অবশেষে লোকটাকে দেখা গেল, কালো ব্যাগটা হাতে নিয়ে আমার দিকে এগিয়ে আসতে। আমার কাছে এসে বললো ব্যাগের তালা খুলে দেখাতে। আমি এটা আগে থেকেই আন্দাজ করতে পেরে চাবিটা হাতের তালুতে বন্দী করে তৈরী হয়ে ছিলাম। ঝটপট তালা খুলে তাকে দেখালাম। সে এটা সেটা ঘেটে ঘুটে ব্যাগটা আমার হাতে দিয়ে এক গাল হেসে বললো, ‘উইশ ইউ এ হ্যাপী জার্নী স্যার’! ব্যাগের সবকিছু ঠিকভাবে বুঝে পেলাম কিনা তা দেখে নিতে বললো, কিন্তু আমার হাতে সে সময়টা কোথায়? এবারে সে আমাকে “স্যার” সম্বোধন করাতে কিছুটা অবাক হ’লাম। তবে এতক্ষণ ধরে তার জেরায় ত্যাক্ত-বিরক্ত হলেও তার শেষের শুভেচ্ছাটুকু পেয়ে মনে মনে খুশীই হলাম এবং তাকে অন্তর থেকেই একটা ধন্যবাদ জানিয়ে হ্যান্ডশেকের জন্য হাত বাড়িয়ে দিলাম।
প্রায় দৌড়ে এসে গাড়ীতে উঠলাম। মনে মনে ভাবলাম, ব্যাগ পেয়েছি, এখন ফ্লাইট না পেলেও তেমন বড় কোন ক্ষতি নেই। লক্ষ্য করলাম, আমি কিছু না বললেও ড্রাইভার এবারে আগের চেয়ে একটু বেশী গতিতে গাড়ী চালাচ্ছে। ২ নং টার্মিনাল থেকে ১ নং, ১ থেকে আবার ২, এবং সবশেষে ২ থেকে আবার ১ নং টার্মিনাল এর উদ্দেশ্যে যাচ্ছি। প্রতি ধাপে সময় লাগে কমপক্ষে আধা ঘন্টা, অথচ হাতে কাট অফ টাইম আছে মাত্র দশ পনের মিনিটের মত। অল্পের জন্য ফ্লাইটটা শেষ পর্যন্ত মিস করবো, এটা ধরেই নিলাম। তবুও ভাবলাম, শেষটা না দেখে রণে ভঙ্গ দিব না। প্রায় মাঝপথে কাট অফ টাইম উত্তীর্ণ হয়ে গেল। আমি নির্লিপ্তভাবে জানালা দিয়ে তাকিয়ে থাকলাম।
অবশেষে গন্তব্য এলো। গাড়ী থেকে লাগেজ নামানোর আগেই আবার সেই হলুদ জার্সি পরা অন্য একটি ছেলে কাছে এসে অনুমতি চাইলো। আমি শুধু তাকে এক নিঃশ্বাসে জিজ্ঞেস করলাম, এসজি ১৩০ ফ্লাইট ধরতে পারবো কিনা। সে নিজের হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে ‘যরুর কোশিষ করেঙ্গে’ বলে লাগেজ ট্রলীতে ওঠাতে লাগলো। ওর বস জাতীয় আরেকজন লোক এসে আমাকে দেড়শ’ রুপীর একটি টিকেট ধরিয়ে দিয়ে পরিশোধ করতে বললো। আমি দ্রুত টাকা বের করে তার হাতে দিয়ে ছুটলাম। সেই ছেলেটিও খুব দ্রুত ট্রলী ঠেলে নিয়ে প্রথমে আমাকে লাইনে দাঁড়াতে বলে চেক-ইন কাউন্টারের ম্যানেজার জাতীয় একজন লোকের কাছে গিয়ে কি যেন বললো। আমার সামনে তখনো দুইজন মহিলা যাত্রী, ফ্লাইটের আর মাত্র বিশ মিনিটের মত বাকী। ছেলেটি ফিরে এসে বললো, ‘স্যার মাত ঘাবরাইয়ে। বসকো হাম নে বাতায়া, আপকো চেক-ইন হো জায়েগা’। চেক-ইন কাউন্টারের মেয়েটি আমাকে জিজ্ঞেস করলো আমি আপগ্রেডেশন চাই কিনা। আমি সরাসরি না বললাম, আমার ছেলে লাগেজগুলো ওয়েইং স্কেলে তুললো। ট্যাগ লাগানো হলো, আমরা হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। ছেলেটির কর্মতৎপরতায় খুশী হয়ে তাকে পাওনার অতিরিক্ত কিছু টিপস দিয়ে ধন্যবাদ ও শুভকামনা জানিয়ে বোর্ডিং ব্রীজের দিকে যাত্রা করলাম। বিদায় দিল্লী! তবে দুটো হলুদ জার্সী মনে গেঁথে র'লো।
আমরা ছিলাম সেদিনের সেই প্লেনের শেষ যাত্রী। তাই আমাদের তিনজনের আসন তিন জায়গায় দিয়েছিল, যেখানে যেখানে খালি ছিল। এবং তিনটা সীটই মাঝখানের আসনে। আমি একজন তরুণকে অনুরোধ করে বললাম, সে এক সারি পেছনে বসতে রাজী কিনা, যেন আমরা স্বামী স্ত্রী একসাথে পাশাপাশি আসনে বসতে পারি। সে ভদ্র ছেলেটি নিঃসংকোচে রাজী হয়ে পেছনে চলে গেল। আমাদের সারিতে জানালার পাশের আসনে একজন তরুণী একটা এক/দেড় বছরের বাচ্চা কোলে নিয়ে একাই দিল্লী থেকে শ্রীনগর যাচ্ছিল। প্লেনে বসার সাথে সাথে একজন বিমানবালা পানি অফার করলো। স্পাইসজেটে বিনামূল্যে পানি ছাড়া ওরা আর কিছু দেয় না। আমি ছোট ছোট দুই গ্লাস পানি পান করে পকেট থেকে সেলফোন বের করে দেখি মানযুর ইতোমধ্যে বেশ কয়েকটা কল করেছিল। আমি তাকে কল করে জানালাম, আমি প্লেনে বসেছি। একথা শুনে সেও যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো। ‘আলহামদুলিল্লাহ’ বলে সে যে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো, তার শব্দটা যেন শ্রীনগর থেকে বাতাসে ভর করে দিল্লীর এ প্লেনের ভেতরে ঢুকে আমার কানে এসে ঠেকলো। আমি গাড়ীচালক শাফিকেও কল করে জানালাম যে আমরা ঠিকমত প্লেনে বসেছি। প্লেন ঠিক সময়েই ছাড়বে। সে যেন আমাকে শ্রীনগর বিমান বন্দর টার্মিনালের বাইরে খুঁজে নেয়। অবশেষে ১১টা ২০ এর ফ্লাইটের প্লেনটি ১১টা ১৬তেই নড়াচড়া শুরু করলো। ১২ মিনিট ট্যাক্সিইং করে ১১টা ২৮ মিনিটে রানওয়ে ত্যাগ করে আকাশে উড়াল দিল। অবসান হলো এক দুঃস্বপ্নের, শুরু হলো এক সুখস্বপ্নময় অধ্যায়ের। প্লেনটির সাথে সাথে আমারও ভাবনাগুলো রৌদ্র করোজ্জ্বল নীলাকাশে পাখা মেলে দিল।
প্রায় চল্লিশ মিনিট ঊর্ধ্বাকাশে উড্ডয়নের পর অবতরণের প্রস্তুতি হিসেবে প্লেনটি যখন ধীরে ধীরে নীচে নামা শুরু করলো, তখন জানালার পাশে বসা সেই তরুণী মাতার পুত্রধন কান্না শুরু করে দিল। আস্তে আস্তে সে কান্না প্রকট হতে শুরু করলো। তরুণীটি কিছুতেই তার কান্না থামাতে পারছিল না। এক পর্যায়ে সে বিরক্তি প্রকাশ করতে লাগলো। পাশে বসা আমার স্ত্রীও এটা সেটা দেখিয়ে তাকে ভোলাতে চেষ্টা করলো, কিন্তু শিশুর কান্না কিছুতেই থামে না। আমিও বাচ্চাটাকে কোলে তুলে নিয়ে ভোলাতে চেষ্টা করলাম, কিন্তু সব চেষ্টাই ব্যর্থ হলো। প্লেন যতই নীচে নামছে, কান্না ততই বাড়ছে। একবার মনে হলো, প্লেনের উচ্চতা দ্রুত কমে আসার কারণে হয়তো তার কানে কোন অসুবিধা হতে পারে। ওর কান দুটোকে দু’হাত দিয়ে চেপে ধরলাম। তাও কান্না থামে না। এক সময় বুঝতে পারলাম, ওর কান্না কি কারণে থামছে না। কিন্তু অবতরণমুখী প্লেনে ঠিক ঐ মুহূর্তে সেই কারণটি দূর করার কোন উপায় ছিল না। ওকে ওর মায়ের কোলে ফিরিয়ে দিলাম, কাঁদতে কাঁদতে ক্লান্ত হয়ে এক সময় ছেলেটার কান্না থেমে এলো। ১২টা ৩৮ মিনিটে প্লেন ভূমি স্পর্শ করলো। তারপর ধীরে ধীরে ট্যাক্সিইং করে ১২টা ৪২ মিনিটে বোর্ডিং ব্রীজে এসে ঠেকলো। নির্ধারিত এ্যারাইভাল টাইম ছিল ১২টা ৪৫ এ।
শ্রীনগর বিমান বন্দরের ওয়াশরুমে গিয়ে দেখি আমাদের গুলোর মতই সেটার দুরবস্থা। কোন রকমে একটু ফ্রেশ হয়ে নিয়ে বের হয়ে দেখি আমার ছেলে এবং স্ত্রী ট্রলীতে লাগেজ সংগ্রহ করে প্রস্থানের জন্য প্রস্তুত। আমি ছেলেকে বললাম, ড্রাইভার শাফিকে একটা কল দাও। সে জানালো, কল দেয়ার চেষ্টা করেছে, কিন্তু এখানে শুধু শ্রীনগরের সিম ছাড়া অন্য প্রিপেইড সিম অচল। পোস্ট পেইড হলে যে কোন সিম ব্যবহার করা যায়। আমাদের দু’জনার কাছে দুটো ভারতীয় প্রিপেইড সিম ছিল, সেগুলো কাশ্মীরে অচল হয়ে রইলো। যাহোক, টার্মিনাল থেকে বের হবার সময় অনেক ট্যাক্সিওয়ালা এগিয়ে আসছিল, ট্যাক্সি লাগবে কি না, তা জানতে। আমি তাদের একজনকে জানালাম যে আমার গাড়ীর ব্যবস্থা আগে থেকে করা আছে, কিন্তু আমি আমার ফোন থেকে চালককে কনট্যাক্ট করতে পারছি না। সে আমার কাছ থেকে ফোন নাম্বারটা নিয়ে নিজেই কল দিল। সেই ট্যাক্সিচালকের স্বতঃস্ফূর্ত সাহায্যের জন্য তাকে ধন্যবাদ জানালাম এবং তার জন্য মন থেকে দোয়া করলাম। অন্যের প্রতি এ ধরণের ছোট ছোট ইহসান আল্লাহ তা’লার কাছ থেকে অনেক বড় বিনিময় এনে দিতে পারে, এ আমি মনে প্রাণে বিশ্বাস করি। কিছুক্ষণের মধ্যেই বান্দা শাফি হাজির! দূর থেকেই একটা হাসিমুখ আর লম্বা সালাম উপহার দিয়ে আমাদের উৎকন্ঠা দূর করলো। তার সম্বন্ধে অনেক কিছুই বলার আছে। সেটা না হয় বলা যাবে অন্য কোন পর্বে।
যেহেতু আমি এ কাহিনীর প্রথম পর্বের প্রথম অনুচ্ছেদেই বলেছিলাম যে আমরা কাশ্মীর সফর শেষে দেশে ফিরেছি, সেহেতু এ কাহিনীর এন্ড রেজাল্ট সব পাঠকেরই জানা ছিল, অর্থাৎ ব্যাগ হারাক আর যাই হোক, আমরা কাশ্মীর যেতে পেরেছিলাম। তারপরেও অনেক পাঠক মন্তব্যে জানিয়েছেন যে তারা সিরিজটি পড়তে পড়তে কাহিনীর উত্তেজনায় রোমাঞ্চিত ও উৎকন্ঠিত। তবে আমাদের কাছে সেদিন এন্ড রেজালট টা জানা ছিলনা, তাই আমাদের উত্তেজনা ও উৎকন্ঠার কোন মাত্রা ছিল না। তার পরেও আমরা সেদিন সকল উত্তেজনা অতিক্রম করে অবশেষে মাথা ঠান্ডা রেখে সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছিলাম, এবং সামনে এগিয়ে যাওয়া অব্যাহত রেখেছিলাম, এজন্য সকল গতির নিয়ন্ত্রকের কাছে হৃদয় নিঙরানো কৃতজ্ঞতা জানিয়ে এ কাহিনীর এখানেই ইতি টানছি।
চরম উৎকন্ঠাময় এ কাহিনী আপাততঃ সমাপ্ত! তবে এ কাহিনী থেকে কিছু শিক্ষনীয় বিষয়ঃ
*বোর্ডিং বা ডিপার্টিং ফ্লাইটের ডিপার্চার/এ্যারাইভাল টার্মিনালের নম্বরটা আগে থেকে জেনে রাখতে হবে।
*কোন বিপর্যয়ে আশাহত হলে চলবে না। শেষ চেষ্টা করে দেখতে হবে।
*বিমান ভ্রমণের জন্য নির্দ্দিষ্ট সময়ের চেয়ে কিছুটা বেশী সময় হাতে নিয়ে রওনা হতে হবে।
ঢাকা
১২ মে ২০১৯
এই সেই কাঁধে ঝোলানো কালো ব্যাগ!
এই সেই কাঁধে ঝোলানো কালো ব্যাগ!
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই জুন, ২০১৯ দুপুর ২:৩৫