পূর্বের পর্বটি পড়তে পারবেন এখানেঃ মেলবোর্নের দিনলিপিঃ ঘরে ফেরা, অনিশ্চিত পথে...(৪)
ফেইসবুকে বিকল্প পন্থায় পারিবারিক চ্যাট যখন শেষ করে উঠলাম, তখন পড়ন্ত বেলা। আজ রাতেই দুটো ভিন্ন ফ্লাইটে আমাদের সাত জনের মধ্যে দু’জন দু’জন করে চারজন চলে যাবেন, যথাক্রমে রাত নয়টার ও সাড়ে নয়টার ফ্লাইটে। বাকী থাকবো আমরা স্বামী স্ত্রী দু’জন, আর কানাডার মেয়ে রোযালী। বিদেশ বিভূঁই এ প্রতিকূল পরিস্থিতিতে অসম বয়সী এই সাতজনের মধ্যে তাৎক্ষণিকভাবে গড়ে ওঠা বন্ধুত্বে যবনিকাপাত হতে চলেছে। দেখলাম, যারা চলে যাবেন, তারা আস্তে আস্তে এদিকে সেদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা তাদের বিভিন্ন জিনিসপত্র গুটিয়ে নিচ্ছেন। কিয়াল তখনো তার ল্যাপটপ থেকে একে ওকে মেসেজ পাঠাচ্ছেন, যা সেলফোন থেকে করা সম্ভব নয়। ইমার মন বেশ ভারী। এ সামান্য পরিচয় এবং কথাবার্তায় যেটুকু বুঝেছি, উনি খুব আবেগতাড়িত একজন মানুষ। প্রায়ই কথা বলতে বলতে তার চোখ ছল ছল করে ওঠে, দুঃখের কথায় যেমন, আনন্দ ও সুখের কথায়ও তেমনি। তার পিতা মাতার মাঝে বিচ্ছেদের পর তিনি পিতার পক্ষই নিয়েছেন। আলাপে সালাপে তিনি বলেছেন, তিনি প্রায়ই হতাশায় ভোগেন এবং এজন্য তাকে ঔষধও সেবন করতে হয়। ইমা প্রস্তাব রাখলেন, আমাদের এ সাময়িক বন্ধুত্বকে স্মরণ রাখার জন্য আমরা সবাই মিলে একটা গ্রুপ ছবি তুলতে পারি কিনা। আমরা সবাই সানন্দে রাজী হ’লাম। কোন বাছ বিচার না করে একটা জায়গায় সবাই জড়ো হ’লাম। সর্বকনিষ্ঠ রোযালী বললো, সে একটা সেলফী তুলে সবাইকে পাঠাবে। বয়স হিসেবে স্বভাবসুলভ তার দ্বিতীয় প্রস্তাব, ছবি একটা হবে স্বাভাবিক পোজে, আরেকটা হবে “ক্রেজী পোজ” এ। তার দ্বিতীয় প্রস্তাবটার কথা শুনে আমি একটু ভয় পেয়ে গেলাম। তাকে জিজ্ঞেস করেই বসলাম, “ক্রেজী পোজ” টা আবার কী? তিনি হেসে একটু অঙ্গভঙ্গী করে দেখালেন। বুঝলাম,“ক্রেজী পোজ” কথাটার অর্থ To make a face, অথবা ইংরেজরা যাকে বলে To pull a face। ও তিন সেকেন্ডের টাইমার সেট করে সবাইকে “ক্রেজী পোজ” দিতে বললো। ওর কান্ড দেখে আমার হাসি চাপতে চাপতেই ক্যামেরা ক্লিক হয়ে গেল।
ছবি তোলার পর রোযালী তার একটা বড় চকোলেট এর প্যাকেট খুলে সবার সামনে মেলে ধরে চকোলেট তুলে নিতে অনুরোধ করলেন। আমরা সবাই একটা একটা করে কিটক্যাট চকোলেট তুলে নিলাম। ইমার প্রস্তাব অনুযায়ী আমরা কার বয়স কত হবে, তা গেস করতে থাকলাম। শেষে দেখা গেল ২/১ বছরের ব্যবধানে আমি ও আমার স্ত্রী মোটামুটি ঠিকভাবেই ওদের বয়স আন্দাজ করতে পেরেছি। আর আমাদেরকে খুশী করতেই কিনা, ওদের আন্দাজটা ছিল আমাদের আসল বয়সের চেয়ে দশ বছর কম, উভয়ের ক্ষেত্রে। ইমা আমার পেশা সম্বন্ধে জিজ্ঞেস করলো। আমি গেস করতে বললাম। ইমা বললো ডিপ্লোম্যাট। কিয়াল বললো সায়েন্টিস্ট (ফারদেস্ট ফ্রম ট্রুথ!) আর রোযালী বললো প্রফেসর!
এরই মধ্যে চায়না সাউদার্ন এর একজন স্টাফ এসে মীল বক্স দিয়ে গেল। কিয়াল ও ইমা খেতে বসে গেলেন, কারণ ওনারা সবার আগে চলে যাবেন। মাগরিব এর নামায পড়ে উঠে দেখি লস এঞ্জেলিসগামী দুই মহিলাও খেতে বসেছেন। আমরাও বসলাম। খাওয়া শেষে আবার টুকটাক গল্প। এর মধ্যে নতুন কিছু যাত্রী এলেন, তারা আমাদের থেকে দূরে দূরে থাকলেন। মনে হলো, চেয়ার ছেড়ে, মাস্ক, গ্লাভস খুলে আমাদের কারো কারো মেঝেতে বসে গল্প করা দেখে ওনারা অবাক হলেন। এর মধ্যে একজন মহিলা একত্রে দুটো চেয়ার মিলিয়ে সটান শুয়ে পড়লেন। রাত সোয়া আটটায় চায়না সাউদার্ন এর একজন স্টাফ এসে কিয়াল ও ইমাকে ডেকে নিয়ে গেলেন তাদের বোর্ডিং গেইটের দিকে। হাই, বাই, বলে ওরা চলে গেল, ওদের চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থেকে কিছুটা বিষণ্ণ বোধ করলাম।
রাত নয়টায় আবার চায়না সাউদার্ন এর একজন স্টাফ এলেন। একই ড্রিল। নাম ডেকে পাসপোর্ট চেক করে, সাথে করে বোর্ডিং গেইটের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া এবং সেখানকার স্টাফের কাছে হস্তান্তর করা। লস এঞ্জেলিসগামী দুই মহিলাও আমাদের থেকে বিদায় নিয়ে ওদের সাথে চলে গেলেন। ওরা চলে যাবার পর, ওরা যেখানে চাদর বিছিয়ে শুয়েছিলেন, রোযালী সেখানে তার ব্যাকপ্যাক খুলে তার শোয়ার আয়োজন করতে থাকলেন। আমরা থেকে গেলাম আমাদের জায়গায়, ওর কাছাকাছি। কিছুক্ষণ পর শুয়ে শুয়ে দেখলাম প্রথমে কিয়ালদের প্লেনটা উড়ে গেল, তার পরে ওদেরটা। উভয়কে মনে মনে বললাম, “বন ভয়াজ”!
পরেরদিন সকালে উঠে আমি লাউঞ্জেই কিছুক্ষণ হাঁটাহাটি করলাম। মাঝে মাঝে থেমে গরম পানি খেয়ে আসি, পিপাসার কারণে নয়, করোনা প্রতিরোধক সাময়িক ব্যবস্থা হিসেবে। তারপর আশে পাশের বিপণিগুলোতে একটু ঢুঁ মারতে গেলাম। উদ্দেশ্য কোন খাবারের দোকান পাওয়া যায় কিনা তার খোঁজ করা। হাঁটতে হাঁটতে একটা চীনা রেস্তোরাঁ পেয়ে গেলাম। সেখানে বীফ-নুডল এবং স্যুপ পাওয়া যাবে ৫৮ ইউয়ানে। তুলনামূলকভাবে দাম বেশী বলে মনে হলো না। আমি প্রওন স্যুপ কিংবা ভেজিটেবল স্যুপ পাওয়া যাবে কিনা জিজ্ঞেস করলাম। উত্তর পেলাম নেতিবাচক। আমার প্রশ্ন শুনে দোকানী বুঝে গিয়েছিল আমার সন্দেহটা কোথায়। সে নিজ থেকেই বললো এটা হালাল দোকান। আমার মুখে বিস্ময়ের ভাব দেখে সে তার দোকানে রাখা হালাল সার্টিফিকেট দেখালো। আমি অনেকটা আশ্বস্ত হলাম। বললাম, বিকেলে আমার স্ত্রীসহ এসে স্যুপ আর বিফ-নুডলস খেয়ে যাবো।
এরপরে একটি স্টোরে ঢুকে খোঁজ করলাম অরেঞ্জ জুসের। সবাই বলছে ভিটামিন-সি খেতে হবে। অরেঞ্জ জুসে সেটা পাবো বলে ধারণা করলাম, জুস পেয়েও গেলাম। ফ্রীজ খুলে তিনটে অরেঞ্জ জুসের বোতল কিনে আবার ট্রানজিট এলাকায় ফিরে এলাম। এসে দেখি গিন্নী চেয়ারে বসে আছে, আর তার পায়ের কাছে মেঝেতে বসে রোযালী গল্প করছে। মনে হলো যেন মা ও মেয়ে গল্প করছে। আমি এসে সে গল্পে যোগ দিলাম। রোযালী বিভিন্ন দেশে তার ভ্রমণের গল্প করছে। ফাঁকে ফোঁকরে সে তার পরিবার সম্বন্ধেও কিছু ধারণা দিয়ে যাচ্ছে। ওরা এক ভাই এক বোন, ভাইটা ওর ছোট। মা একজন স্কুল শিক্ষক ছিলেন, কিন্তু এখন শিক্ষকতা করেন না। শিক্ষা সংক্রান্ত কিছু সামাজিক কাজের সাথে জড়িত আছেন। বাবার পেশার কথাও কি যেন একটা বলেছিলেন, কোন এক কোম্পানীতে, কি কাজ সেটা ভুলে গিয়েছি। ফরাসী বংশোদ্ভূত ওরা দুই জেনারেশন ধরে পুরোপুরি কানাডিয়ান।
ইত্যবসরে অসম বয়সী এবং ভিন্ন দৈহিক কাঠামোর এক দম্পতি এলেন নতুন ট্রাঞ্জিট যাত্রী হিসেবে। ওনারাও যাবেন লস এঞ্জেলিসে। পুরুষজন লম্বা, লালচে ফর্সা, সুঠামদেহী, বয়স সত্তরের উপর, কিন্তু ফিট লুকিং।। তার সাথের মহিলা দেখতে আমাদের যে কোন এক বাঙালি নারীর মত, মধ্যবয়সী। গড়-মাঝারি উচ্চতার, শ্যামবর্ণের। আসার পরেই সেই যে তিনি ঘুমিয়ে পড়লেন, ঘুমিয়েই থাকলেন। ভদ্রলোকের সাথে টুকটাক কথা হলো। তিনি জানালেন, তিনি থাকেন ক্যালিফোর্নিয়ায়। সাথের মহিলা একজন ক্যাম্বোডিয়ান, তার স্ত্রী। ক্যালিফোর্নিয়ায় চায়না সাউদার্ন এর সরাসরি ফ্লাইট না থাকায় ওনারা লস এঞ্জেলিস হয়ে যাচ্ছেন। পেশায় তিনি একজন সাইকোলজিস্ট এবং তার স্ত্রী একজন সঙ্গীত শিল্পী ও গীতিকার। ভদ্রলোক চমৎকার ইংরেজী বলেন, অনেকটা ‘ভয়েস অভ আমেরিকা’র ইংরেজী অনুষ্ঠানের বক্তাদের/সঞ্চালকদের মত- পরিস্কার এবং স্পষ্ট। মৌখিক কথাবার্তায় তিনি এমন চমৎকার শব্দ চয়ন করে কথা বলেন যে শুনে মনে হয় কোন সাহিত্যসভায় বসে আছি। আমি একজন ফ্রীল্যান্স রাইটার, এমন পরিচয় পেয়ে তিনি এপ্রিশিয়েট করলেন। তিনি জিজ্ঞেস করলেন কী কী বিষয়ের উপরে লিখি। অন্যান্য বিষয়ের সাথে মাঝে মাঝে কবিতাও লিখি, এবং একটি ইংরেজী কবিতার ওয়েবসাইটে আমার দুই শতাধিক কবিতা প্রকাশিত আছে, একথা জেনে তিনি বললেন, “ও, ইউ রাইট পোয়েট্রী? ওহ দ্যাটস দ্য ডীপেস্ট ল্যাঙ্গুয়েজ অভ হিম্যান সৌলস”!
বেলা বারটায় লাঞ্চ এলো। লাঞ্চের পর রোযালী তার জিনিসপত্র গুছিয়ে নিয়ে, যাওয়ার জন্য তৈরী হয়ে বসে থাকলেন। মাঝে মাঝে একে ওকে ফোন করছেন। মাঝে মাঝে একটা বই পড়ছেন। এর আগে আলাপের এক ফাঁকে তিনি ঐ বইটার সম্বন্ধেও একটু আলোকপাত করেছিলেন। বই এর বিষয়বস্তু ছিল ফিলোসফি। অবশেষে বেলা দুইটায় ওনারও যাওয়ার পালা এলো। চায়না সাউদার্ন এর একজন স্টাফ এসে ওনাকে নিতে এলেন। উনি উঠে দাঁড়ালেন, আমাদের দিকে তাকিয়ে বললেন, আমাদেরকে মিস করবেন, এ সুন্দর সময়টাকে মিস করবেন। এ কথা বলে আমাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেলেন। একটু পরে দেখলাম, আড়াইটার প্লেন ঠিক তিনটা দশে রোযালীকে নিয়ে উড়ে গেল আকাশপানে, ভ্যাঙ্ক্যুভারের পথে। আবারও মনে মনে বলে উঠলাম, বন ভয়াজ!!!!
ঢাকা
০৮ এপ্রিল ২০২০
শব্দ সংখ্যা, ১১২৮
(আগামী পর্বে সমাপ্য)
গুয়াংঝু, চীনের বাইয়ুন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে দীর্ঘ যাত্রাবিরতিতে আটকে পড়া সাতজন ট্রানজিট যাত্রী... প্রতিকূল সময়ে অনুকূল ভাবনায় সহযাত্রী।
রোযালী প্রস্তাবিত "ক্রেজী পোজে" আমরা।
খুঁজে পেলাম ভিটামিন সি- এ সময়ে ইমিউনিটি বাড়ানোর জন্য যার বড় প্রয়োজন।
ভ্যাঙ্কুভারের পথে রোযালী
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই এপ্রিল, ২০২০ রাত ৮:১৪