"আমার কথা - ৯" এখানে পড়ুনঃ আমার কথা - ৯
আমাদের ভাইভা আর মেডিকেল টেস্ট শেষ হবার পর পরই চূড়ান্তভাবে নির্বাচিতদের পোষাক আশাকের মাপযোখ নেবার জন্য কলেজ থেকেই এক টেইলর মাস্টারকে ঢাকায় নিয়ে আসা হয়েছিলো। তিনি বেশ মনযোগ দিয়ে আমাদের শরীরের মাপযোখ নিচ্ছিলেন আর তা রেজিস্টারে লিখে রাখছিলেন আমাদের পোষাক তৈ্রীর জন্য। তখন আমাদেরই মধ্যকার একজন, হ্যাংলা পাতলা, চোখে মোটা ফ্রেমের চশমাধারী ছোটখাট ধরণের কাজী ইকবাল হোসেন (১৮৮), খুব ফুরফুরে মেজাজে ফড়িং এর মত এদিক সেদিক ঘুরে ঘুরে বেড়াচ্ছিলো আর অনর্গল কথা বলে যাচ্ছিলো। ভাইভার প্রথম দিনেও সে এতটাই কথা বলছিলো যে তত্তাবধানকারী শিক্ষক তাকে ‘টকেটিভ’ বলে মৃদু ভর্ৎসনাও করেছিলেন। তাকে খুব স্মার্ট আর সবজান্তা বলে মনে হচ্ছিলো। কলেজে যোগদানের পর আমাদের একথা জানতে খুব বেশিদিন লাগেনি যে কাজী ইকবাল হোসেন স্বপন আসলেও ছিল একজন 'সকল কাজের কাজী'। সেই ইউওটিসি গ্রাউন্ডেই (এখন বোধহয় ওটাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় স্টেডিয়াম বলে) সে অন্যান্য সতীর্থদের কাছ থেকে অনতিবিলম্বে ‘চাল্লি’ উপাধি অর্জন করেছিলো, যা আজীবন তার মাথায় শিরোপা হিসেবে রয়ে যায় এবং আজও আছে। আমি নিশ্চিত যে আজ এই ৪৮ বছর পর আমাদের অনেকেই তার আসল নামটা স্মরণ করতে না পারলেও, চাল্লি বললেই সহজে তাকে চিনে যাবে এবং তাকে নিয়ে অফুরন্ত গল্পের বাক্স খুলে বসবে। সেই ইউওটিসি গ্রাউন্ডেই সে কলেজ থেকে পাঠানো কল আপ লেটারের লেফাফাটি হাতে নিয়ে সবাইকে দেখিয়ে বেড়াচ্ছিলো। তার বাবা তখন কোন একটা সেন্ট্রাল জেলের ‘জেলার’ (Jailor) হিসেবে কর্মরত ছিলেন। তখন তো আর কম্পিউটার ছিলোনা, ঠিকানাগুলো লেখা হতো হস্তলিপিতে। কোন এক করণিক হয়তো ভুলে তার বাবার ঠিকানায় Jailor শব্দটির স্থলে Tailor লিখেছিলো। অথবা হাতের লেখার কারণে J টাকে T এর মত দেখাচ্ছিলো। আর এটা নিয়েই সে আসর গরম করে তুলেছিলো। মাপ নেয়া সেই টেইলর মাস্টারকে দেখিয়ে সে বলে বেড়াচ্ছিলো, “My father is not a tailor like him, he is a Jailor”! আমরা বেশ মজা পাচ্ছিলাম, বোধকরি সেও পাচ্ছিলো। ওর কাহিনী সবিস্তারে বলার জন্য আলাদা একটা চ্যাপ্টার এর প্রয়োজন পড়বে। তাই আপাততঃ ওর প্রসঙ্গটা এখন তোলা রইলো।
সেই টেইলরের প্রসঙ্গটা টানলাম এই জন্য যে হাউসে এসে আমি অবাক বিস্ময়ে দেখলাম আমাদের সবার বেডের উপরে (বেড বলতে ছিলো জুট টেপ লাগানো এক চারপয়) সদ্য বানানো আমাদের ইউনিফর্ম ও অন্যান্য পোশাকাদি সুন্দর করে লে-আউট করে রাখা হয়েছে। আমরা কয়েকটা পোষাক, ক্যাপ, বুট ইত্যাদি পরিধান করে দেখে নিলাম, কেমন লাগে। যে টেইলরের কথা এতদিনে প্রায় ভুলেই গিয়েছিলাম, তার নিখুঁত হাতের বানানো পোষাক আমাদের চেহারাই পাল্টে দিয়েছিলো। পাশেই ছিলো একটা কাবার্ড, যার উচ্চতা আমার চেয়ে সামান্য বেশী ছিলো। বড়ভাই দু’জন আমাদেরকে বেশ নিষ্ঠার সাথে শিখিয়ে দিচ্ছিলেন, কি করে কাবার্ডে কাপড় চোপড়, বইপত্র ইত্যাদি সুন্দর করে সাজিয়ে গুছিয়ে রাখতে হবে। তখন সাপ্তাহিক ছুটি ছিলো প্রতি রবিবারে। ঐদিন “প্রিন্সিপালস ইন্সপেকশন”, আর প্রতি সোমবারে “প্রিন্সিপালস প্যারেড” অনুষ্ঠিত হতো। সেখানে কারো কোন দোষত্রুটি বা খুঁত ধরা পড়লে হাউসের নম্বর কাটা যাবে আর এজন্য অপরাধীকে হাউসের আর বাদবাকী সবার রোষানলে পড়তে হবে, একথা ভাইয়েরা জানিয়ে দিলেন দ্ব্যর্থহীনভাবে। আর আবেদ ভাই অতি মৃদুস্বরে জানিয়ে দিলেন, রুম ক্যাপ্টেন হিসেবে এজন্য তাকেও লজ্জিত ও অপদস্থ হতে হবে।
দেখতে দেখতে রাত প্রায় সাড়ে আটটা বাজতে চললো। রুম ক্যাপ্টেন জানালেন, হুইসেল বাজলেই আমাদেরকে ডিনারের জন্য ‘ফল-ইন’ হতে হবে। আমরা তাড়াতাড়ি ডিনার ড্রেসটা পড়ে নিলাম, অর্থাৎ সাদা শার্ট, সাদা ট্রাউজার্স, নেভী ব্লু রঙের একটা সুন্দর ডিনার বেল্ট আর টাই। মুশকিল হলো নবাগত ৬ জনের মধ্যে ৪ জনই আমরা টাই এর নট বাঁধতে শিখি নাই। বাকী ২ জন বাসায় রিহার্সেল দিয়ে এসেছিলো, তা সত্ত্বেও একজন কোন রকমে নট জাতীয় কিছু একটা বানালো যা একটুতেই খুলে গেলো, তবে অপরজন, অর্থাৎ আবদুল্লাহ (১৯৩) একাই খুব সুন্দর একটা নট বাঁধতে পেরেছিলো। বড়ভাইয়েরা প্রথমদিন আমাদের নট বেঁধে দিয়ে জানালেন যে এর পর থেকে শেখানো পদ্ধতি অনুযায়ী আমাদের নট আমাদের নিজেদেরই বেঁধে নিতে হবে। আর শেখানো হবেনা। আমি ভয়ে প্রথম দিনের সেই বাঁধা নটটা প্রায় একমাস ধরে কোনদিন খুলিনি। পরে বন্ধু আবদুল্লাহ সুন্দর করে আমাকে এবং আরো কয়েকজনকে টাই এর নট বাঁধা শিখিয়ে দিয়েছিলো, যে শিক্ষা আজীবন আমার ঝুলিতে রয়ে গেছে। এজন্য আবদুল্লাহকে ঘটা করে কোনদিন ধন্যবাদ জানাইনি, তবে এই ছোট্ট ইহসানটুকুর জন্য নিশ্চয়ই প্রকৃ্ত বিনিময়দাতা তাকে পুরস্কৃত করবেন। আর আমার এ লেখাটা যদি কোনদিন আবদুল্লাহ’র নজরে আসে, তবে সে সহজেই আমার অন্তরের উষ্ণ কৃ্তজ্ঞতাটুকু অনুভব করে নিতে পারবে বলে আমার বিশ্বাস।
হঠাৎ কান ফাটানো এক হুইসেল এর শব্দে চমকে উঠলাম। পরে জেনেছিলাম, এমন কর্ণ বিদীর্ণকারী হুইসেল গোটা দশেক স্টাফদের মধ্যে কেবল একজনই বাজাতে পারতেন, তার নাম হাবিলদার মেজর আব্দুল আজিজ, ওরফে নিক্কু। বলা বাহুল্য নিক্কু উপাধিটা ক্যাডেটদের তরফ থেকে দেয়া ছিলো। কেন, সেকথায় আসবো পরে। হুইসেল শোনার সাথে সাথে আমরা সবাই তড়িঘড়ি করে হাউস এর সামনের রাস্তায় ‘ফল-ইন হ’লাম। ছোটবেলায় ‘মুকুল ফৌজ’ এর প্যারেড করায় ‘ফল-ইন’ কথাটার সাথে আগেই পরিচিত হয়েছিলাম, কিছুটা ‘লেফট-রাইট, এবাউট টার্ণ, রাইট টার্ণ, লেফট টার্ণ’ ইত্যাকার ওয়ার্ডস অব কমান্ডের সাথেও পরিচিত ছিলাম। ডাইনিং হলে যাবার জন্য তখন দুই হাউসের মাঝখানে এখনকার মত কাভার্ড ওয়াক ওয়ে ছিলোনা। হাল্কা ঝিরঝিরে বৃষ্টির মাঝে অনভ্যস্ত পায়ে সবার সাথে মার্চ করতে করতেই ডাইনিং হলে প্রবেশ করলাম। আমাদের কলেজে সপ্তাহে সপ্তাহান্তে (উইক এন্ড নাইট) অর্থাৎ শনিবার রাত্রে পোলাও দেয়া হতো। যতদূর মনে পড়ে, বোধকরি নবাগত সম্বর্ধনা উপলক্ষে সেদিনটা শুক্রবার হওয়াতে শনিবারের পরিবর্তে ঐ সপ্তাহের পোলাওটা শুক্রবার রাতেই দেয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছিলো। আগেই বলেছি, সেদিন দুপুরে বাসা থেকেও পোলাও খেয়ে এসেছিলাম, কিন্তু মন খারাপ করা আবেগের কারণে খুব সামান্যই খেতে পেরেছিলাম। মাঝে অনেক সময় পেরিয়ে যাওয়াতে বেশ ক্ষুধা পেয়েছিলো। মনে আছে, কলেজের প্রথম ডিনারটা বেশ তৃপ্তির সাথেই খেয়েছিলাম।
খাওয়া শেষ করার পর আমরা এক এক করে পিঁপড়ার মত সারি বেঁধে ডাইনিং হল ত্যাগ করলাম। খাওয়ার শুরুতে আর শেষে কলেজ ক্যাপ্টেন কর্তৃক আনুষ্ঠানিকভাবে দোয়া পাঠ আমাকে চমৎকৃত করেছিলো। উল্লেখ্য যে তখনো কলেজে আলাদাভাবে ডাইনিং হল ক্যাপ্টেন এর পদ সৃষ্টি করা হয় নাই। আর কলেজ ক্যাপ্টেনকে তখন কলেজ ক্যাপ্টেন নয়, ‘সিনিয়র ক্যাডেট’ হিসেবে সম্বোধন করা হতো। হাউসে ফিরে আসার পর রুম ক্যাপ্টেন আমাদেরকে হাউস কমন রুমে নিয়ে গেলেন। সেখানে দেখলাম, বেশ কিছু ইংরেজী আর বাংলা সংবাদপত্র স্ট্যান্ডের উপর কাঠের মার্জিন দিয়ে বেঁধে রাখা হয়েছে। দুটো দাবার বোর্ড, দুটো ক্যারম বোর্ড আর একটা টেবিল টেনিস এর সরঞ্জাম দেখতে পেলাম। দূরে কোণায় বোধকরি একটা থ্রী ব্যান্ড রেডিওও ছিলো। এসব দেখে খুব খুশী হলাম। একপাশে একটা জায়গায় নামাযের ব্যবস্থাও দেখতে পেলাম। উল্লেখ্য যে তখনো কলেজে কোন মাসজিদ নির্মিত হয়নি। আর এখনকার মত তখন মাগরিব এর নামায পুরো কলেজ এক জামাতে পড়ার কোন ব্যবস্থা ছিলনা। নামায পড়া উৎসাহিত করা হতো বটে, তবে কলেজের দৈনন্দিন অবশ্য করণীয় তালিকায় অন্তর্ভুক্ত ছিলোনা। আমরা জুম্মার নামাজ পড়তাম স্টাফ রুমে আর তার সামনের বারান্দাটাতে। মেহেন্দীর লাল রঙে রঞ্জিত শ্মশ্রুমন্ডিত একজন হুজুর আমাদের নামাযে ইমামতি করতেন। নবাগত সপ্তম শ্রেণীর যারা পবিত্র ক্বোরান পাঠ জানতোনা, হুজুর তাদেরকে শুক্রবার বিকেলে ক্বোরান পাঠ শিক্ষা দিতেন। যারা জানতো, তাদেরকেও আবশ্যিকভাবে উপস্থিত থাকতে হতো। তাদের কোন কাজ থাকতোনা বলে তারা একটু আধটু দুষ্টুমি করতো। হুজুর রেগে গেলে আমাদেরকে “হায়েনার দল” বলে সম্বোধন করতেন, একথা বেশ মনে আছে।
কমন রুম দেখার পর যার যার বেডে ফিরে এসে ঘুমানোর প্রস্তুতি নেয়া শুরু করলাম। বাসা থেকে আনা স্লীপিং ড্রেসটা পড়ে নিলাম। লাইন ধরে দাঁত ব্রাশ করে এলাম। আমাদেরকে জানানো হলো, রাত ঠিক দশটায় বিউগল বাজানো হলে সাথে সাথে রুমের সমস্ত আলো নিভিয়ে দিতে হবে। বিউগল যথাসময়ে বাজলে আমরা লাইট অফ করে দিয়ে যার যার বেডে শুয়ে পড়লাম। শুরু হলো এক নতুন অধ্যায়। আব্বা ফিরে যাবার পর থেকে সতীর্থ সবার সাথে মিলে মিশে যাওয়ায় একবারের জন্যও তাঁর কথা মনে হয়নি। শোয়ার পর যেন এক সিনেমা দেখতে শুরু করলাম। সারাদিনের কর্মযজ্ঞের ছবি সেলুলয়েডের ফিতের মত চোখের সামনে দিয়ে ভেসে যেতে শুরু করলো। আম্মা ও ভাইবোনদের কথাও খুব করে মনে পড়তে লাগলো। ভাবতে থাকলাম, ওরাও নিশ্চয়ই তখন আমার কথা ভেবে মন খারাপ করছে। আকাশ ভেঙ্গে মুষলধারে আষাঢ়ের বৃষ্টি ঝরা শুরু হলো। সাথে আকাশ চেরা বিজলীর চমকানি আর তার পরপরেই বজ্রের হুঙ্কার। আমাদের হাউসটার আশে পাশে অনেকগুলো শেয়ালের বাসা ছিলো। তারা তারস্বরে চীৎকার শুরু করে দিলো। আমার বিছানাটা ছিলো জানালার ঠিক পাশেই। খুব ইচ্ছে হচ্ছিলো একটুখানি জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়াই, কিন্তু সিনিয়রের ভয়ে সাহস হচ্ছিল না। এক সময় মনে হলো সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে। একজনের ফিসফিসানিতে মনে হলো সে জেগে আছে, কিন্তু কথা বলার কোন উপায় নেই। সিমপ্যাথেটিক ডেটোনেশন হলো। আমার দুটো চোখ দিয়েও নীরবে অশ্রু ঝরে পড়তে লাগলো। মোচড়ানো ভেজা বালিশটাকে এপাশ ওপাশ করেও আর অনেক দোয়া দরুদ পড়েও সারারাত চোখে ঘুম আনতে পারলাম না। প্রথম রাতটা বলতে গেলে নির্ঘুম কাটালাম। ভোরের দিকে বৃষ্টি থেমে গেলে আমি চুপি চুপি পায়ে জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম।
চলবে…
ঢাকা
১৪ জুলাই ২০১৫
সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
সেদিনের স্মৃতিচারণ করে একটা ইংরেজী কবিতা লিখেছিলাম গতবছরে, যা একটি ইংরেজী কবিতার ওয়েবসাইটে প্রকাশিত হয়েছেঃview this link
এই ছবিটা বোধহয় ঠিক ৭ম শ্রেণীতে থাকাকালীন তোলা নয়। যতদূর মনে পড়ে, এটা ৮ম কি ৯ম শ্রেণীতে থাকাকালীন তোলা হয়েছিলো।
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা ডিসেম্বর, ২০২০ দুপুর ১২:৪৬