somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পথের পাঁচালি

০৭ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৯ রাত ৯:৫৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

ছোটবেলায় আমি মায়ের ফুট ফরমাশ খাটতাম। এটা আমি স্বেচ্ছায় করতাম, করতে খুব ভাল লাগতো, আর তা করে খুব সহজে মায়ের নৈকট্য অর্জন করতাম। সাত ভাইবোনের পরিবারে মায়ের নৈকট্য অর্জন করতে পারাটাও একটা প্রতিযোগিতার মত ছিল। সংসারের এটা ওটা কিনে আনার জন্য মা আমাকে প্রায়ই দোকানে পাঠাতেন। এ ছাড়া পরিবারের জন্য কাঁচা বাজার করার দায়িত্বটা খুব কম বয়স থেকেই আমার ঘাড়ে পড়েছিল। এতে আমি মোটেই অখুশী ছিলাম না, এর প্রধান কারণ এর ওসিলায় সকালের পড়া থেকে একটু আগে ভাগেই অব্যাহতি পাওয়া যেত। বাজার এনে দিয়ে গোসল করে গরম ভাত খেয়ে স্কুলে যেতাম। বিকেলে আবার স্কুল থেকে ফিরেও ভাতই খেতাম। ভাত খেয়ে উঠেই খেলতে যেতাম। তখন কোন ফাস্ট ফুডের বালাই ছিল না, তাই ভেতো বাঙালী হয়েই তৃপ্ত ছিলাম। কখনো কখনো যদি একটু জ্বর হতো, ব্যস, সাথে সাথে ভাত বন্ধ; শুরু হয়ে যেত রবিনসন বার্লি খাওয়া, খেতে না চাইলে কিছুটা লেবুর রস মিশিয়ে তাকে সুঘ্রাণযুক্ত করা হতো। আর সেই সাথে চলতো একটু ভারী খাবার হিসেবে সাগু দানা। জ্বর ছেড়ে না যাওয়া পর্যন্ত এ পথ্যই চলতে থাকতো। খুব আপত্তি করলে মাঝে মাঝে কপালে জুটতো পাউরুটি টোস্ট।

দোকানে বা বাজারে যাওয়ার পথে আমাকে ভীষণভাবে আকৃ্ষ্ট করতো পথপার্শ্বে ক্যানভাসারদের চমকপ্রদ বিপণন কৌশলে নিবেদিত লেকচার এবং গান বাজনা, কখনো কখনো কিছুটা মূকাভিনয়ও। তখন আমরা থাকতাম কমলাপুরে। এখনকার রেল স্টেশন তখনো হয়নি। এখন যেখানে স্টেশন প্লাটফর্ম, তার একটু ওপাশেই বড় বড় নৌকা এসে ভীড়তো। তাতে বোঝাই থাকতো ‘সুন্দরী গাছ’ এর কাঠ। তখনো দেশে গ্যাস পাওয়া যায়নি। ঢাকাবাসীরা রান্নার জন্য জ্বালানী হিসেবে লাকড়ির চুলা ব্যবহার করতেন, কেউ কেউ করতেন ‘ভূষি’র চুলা’। সেই জ্বালানী কাঠ হিসেবে ‘সুন্দরী’ কাঠের খুব চাহিদা ছিল। ব্যাপারীরা সকালে নৌকা বোঝাই কাঠ এনে সারাদিনব্যাপী ঘরে ঘরে হাঁকডাক করে কাঠ বিক্রী করে বিকেলে আবার তাদের নৌকা করে দূর গ্রামে ফিরে যেতেন। তাদের সাথে আসতো কিছু বেদেনীর নৌকাও। বেদেনীরা নানা রঙ ঢঙ করে গান গেয়ে সাপের খেলা দেখাতো আর বাচ্চা বুড়ো নির্বিশেষে দাঁতের সমস্যায় আক্রান্ত ব্যক্তিদের দাঁত থেকে সাদা সাদা ‘পোকা’ বের করতো। পরে বড় হয়ে জেনেছি, ওদের ঐ পোকাগুলো ছিল সব ভূয়া। ওরা আলাদাভাবে একটা গোপন শিশির ভেতরে করে ঐসব পোকা নিয়ে আসতো। তবে খালি গলায় গাওয়া ওদের গানগুলো ছিল জনপ্রিয়, সুরও ছিল অনবদ্য। মাঝে মাঝে ওরা সাপ ছেড়ে দিয়ে দর্শকদেরকে ভয়ও দেখাতো।

আমি অবলীলায় পথের পাশে থমকে দাঁড়িয়ে এদের নিজস্ব কায়দায় সঙ্গীত নিবেদন উপভোগ করতাম। এর পরে যখন আরেকটু বড় হয়ে ট্রেনে বাসে একা একাই যাতায়াত শুরু করলাম, তখন ট্রেনের মধ্যে কিংবা ফেরী ঘাটে বাসের ভেতর ফকির ফকিরনীদের দ্বৈত সঙ্গীতের আমি থাকতাম গুণমুগ্ধ শ্রোতা। বোনারপাড়া রেলওয়ে জংশন থেকে একজন দোতারা বাদক বাউল সাধক উঠতেন, বোনারপাড়া থেকে গাইবান্ধা পর্যন্ত সাড়াটা রাস্তা তিনি দোতারার সাথে তার নিজের লেখা গান শোনাতে শোনাতে যেতেন। অবশেষে গাইবান্ধায় ট্রেন থামলে তিনি নেমে যেতেন। প্লাটফর্মে বসে এক কাপ গরম চা পান করে গাঁয়ের মেঠো পথ ধরে তিনি নিজ গৃহ অভিমূখে ধীর লয়ে হেঁটে যেতেন। অপূর্ব ছিল তার কন্ঠ এবং তার বাজনা। উপস্থাপনাও ছিল চমকপ্রদ।

আমার ছোটবেলার সেই অভ্যেসটা চিরদিনই রয়ে গেছে। বিদেশ ভ্রমণের সময়েও আমি যখনই কোন পথ-শিল্পী পেয়েছি, একটু থেমে তার গান শুনেছি। মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড, ইউএসএ’র নিউ ইয়র্ক, প্রভৃতি জায়গায় আমি এসব পথশিল্পীদের গান শুনে মোহিত হয়েছি। ইংরেজীতে এদেরকে ‘busker’ বলে, যারা পথের পার্শ্বে বা পথের কোন এক কোণের খোলা জায়গায় গান বাজনা করে পথচারীদের চিত্তবিনোদন করে এবং বিনিময়ে সামান্য কিছু আর্থিক সৌজন্য কামনা করে, তবে কখনোই কোন জোরাজুরি করেনা। কেউ সামান্য কিছু সহায়তা দিলেও হাসিমুখে তা একনলেজ করে।

আজ সকালে অস্ট্রেলীয় কবি Tania Montgomery এর “Ode To The Busker” নামের এই কবিতাটি পড়তে পড়তেই আমার এত কিছু মনে পড়ে গেলঃ

Ode To The Busker

I heard him at the sidewalk of the famous 'Times Square'
As he strummed his tunes on his guitar, with soulful words to bare
I watched the people just pass by, no-one had cared to see
His voice just telling stories of how old times used to be

I glanced upon his guitar case, there were no coins thrown in
His clothes of dustbin throw aways, all tattered, torn and thin
So I stopped and emptied all my coins and placed them in the case
He winked and smiled sincerely as he danced around the place

He stopped and asked me to request whatever came to mind
I said 'Mr Bojangles' is my favorite song, you're just too kind
And he played it well as people filled the case so easily
He smiled a smile I've never seen done so unpretentiously

If ever you walk by a place where a busker may just be
Please stop for a little moment and give him your charity
It isn't much to hand a coin or stop and clap with glee
Cause a busker just sings his heart out for all of us to see

-- By Tania Montgomery

ঢাকা
০৬ ফেব্রুয়ারী ২০১৯
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই অক্টোবর, ২০২২ রাত ৯:৩৫
১৪টি মন্তব্য ১৬টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। মুক্তিযোদ্ধা

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:২১



মুক্তিযুদ্ধের সঠিক তালিকা প্রণয়ন ও ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা প্রসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেছেন, ‘দেশের প্রতিটি উপজেলা পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধা যাচাই বাছাই কমিটি রয়েছে। তারা স্থানীয়ভাবে যাচাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতীয় রাজাকাররা বাংলাদেশর উৎসব গুলোকে সনাতানাইজেশনের চেষ্টা করছে কেন?

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:৪৯



সম্প্রতি প্রতিবছর ঈদ, ১লা বৈশাখ, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস, শহীদ দিবস এলে জঙ্গি রাজাকাররা হাউকাউ করে কেন? শিরোনামে মোহাম্মদ গোফরানের একটি লেখা চোখে পড়েছে, যে পোস্টে তিনি... ...বাকিটুকু পড়ুন

চুরি করাটা প্রফেসরদেরই ভালো মানায়

লিখেছেন হাসান মাহবুব, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৫৩


অত্র অঞ্চলে প্রতিটা সিভিতে আপনারা একটা কথা লেখা দেখবেন, যে আবেদনকারী ব্যক্তির বিশেষ গুণ হলো “সততা ও কঠোর পরিশ্রম”। এর মানে তারা বুঝাতে চায় যে তারা টাকা পয়সা চুরি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঘুষের ধর্ম নাই

লিখেছেন প্রামানিক, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:৫৫


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

মুসলমানে শুকর খায় না
হিন্দু খায় না গাই
সবাই মিলেই সুদ, ঘুষ খায়
সেথায় বিভেদ নাই।

হিন্দু বলে জয় শ্র্রীরাম
মুসলিম আল্লাহ রসুল
হারাম খেয়েই ধর্ম করে
অন্যের ধরে ভুল।

পানি বললে জাত থাকে না
ঘুষ... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইরান-ইজরায়েল দ্বৈরথঃ পানি কতোদূর গড়াবে??

লিখেছেন ভুয়া মফিজ, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:২৬



সারা বিশ্বের খবরাখবর যারা রাখে, তাদের সবাই মোটামুটি জানে যে গত পহেলা এপ্রিল ইজরায়েল ইরানকে ''এপ্রিল ফুল'' দিবসের উপহার দেয়ার নিমিত্তে সিরিয়ায় অবস্থিত ইরানের কনস্যুলেট ভবনে বিমান হামলা চালায়।... ...বাকিটুকু পড়ুন

×