কেবল্ কারে করে ফিরে আসার সময় নীচে তাকিয়ে দেখলাম, একটা জরাজীর্ণ মাসজিদ যা এতদিনে বরফে ঢাকা ছিল, বরফ সরে যাবার পরে তা আবার মাথা উচু করে দাঁড়িয়ে আছে। টিন ও মাটির দেয়াল ঘেরা এ মাসজিদটিকে ছোটবেলায় গ্রামে গঞ্জে হাটে বাজারে যে রকম জীর্ণ মাসজিদ দেখতে পেতাম, আমার কাছে অনেকটা সেরকমই দেখতে মনে হলো। প্রতি বছর এটা বরফের নীচে ছয় মাস ঢাকা পড়ে থাকে, আবার বরফ গলে গেলে মাথা বের করে আবির্ভূত হয়। মনে হলো, কেবল্ কার দেখতে ও চড়তে আসা ট্যুরিস্ট এবং সেখানে কর্মরত ব্যক্তিদের জন্যই এ মাসজিদটি নির্মাণ করা হয়েছিল।
সকালে গুলমার্গের উদ্দেশ্যে বের হবার আগে আমরা হোটেল থেকে একেবারেই চেক-আউট করে বের হয়েছিলাম, কারণ সেদিনের রাত্রিতে আমাদের জন্য ডাল লেইকে ভাসমান একটা বোট হাউসে থাকার ব্যবস্থা নির্ধারিত ছিল। সন্ধ্যের কিছু আগে আমাদের গাড়ী ডাল লেইকের সাত নম্বর ঘাটে এসে থামলো। শাফি লেইকের অপর পাড়ের দিকে আঙুল তুলে দেখিয়ে বললো, ‘ঐ বোট হাউসটিতে আপনারা আজ রাতে থাকবেন। ইন শা আল্লাহ, আগামীকাল সকালে আমি ঠিক এখান থেকে আপনাদেরকে নিয়ে প্যাহেলগামের উদ্দেশ্যে রওনা হবো’। এই বলে ও কাকে যেন ফোন করলো। একটু পরেই দেখি, একটি বোট আমাদের ঘাটের দিকে এগিয়ে আসছে। শাফি এবং সেই বোটের মাঝি মিলে আমাদের লাগেজগুলো বোটে তুলে ফেললো। তারপর শাফি আমাদের থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেল, আমরা বোটে উঠে জলে ভাসতে ভাসতে যেন সারাদিনের ক্লান্তির কথা বেমালুম ভুলে গেলাম, যদিও সে জার্নিটুকু ছিল শুধু লেইকের এপাড় থেকে ওপাড়। শুধু ওপাড়ে গিয়ে আমাদের জন্য নির্দ্দিষ্ট বোটহাউসে আমাদের লাগেজগুলো নামিয়ে মাঝি আবারো এক ঘন্টার জন্য লেইকে আমাদেরকে ঘোরাবে, এমন ব্যবস্থাই আগে থেকে করা ছিল। এই ঘোরাঘুরির নামটা “শিকারা”। আমাদের ফ্রেশ হয়ে ওঠার জন্য যতটুকু সময়ের প্রয়োজন, বোটহাউসে ঠিক ততটুকু সময় থেকে আমাদেরকে তাড়াতাড়ি বের হবার জন্য মাঝি উপদেশ দিল, কারণ তখন সূর্যাস্ত আসন্ন।
বোটে যখন উঠলাম, তখন সূর্যটা ডুবু ডুবু। মাঝি তাড়াতাড়ি আমাদেরকে নিয়ে বের হয়ে পড়লো। বোটে উঠে বুঝলাম, আমাদের অন্ততঃ আরো আধ ঘন্টা আগে রওনা হওয়া উচিত ছিল। বোটে ওঠা থেকেই কোথা থেকে যেন আরেকটা বোট এসে আমাদেরটার সাথে ঘেঁষে ঘেঁষে বাইতে থাকলো। সেই বোটের মাঝি আমাদেরকে অনুরোধ করলো, আমরা যেন তার ‘ফিশ বারবিকিউ’ টার একটু স্বাদ পরখ করে দেখি। আমরা প্রথমে না না করলেও, তার উপর্যুপরি অনুরোধে রাজী হ’লাম। ধীরে বহমান বোটে সেদিনের সেই সন্ধ্যায় তার সেই ‘ফিশ বারবিকিউ’ টা টেস্ট না করলে আমরা বিরাট মিস করতাম। খুবই সুস্বাদু এবং মুখরোচক ছিল সেটা। এক প্লেট করে খেয়ে আবারো সেটা খেতে ইচ্ছে হলো। কিন্তু ততক্ষণে চারিদিকে খোঁজাখুজি করেও সেই মাঝির আর দেখা পেলামনা। পরে অবশ্য আরও কিছু ভেন্ডার পাশে ভিড়েছিল, কিন্তু তাদের সামগ্রীর প্রতি আমাদের কোন আগ্রহ ছিলনা। এরই মধ্যে আমাদের মাঝিকে ক্বিবলার দিক সম্বন্ধে জিজ্ঞেস করাতে সে বুঝতে পারলো, আমরা বোটে বসেই মাগরিবের নামায পড়তে চাচ্ছি। সে সাথে সাথে নৌকোটিকে ক্বিবলামুখী করে স্থির করে রাখলো এবং আমাদেরকে নামায শুরু করতে বললো। আমরা তিনজন সেই সন্ধ্যায় বোটে বসেই মাগরিবের নামায পড়ে নিলাম। আমাদের নৌকোটাকে স্থির হতে দেখে আশে পাশের কিছু মাঝি ভাবলো, আমাদের নৌকোয় বোধহয় কিছু সমস্যা হয়েছে। ওরা কাছে এসে আমাদের মাঝিকে সমস্যার কথা জিজ্ঞেস করাতে মাঝি তাদেরকে জানালো যে আমরা নামায পড়ছি। একথা শুনে ওরা চলে গেল।
সেদিনের সন্ধ্যায় ডাল লেইকে আমরা যে ঘন্টাখানিক সময় নৌকোয় কাটিয়েছিলাম, তা স্মরণ করতে এখনো আমার খুব ভাল লাগে। হ্রদের বুকে অত্যন্ত ধীর গতিতে ভাসমান আমরা, কখনো ঝলমলে আলোকোজ্জ্বল ভাসমান বিপণী বিতান অতিক্রম করছি, কখনো আবছা আলোয় হাস্যোজ্জ্বল অন্য অতিথিভরা নৌকো আমাদেরটাকে অতিক্রম করছে, আবার কখনো বেশ অন্ধকারের মধ্য দিয়েই জলজ গাছ গাছড়ার ভেতর দিয়ে আমাদের নৌকো অতিক্রম করার সময় শুনতে পাচ্ছিলাম সতর্ক পাখিদের ডানা ঝাপটানোর শব্দ। মাঝে মাঝে আমাদের দেশের ডাহুক, পানকৌড়ির ডাকের মতও শব্দ শুনতে পাচ্ছিলাম। আর বিরহী ব্যাঙের ডাক তো ছিলই। আমি একা বাসায় মাঝে মাঝে গলা ছেড়ে গান গাই। কেউ সামনে আসলে গান বন্ধ হয়ে যায়। স্ত্রীর সামনে মাঝে মাঝে গানের সুর ভাঁজলেও, ছেলেদের সামনে কখনো গান গাই না। এটা আমাদের একটা জিনেটিক দোষ। ছোটবেলায় আমার আপাতঃ কঠোর আব্বা একদিন হঠাৎ করে আমার কাছে একটি গান শুনতে চাইলে নিদারুণ লজ্জায় মরে যাচ্ছিলাম! আমার ছোট ছেলেও খুব সুন্দর গান গায়, গীটার বাজায়। আমি ও আমার স্ত্রী যখন আমেরিকা সফরে যাই, তখনই জীবনে প্রথম সে আমাদের কাছে একটি গীটার আনার জন্য অনুরোধ করেছিল। এর আগে সে কোনদিন কোন কিছুর জন্য অনুরোধ বা আব্দার করেনি। মাঝে মাঝে মধ্যরাতে আমি ওর গলা ছেড়ে গাওয়া গান শুনতে পাই। আমি কখনো কখনো চুপি চুপি ওর দরজার আড়ালে গিয়ে শুনি। ও টের পেলে সাথে সাথেই গান বন্ধ হয়ে যায়। এটাই আমাদের সেই জিনেটিক দোষ! কিন্তু সেদিনের সেই সন্ধ্যায় আমি সেই দোষকে অতিক্রম করতে পেরেছিলাম। মনের আনন্দে কয়েকটা গান, যতটুকু জানি, গেয়ে ফেলেছিলামঃ আমায় ভাসাইলি রে, আমায় ডুবাইলি রে; মাঝি বাইয়া যাও রে.... ইত্যাদি। হয়তো আমার ছেলে আমার গলায় সেসব গান শুনে সেদিন অনেকটা অবাকই হয়েছিল।
ভাসতে ভাসতে একসময় আমরা “রয়্যাল কাশ্মীর” নামে একটি ঝলমলে ভাসমান দোকান অতিক্রম করছিলাম। আমার স্ত্রী মাঝিকে সেই দোকানটার পাশে নৌকো থামাতে বললো। আমাকেও নামতে বললো, কিন্তু আমি সেই অনুপম সন্ধ্যার নৈসর্গিক দৃশ্য ছেড়ে বিপণী বিতানে প্রবেশ করতে নিমরাজী ছিলাম। অগত্যা সে আমার ছেলেকে নিয়েই ভেতরে গেল। আমি নৌকোয় বসে বসেই সেলফোন দিয়ে ছবি তুলতে থাকলাম, ভিডিও চিত্রও ধারণ করলাম কয়েকটা, আর থেকে থেকে গলা ছেড়ে এক আধটা গান গাইতে থাকলাম। মানুষের মনে আনন্দ থাকলে বোধহয় কন্ঠে এমনি এমনিই গান চলে আসে। আমাদের নৌকোটা “রয়্যাল কাশ্মীর” এর সামনে নোঙর করানোর পুরস্কার হিসেবে দোকান মালিকের পক্ষ থেকে আমাকে এবং মাঝিকে এক কাপ গরম চা অফার করা হলো। আমি ধন্যবাদ জানিয়ে ফিরিয়ে দিলাম, মাঝি চা খেতে খেতে আমার গান শুনতে লাগলো। কাশ্মীরি মাঝিটা সে গানের কী বুঝলো কে জানে, একটা গান শুনে সে বলে উঠলো, "স্যার, ইয়ে গানা বাহুত আচ্ছা হ্যায়"। একটু পরেই দেখলাম, আমার স্ত্রী খুব খুশী মনে বের হয়ে আসছে। হাতে একটা ব্যাগ। জিজ্ঞেস করলাম, ‘কী কিনলা?’ সে ব্যাগ থেকে বের করে দেখালো, আমাদের সবার ছোট্টমনি, নাতনি আনায়ার জন্য একটা ড্রেস। সেটা দেখে আমার খুশীটা মনে হয় ওরটাকেও অতিক্রম করে গেল! এভাবে জলে ভাসতে ভাসতে খুব দ্রুতই আমাদের দেড়টা ঘন্টা কেটে গেল। আমরা বোট হাউসে ফিরে এলাম।
ফিরে এসে দেখি বোট হাউসে মানযুর আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে। সে আমাদের ভালমন্দ জিজ্ঞেস করে আমাদেরকে পরের দিনের প্যাহেলগাম সফর সম্পর্কে ব্রীফিং দিল। আর তার পরের দিন আমাদের প্যাহেলগাম থেকে সরাসরি শ্রীনগর বিমান বন্দরে ফিরে দিল্লী হয়ে কোলকাতাগামী ফ্লাইট ধরার কথা। হয়তো ওর সাথে আর দেখা হবেনা, এমনটা ভেবে আমি ওকে ওর পাওনা টাকা-পয়সা পরোপুরি মিটিয়ে দিলাম। পাওনা বুঝে নিয়ে সে রাতে মানযুর চলে যাবার পর আমি আমাদের বোট হাউসের পরিচারককে ডেকে ডিনার লাগাতে বললাম। ওর নাম জিজ্ঞেস করাতে ও বললো, ‘ফররোখ আহমদ’। আমাদের দেশে যেটাকে আমরা ‘ফারুক আহমেদ’ ডাকি। লক্ষ্য করেছিলাম, মানযুরও ওকে ‘ফররোখ আহমদ’ই সম্বোধন করেছিল। ফররোখকে আগেই বলে রেখেছিলাম আমাদের তরকারিতে একটু ঝাল কম দিতে। ডিনারের সময় সে বারে বারে আমাদের কাছে এসে আমাদের অভিব্যক্তি দেখে বুঝতে চেষ্টা করছিল, ওর রান্না আমাদের জন্য উপাদেয় হয়েছে কিনা। শেষ পর্যন্ত থাকতে না পেরে এক সময় জিজ্ঞেসই করে বসলো। আমরা ওর রান্নার প্রশংসা করলাম। এটা শুনে সে খুশীতে গদগদ হয়ে জানালো, আগামী পাঁচ দিনের জন্য আমরাই ওর শেষ অতিথি। কারণ, ‘বাহুত তাকলিফ সে পাঁচ দিন কা ছুট্টি মিলা’! জিজ্ঞেস করলাম, বাড়ী কোথায়? সে জানালো, ‘গুলমার্গ’, যাঁহাসে আপ আজ ঘুমকে আয়া’। পরেরদিন সকালে নাস্তায় আমরা কে কী খেতে চাই, ও জিজ্ঞেস করে সবকিছু নোট করে নিল। বিদায় নেয়ার আগে সে আমাদেরকে সেই রাতের নিবাস “নিউ চেরী রাইপ” বোটহাউসের ওয়াই ফাই এর ‘পাসওয়ার্ড’ টা দিয়ে গেল। আমরা আমাদের ক্লান্ত অবসন্ন দেহ বিছানায় এলিয়ে দিয়ে আন্তর্জালিক বিচরণ করতে করতে কিছুক্ষণের মধ্যেই সবাই ঘুমিয়ে পড়লাম।
চলবে...
ঢাকা
২০/২৯ মে ২০১৯
কয়েকটি বোট হাউস
প্রস্তুতি - ফিশ বারবিকিউ
প্রস্তুতি - ফিশ বারবিকিউ
ডিসপোজেবল প্লেটে পরিবেশিত প্রস্তুতকৃত ফিশ বারবিকিউ
আরেকজন ভেন্ডার
পাটাতনের নীচে চাপা পড়ছে জলের শোভা, একগুচ্ছ জলজ ফুল
বলুন তো, এসব গাছপালা কি পাহাড়ের উপত্যকায়, নাকি সমতল ভূমিতে?
"কখনো আবছা আলোয় হাস্যোজ্জ্বল অন্য অতিথিভরা নৌকো আমাদেরটাকে অতিক্রম করছে"
"ভাসতে ভাসতে একসময় আমরা “রয়্যাল কাশ্মীর” নামে একটি ঝলমলে ভাসমান দোকান অতিক্রম করছিলাম"।
মাগরিবের ওয়াক্ত হয়ে গেলে মাঝি নৌকো স্থির করে রেখে আমাদেরকে নামায পড়ে নিতে বললো।
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে জুন, ২০১৯ বিকাল ৪:৩০