somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

আমার কথা -২২

২৮ শে ডিসেম্বর, ২০১৫ রাত ১২:০৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

"আমার কথা -২১" পড়তে হলে এখানে ক্লিক করুনঃ আমার কথা -২১

আমার শিক্ষকেরাঃ
জনাব মাসউদ হাসান
সপ্তম শ্রেণীতে যাঁরা পড়াতে আসতেন, তাঁদেরকে বিষয় বিশেষজ্ঞ না হলেও চলতো। মনে আছে প্রথম দিন কিংবা প্রথম দিকের কোন একদিনে ভূগোলের শিক্ষক জনাব মাসউদ হাসান স্যার এসেছিলেন আমাদের পৌরনীতি পড়াতে। যেহেতু ইংরেজী মিডিয়াম, পৌরনীতিকে বলা হতো সিভিক্স। Civics, Geography এবং History, এই তিনটি বিষয়ের একত্রিত নাম ছিল সোশ্যাল স্টাডীজ। মাসুদ হাসান স্যার ক্লাসে এসে প্রথমে সংক্ষেপে তাঁর পরিচয় তুলে ধরলেন, তার পরে একে একে সবাইকে তাদের নিজেদের সম্বন্ধে কিছু বলতে বললেন। বড় হয়ে কে কী হতে চায়, সে সম্পর্কেও কিছুটা বলতে বললেন। আমি বসেছিলাম প্রথম সারির শেষের দিক থেকে একটা সীট আগে। প্রথম ডেস্ক থেকে বলা শুরু হলো, আমার আগে বলার ছিলো চারজন। ওরা যখন বলছিলো, আমি তখন মনে মনে আওড়াচ্ছিলাম, কী বলবো, কিভাবে বলবো। কোন সিদ্ধান্তে পৌঁছোবার আগেই যেন মুহূর্তের মধ্যে আমার বলার পালা চলে এলো। বড় হয়ে কী হতে চাই, এ চিন্তাটা আমাকে বেশ ভাবাচ্ছিলো, কারণ কখনো এর আগে এ নিয়ে কোন চিন্তা করি নাই। আমি কোনমতে নাম ধাম, স্কুলের নাম ইত্যাদি বলে থেমে গেলাম। কী হতে চাই, এ বিষয়ে বলার মত কিছু খুঁজে পাচ্ছিলাম না, তাই চুপ করে গেলাম। আমার আগেরজন বলেছিলো সে আর্মি অফিসার হতে চায়। এমনকি একজন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট হতে চায়, সেকথাও বলেছিলো। একবার ভেবেছিলাম, আমিও বলি আর্মি অফিসার হবো। কিন্তু সত্যি সত্যি সেটা হতে চাই, এমনটা কখনো ভাবিনি, তাই বলতেও পারলাম না। মাসুদ হাসান স্যার ছিলেন ছাত্রদের প্রতি একজন স্নেহবৎসল শিক্ষক। তিনি তাঁর শিক্ষকের হৃদয় দিয়ে আমার অন্তরের অস্বস্তিটুকু আঁচ করতে পেরেছিলেন। উনি বললেন, …তো বললো সে আর্মি অফিসার হতে চায়, তুমিও কি তাই চাও? আমি কোনমতে সম্মতিসূচক মাথা নেড়ে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। তবে বিধাতা সেদিন আমার এই অনিচ্ছাকৃত সম্মতির সাক্ষী ছিলেন, তাই হয়তো আমাকে মিথ্যা প্রতিপন্ন না করার জন্য আমার কপালে ঐ পেশাটিকেই তিনি লিখে রেখেছিলেন। সে ইতিহাস যথাসময়ে বলা যাবে।

প্রথম প্রথম মাসউদ হাসান স্যার আমাদেরকে ফিজিক্যাল জিয়োগ্রাফী পড়াতেন। Earth’s Crust, Rocks, Volcano, Weathering And Denudation ইত্যাদি বিষয়ের উপর যখন তিনি ইংরেজীতে লেকচার দিতেন, আমি মন্ত্রমুগ্ধের মত তা শুনতাম এবং খুব সহজেই বুঝতে পারতাম। যাদের বুঝতে একটু কষ্ট হতো, তাদের প্রতিও তাঁর খেয়াল থাকতো। Volcano বিষয়ে Molten Materials সম্পর্কে বলতে গিয়ে একটা term এসেছিলো semi solid। মনে আছে, semi solid বোঝাতে গিয়ে তিনি গরম সুজির হালুয়ার কথা বলেছিলেন, যেটা তরল নয় যে পড়ে গেলে গড়িয়ে যাবে, আবার কঠিনও নয় যে সেটাকে ভেঙ্গে খেতে হবে। প্লেটে রাখলে ছড়িয়ে যাবে ঠিকই, কিন্তু গড়িয়ে যাবেনা। একথা শোনার পর আর semi solid লাভা কী জিনিস, তা কে না বুঝবে? বোঝানোর ব্যাপারে তাঁর অসাধারণ নিষ্ঠা আর একাগ্রতা দেখে আমি মুগ্ধ হ’তাম। ভালো ছবি আঁকতে পারতামনা বলে আমি তাঁর সাবজেক্টে হাইয়েস্ট মা্র্কস কদাচিৎ পেয়েছি, তবে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ নম্বরটি বলা চলে আমার জন্য প্রায় নির্ধারিতই থাকতো। তাঁর কারণেই ভূগোলটা রাতারাতি আমার প্রিয় সাবজেক্টে পরিণত হয়ে গেলো। সেটা তাই থাকলো ততদিন পর্যন্ত, যতদিন না তিনি রিজিওনাল জিওগ্রাফী পড়ানো শুরু করলেন, যখন ছাত্রদের মাঝে এন্তার ম্যাপ আঁকাআঁকি ও সেগুলো রঙ করাকরির প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গেলো। আমি সে প্রতিযোগিতায় টিকতে পারিনি।

মাসউদ হাসান স্যার যখন ওশেন কারেন্ট পড়াতে শুরু করলেন, তখন আমি এযাবত অজানা ওসব বিষয়ে জানতে পেরে আরো বেশী জানার জন্য আগ্রহী হতে থাকলাম। সী ব্রীজ আর ল্যান্ড ব্রীজের ব্যাপারটা খুব ভালোভাবে বুঝেছিলাম, তাই ঐ বিষয়ের পাক্ষিক পরীক্ষাটাতে সর্বোচ্চ নম্বর পেয়েছিলাম। কামচাটকা কারেন্টের কথা এখনও মনে পড়ে, যেমন পড়ে অব, ইয়েনেসী আর লেনা নদীর নাম। ম্যাপ আঁকাতে অতি দুর্বল এই আমিও এশিয়ার ম্যাপ এঁকে খুব সুন্দর করে ঐ তিনটি নদীর গতিপ্রবাহ দেখাতে পারতাম। স্যারের একটা অভ্যেস ছিলো তিনি তার লেকচারে “that of the” কথাটি বহুবার ব্যবহার করতেন, এমনকি একই বাক্যে একাধিকবার বলতেন। অচিরেই “that of the” তার নামে পরিণত হয়ে গিয়েছিলো, কিন্তু তিনি আমাদের খুব শ্রদ্ধেয় শিক্ষক ছিলেন বিধায় আমরা নামটিকে আমাদের মাঝেই যথাসাধ্য সীমিত রাখতে প্রয়াসী ছিলাম। পরে শুনেছিলাম যে আমাদের নীচের ক্লাসের ক্যাডেটরা দুষ্টুমিতে আমাদের চেয়ে কয়েক ধাপ এগিয়ে ছিল বিধায় তারা আর এ বিষয়ে কোন রাখঢাক করেনি। স্যার জেনে গিয়েছিলেন যে তাঁর ছাত্রদের মাঝে তাঁকে ঐ নামেও মাঝে মাঝে ডাকা হয়ে থাকে।

জনাব মরহুম এ,কে,এম, মাযহারুল হক
জনাব মরহুম এ,কে,এম, মাযহারুল হক স্যার আমাদেরকে ইতিহাস পড়াতেন। স্যার বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনা শেষ করেই আমাদের কলেজে যোগ দিয়েছিলেন। অত্যন্ত পরিচ্ছন্ন রুচির মানুষ ছিলেন তিনি। পোশাকে পরিচ্ছদে যেমন কেতাদুরস্ত ছিলেন, কথাবার্তায় তেমনি খুব নম্র ভদ্র ছিলেন। চুলগুলোকে তিনি সবসময় পরিপাটি করে আঁচড়িয়ে তবে ক্লাসে প্রবেশ করতেন। খুব ফর্সা ছিলেন, রাগ হলে কিংবা বিব্রত হলে একেবারে লাল হয়ে যেতেন। তাঁর সম্পর্কে কেবল একটাই নেতিবাচক কথা বলা যেত, যে তিনি অত্যধিক স্থূল (obese) ছিলেন। তবে তাঁর হাঁটার মধ্যে একটা ছন্দ ছিলো। আমরা সে সময়েই বুঝতে পেরেছিলাম যে তিনি আদ্যোপান্ত একজন রোমান্টিক মানুষ ছিলেন। পরবর্তীকালে তাঁর আরো কিছুটা কাছে ঘেঁষার সুযোগ হয়েছিলো। তখন দেখেছি তাঁর পারিবারিক আচরণ ছিলো কতটা প্রেমময়। তিনি একজন অত্যন্ত স্নেহবৎসল পিতা ছিলেন। বাসায় কখনো উচ্চকন্ঠ হতেন না। ছাত্র হিসেবে জানিনি, তবে পরে জেনেছি, স্ত্রীর প্রতি ভালোবাসায় তিনি ছিলেন অন্তপ্রাণ। তাঁর বড় মেয়ে ছন্দার বিয়ে হয়েছিলো তৎকালীন মেজর জাহিদের সাথে। আমরা একসাথে একসময় রংপুর সেনানিবাসে কর্মরত থেকেছি। পরে ২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারী পিলখানার কুখ্যাত হত্যাযজ্ঞে কর্ণেল জাহিদ মর্মান্তিকভাবে শহীদ হন। এর মাত্র কিছুকাল আগে তিনি বিডিআরে বদলী হয়েছিলেন।

মাযহারুল হক স্যার মাঝে মাঝে আমাদেরকে বাংলাও পড়াতেন। জসিম উদ্দিনের “কবর” কবিতাটি পুরোটা তাঁর মুখস্থ ছিলো, যা তিনি আমাদের মাঝে মাঝে আবৃত্তি করে শোনাতেন। এতটাই আবেগমাখা হতো তাঁর আবৃত্তি যে মাঝে মাঝে তাঁর চোখ দিয়ে ঝর ঝর করে জল গড়িয়ে পড়তো। আর সব ইতিহাসবেত্তাদের মতই তিনি ইতিহাসের পরীক্ষায় কোটেশন উদ্ধৃত করা খাতাগুলোকে অত্যন্ত উদারভাবে পুরস্কৃত করতেন। এটা বুঝতে আমাদের বেশীদিন লাগেনি, তাই মাযহার স্যারের পরীক্ষা মানেই ছিলো আমাদের কোটেশন মুখস্থ করার ধুম। ইতিহাসে “আইয়্যামে জাহিলিয়াত” পড়াতে গিয়ে তিনি প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ সৈয়দ আমীর আলী’র “A Short History Of The Saracens” বিখ্যাত বইটির রেফারেন্স দিয়েছিলেন। মুহাম্মদ (সঃ) এর আবির্ভাব সম্পর্কে ঐ বই থেকে নেয়া কে, আলীর বইএর একটি কোটেশন আমার আজও মনে আছে, যা সেই সময়ে মুখস্থ করেছিলামঃ “Never in the history”, says Ameer Ali, “Was the need so great, the time so ripe, for the appearance of a Deliverer”.

মাযহার স্যারের আরো দুটো বিখ্যাত কোটেশন, যা উনি আমাদের শিখিয়ে বলেছিলেন, ইংরেজী রচনায় পারলে কাজে লাগাতে। একটা দেশপ্রেম সম্পর্কে, অপরটা নারীশিক্ষা সম্পর্কে। ব্যক্তিগতভাবে কোন পরীক্ষায় আমি ওগুলো কাজে লাগাতে না পারলেও তা আমার মেমোরীতে আজও উজ্জ্বল হয়ে রয়ে গেছেঃ
About Patriotism- “Patriotism turns a zero into a hero, a murderer into a martyr and a sinner into a saint”.
About Women’s Education- “If you educate a man, you educate a single individual. If you educate a woman, you educate an entire family.”

আমি পুরোপুরি নিশ্চিত নই, তবে খুব সম্ভবতঃ শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক সাহেব পাকিস্তানের পার্লামেন্টে নারীশিক্ষার পৃষ্ঠপোষকতা দাবী করে পরের কথাটি বলেছিলেন। তখনকার দিনে পার্লামেন্টে বিতর্কগুলো সাধারণতঃ ইংরেজীতেই হতো।


চলবে...

ঢাকা
০৪ সেপ্টেম্বর ২০১৫
সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে আগস্ট, ২০২৩ সকাল ১০:১২
২০টি মন্তব্য ১৮টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

মধ্যবিত্ত শ্রেণীর ফাঁদ (The Middle Class Trap): স্বপ্ন না বাস্তবতা?

লিখেছেন মি. বিকেল, ১২ ই মে, ২০২৪ রাত ১২:৪৫



বাংলাদেশে মধ্যবিত্ত কারা? এই প্রশ্নের যথাযথ উত্তর দেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়। তবে কিছু রিসার্চ এবং বিআইডিএস (BIDS) এর দেওয়া তথ্য মতে, যে পরিবারের ৪ জন সদস্য আছে এবং তাদের... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছাঁদ কুঠরির কাব্যঃ এঁটেল মাটি

লিখেছেন রানার ব্লগ, ১২ ই মে, ২০২৪ রাত ১:৫৬




শাহাবাগের মোড়ে দাঁড়িয়ে চা খাচ্ছিলাম, মাত্র একটা টিউশানি শেষ করে যেন হাপ ছেড়ে বাঁচলাম । ছাত্র পড়ানো বিশাল এক খাটুনির কাজ । এখন বুঝতে পারি প্রোফেসরদের এতো তাড়াতাড়ি বয়স... ...বাকিটুকু পড়ুন

আসুন সমবায়ের মাধ্যমে দারিদ্র বিমোচন করি : প্রধানমন্ত্রী

লিখেছেন স্বপ্নের শঙ্খচিল, ১২ ই মে, ২০২৪ ভোর ৪:১০



বিগত শুক্রবার প্রধানমন্ত্রী নিজ সংসদীয় এলাকায় সর্বসাধারনের মাঝে বক্তব্য প্রদান কালে উক্ত আহব্বান করেন ।
আমি নিজেও বিশ্বাস করি এই ব্যাপারে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী খুবই আন্তরিক ।
তিনি প্রত্যন্ত অন্চলের দাড়িয়ারকুল গ্রামের... ...বাকিটুকু পড়ুন

পাইলট ফিস না কী পয়জনাস শ্রিম্প?

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১২ ই মে, ২০২৪ সকাল ৭:৪০

ছবি সূত্র: গুগল

বড় এবং শক্তিশালী প্রতিবেশী রাষ্ট্রের পাশে ছোট ও দূর্বল প্রতিবেশী রাষ্ট্র কী আচরণ করবে ? এ নিয়ে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক অধিক্ষেত্রে দুইটা তত্ত্ব আছে৷৷ ছোট প্রতিবেশি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছেলেবেলার অকৃত্রিম বন্ধু

লিখেছেন ঢাবিয়ান, ১২ ই মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৯

খুব ছোটবেলার এক বন্ধুর গল্প বলি আজ। শৈশবে তার সাথে আছে দুর্দান্ত সব স্মৃতি। বন্ধু খুবই ডানপিটে ধরনের ছিল। মফস্বল শহরে থাকতো। বাবার চাকুরির সুবাদে সেই শহরে ছিলাম... ...বাকিটুকু পড়ুন

×