও চোরের উপদ্রবে তালা দিয়ে রাখতে হয়। দরমার বেড়া দেয়া রান্নাঘরে কারেন্ট নাই, হারিকেন আর কুপিই ভরসা। তাই সন্ধ্যার আগে আগেই প্রায়ই রান্নার কাজ শেষ করে ফেলে নানু।
"আসো আসো তাড়াতাড়ি ঘরে আসো, শীতে তো তুমি জইমা যাইবা"। বলতে বলতে নানু দরজা খুলে হারিকেন জ্বালাতে বসলে খঞ্জর বলে উঠে, "বুজান আপনে কষ্ট কইরেন না, আমারে দেন আমি ধরাই, আরেকটু পরই তো ফরসা হইবো"। হারিকেন জ্বালিয়ে খঞ্জর বলে "আপনে এইবার ঘরে যান বুজান। আমি এইখানেই এই চৌকির উপর চাদ্দর গায়ে দিয়া থাকতে পারমু"। উত্তর দিকের ভাংগা বেড়ার ফাক গলে হু হু করে বাতাস আসছে। খঞ্জর নানু সরু টুলের মত চৌকিটার উপর কুকড়ে মুকড়ে বসে।
সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি নানু বিছানায় নাই, অবশ্য কোনদিনই থাকে না। অনেক ভোরে নামাজ পড়তে যে উঠে আর ঘুমায় না। উঠানে মুরগীগুলো কক কক আওয়াজ তুলে খাবার খাচ্ছে। আমি দৌড়ে রান্নাঘরে গিয়ে দেখি নানু সালমাকে নিয়ে নাস্তা বানাচ্ছে আর তার পাশে এক মগ চা। আর গতকাল রাতে আসা খঞ্জর নামের সেই লোকটা সরু চৌকিটার উপর বসে আছে পা ঝুলিয়ে, সেও একটা টিনের মগে করে চা নিয়ে বসেছে আর পাশে একটা টিনের বাটিতে রাখা মুড়ি। উনি মুঠি করে মুড়ি নিয়ে চায়ের উপর ছিটিয়ে দিচ্ছে তারপর সুরুত সুরুত করে একটা অদ্ভুত শব্দ তুলে মগ থেকে চা খাচ্ছে।
নানু আমাকে পরিচয় করিয়ে দিল "উনি তোমার একজন নানা ভাই হয়, আমার ভাই"। খঞ্জর নানু আমার দিকে তাকিয়ে হাসি মুখে বল্লো "আসো নানু কাছে আসো, বুজান এই নাতনী বুঝি আপনার মাইঝা মাইয়ার"?নানু সম্মতিসুচক মাথা ঝুকালো।
দিনের আলোয় তার মুখের গর্তগুলো আরও গভীর আর ভয়াবহ লাগছিল। আমি সামান্য একটু কাছে গেলে উনি আমার হাত ধরে বল্লো " শুনো নানু তুমিও কিন্তু আমার একটা বুবু হও, ছোট বুবু "। আমি আস্তে আস্তে সরে আসলাম।
এদিকে ঘরের ভেতর মামা আর খালারা রাগে গজগজ করছে নতুন নানাটার সম্পর্কে। কোথাকার কে ! কোন সম্পর্ক নাই কিচ্ছু না, লতায় পাতায় মামাতো ভাই , আর কোন বাসায় জায়গা হয় না, কয় মাস পর পর এইখানে এসে উঠতে হয়, যত্তসব। মা ও আশকারা দিয়ে মাথায় উঠাইছে। বুজান বুজান ডাক শুনে আর পটে যায়"।
রান্নাঘরের দরজায় ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শুনছি নানুর সাথে নতুন নানাটার আলাপ, "তা খঞ্জর বাড়ির খবর সব ভালো তো? কেমুন আছে সবাই , তোমার বউ বাচ্চারা? ভালো আছে বুজান খঞ্জর নানু উত্তর দেয়।
"আর ওই যে খালপাড়ের সেই ধলা মিয়া, অনেকদিন হইলো তার খবর পাই না, সে কেমন আছে? মুকুল বুজানের শরীরডা ভালো তো? অনেক বচ্ছর হইলো আর আসে না "।
"আছে আর কি, আল্লাহ সবাইরে রাখছে যেমুন, বুঝেনই তো বয়স হইছে ম্যালা, বুজান একবার বাড়ি চলেন সব দেখবেন "।
নানু সেই কথার উত্তর দেয় না বলে, "আরেকটা কথা জিগামু মনে থাকে না, খঞ্জর তোমার মাইজা ভাই যে বাড়ীতে ফলের গাছগুলি লাগাইছিল সেইগুলি বাইচ্চা আছে কি"?
"হ হ বুজান সব বাইচা আছে, মাইজা ভাই যেইখানে যা লাগাইছিল ঠিক তেমুন"।
"আর ওই আমগাছটা! উনি যেইটা মালদাহ থিকা আনছিল ল্যাংড়া আম"? প্রতিটা প্রশ্নের সাথে নানুর আবেগ যেন ঝরে ঝরে পরে।
" হ বুজান সব আছে, আপ্নে শুধু একবার চলেন, সব দেইখা আসবেন নিজ চক্ষে, তয় উত্তরের ভিটিটা যখন পদ্মায় ভাংলো তখন মাইঝা ভাই এর লাগাইনা সেই চিনির মত মিষ্টি কদবেল গাছটাও গেল "।
নানু উদাস হয়ে যায় খঞ্জর নানুর কাকুতি মিনতি ভরা কথাগুলো শুনে। "বুজান একটা কথা কই, আপনেগো তো ভিটায় ভিটায় বড় বড় পাটাতন করা সব লোহা কাডের ঘর, আপনেগো সব শরীকরা তো গ্রাম থিকা ঘর বাড়ি সহ অনেক কিছুই নিয়া আসছে, মাইজা ভাই তো দুনিয়া ছাইড়া চইলা গ্যাছে, কিন্তু আপনারাতো আছেন, আপনারা তো কিছুই আনলেন না! "
"না খঞ্জর তোমার মাইজা ভাই কখনোই চায় নাই আমরা কিছু আনি" দৃঢ় গলায় বলে উঠে নানু"। সে কইছে "আমার বাবা আর আমরা ভাইরা মিল্লা গ্রামের বাড়িতে যা বানাইছি সেই রকমই থাকবো আজীবন, আর মা আছে ওইখানে"।
বড় একটা শ্বাস নিয়ে নানু আবার বলতে শুরু করে, "শুনো তুমি তো তখন অনেক ছোট ছিলা, অনেক কিছু হয়তো জানো না। তোমার মাইজা ভাই আর তার ভাইয়েরা কিন্তু সবাই কলকাতায় বড় বড় চাকরি করতো আর বিরাট বিরাট বাড়িতে থাকতো। গ্রামে মাঝে সাঝে বেড়াইতে আসতো বউ পোলাপান নিয়া। তবে আমার শাশুড়ীর অনেক আত্মসন্মান আছিলো, ছেলেরা অনেক সাধছে কলকাতায় তাগো লগে থাকার জন্য। কিন্ত সে কোন দিন কোন ছেলের বাসায় থাকে নাই। বড় ছেলেরে কইছে "আমি যতদিন বাইচা আছি আমার স্বামীর ভিটাতেই থাকমু, মরলে এইখানেই মরমু, তগো কারো বাসায় থাকমু না। তোর বউতো তরে ছাড়া আমার কাছে কোনদিন থাকবো না, তাই আমার সেবা করার জন্য একটা বান্দী বিয়া কইরা আন "।
বৃটিশ সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা সেই বড় ছেলে মায়ের জলদগম্ভীর হুকুমে সেইদিনই গ্রামেরই অত্যন্ত গরীব ঘরের একটা মেয়েকে বিয়ে করে এনে মায়ের হাতে তুলে দিল, তারপর স্ত্রী ছেলে মেয়ে নিয়ে কলকাতা ফিরে গেল। মাকে দেখতে বড় ছেলে প্রতি বছরই গ্রামে আসতো তবে সেই বান্দী বউর জীবনে কখনো আসেনি বাসর, জানে নাই স্বামীর সোহাগ কেমন! নিস্ফল যৌবন আর সন্তানহীন মেয়েটি সারাজীবন পালন করে গেছে তার দায়িত্ব অর্থাৎ শাশুড়ীর সেবা যত্ন যেখানে পান থেকে চুন খসার অবকাশ ছিল না। যে উদ্দেশ্যে তার বিয়ে আর শশুর বাড়িতে আগমন সেই দায়িত্ব পালনে কোন ফাক ছিল না।
খঞ্জর নানু মন দিয়ে আমার নানুর কথা শুনছিল। মাঝে মাঝে টুকটাক এটা ওটা বলছিল। নানু তাকে টিনের থালায় রুটি আর আলু ভাজি নাস্তা দিল। আমি এতক্ষণ খেয়াল করি নাই এখন দেখলাম একটা মাটির গামলায় উনি আগুন জ্বেলে ছিল, সেটা মরে ধুয়া বের হচ্ছে। আমার চোখ ধুয়ায় কর কর করে উঠলো।
ঘরে যেতেই আমার মেঝ খালা আমাকে জিজ্ঞেস করলো "এই শোন, এই আপদ বিদায় হবে কবে শুনলি কিছু"?
"আপদকে খালা" আমার প্রশ্ন শুনে খালা বলে উঠে,
"তুই একটা গাধা, ওইযে খঞ্জর না মঞ্জর লোকটা আসছে, গ্রামের বাড়ির চৌকিদার তার আবার আল্লাদ কত! মারে বুজান বুজান ডাইকা অস্থির।
খঞ্জর নানু যে এই বাসায় অনাহুত তা উনি ভালো করেই বোঝেন। তাই উনি যতটা পারেন আড়ালে থাকার চেষ্টা করেন, তারপরও দেখা হলে সেধে সেধে হাসি মুখে সবার সাথে কথা বলতে যায়। কেউ উত্তর দেয় কেউ দেয় না।
এভাবে দুতিন দিন কাটানোর পর উনি তার সেই ঝোলা ব্যাগটা কাধে নিয়ে বলে উঠে,
"বুজান আজ যাই"।
"এত তাড়াতাড়ি যাইবা"! নানু বিস্ময় নিয়ে বলে উঠে। "হ বুজান শেফালীরে একলা থুইয়া আসছি, ও কইছে তাড়াতাড়ি ফিরা যাইতে, বুঝেন না একলা একলা এত বড় বাড়িতে থাকতে ডরায়"।
নানু ব্যাথিত মুখে তাকে বিদায় দেন রান্নাঘরের বারান্দায় দাঁড়িয়ে। আষ্টেপৃষ্টে জড়ানো মলিন খদ্দরের চাদর, ক্ষয়ে যাওয়া রবারের স্যান্ডেল পায়ে খুড়িয়ে খুড়িয়ে খঞ্জর নানু আস্তে আস্তে বেড়ার কেচি গেটটা খুলে বের হয়ে যায়। যাবার আগে একবার মুখ ফিরিয়ে দেখে নেয় শেষবারের মত।
খালারা একে একে এসে জানতে চায় আপদ বিদায় হয়েছে নাকি! চিকন পাড়ের সাদা ধুতি শাড়ি পরা নানু কঠিন মুখে বলে উঠে, "তোমাদের কাছে সে আপদ হইতে পারে, কিন্ত আমার কাছে সে আসে আমার গ্রামের সুবাস নিয়া, আনে মাটির গন্ধ, আর তার সাথে নিয়া আসে তোমার বাবার স্মৃতি " ।
ছবি আমার তোলা।
https://www.somewhereinblog.net/blog/June/preview/30352266
প্রথম পর্ব
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা অক্টোবর, ২০২৩ বিকাল ৫:৫৮