somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

আমার মা

২৫ শে মে, ২০২২ রাত ৮:৪৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

আমার মা আর সবার মায়ের মতই আমার প্রথম শিক্ষাগুরু ছিলেন। তখন আমাদের লেখার হাতে-খড়ি হতো স্লেট-পেন্সিলে, যা ছিল একটা কালো পাথরের ফলকবিশেষ, আর সেই কালো পাথরেরই একটা সরু দণ্ড ব্যবহৃত হতো পেন্সিল হিসেবে। দণ্ডটার একটা মাথা একটু চোখানো থাকতো, লেখার সুবিধার্থে। স্লেট-পেন্সিলে লেখার একটা সুবিধে ছিল এই যে লেখায় ভুল করলে সেটা একটা ভেজা কাপড়ের টুকরো দিয়ে মুছে পুনঃপুনঃ ব্যবহার করা যেত। মা বারংবার সেই স্লেট মুছে মুছে আমাকে হস্তলিপি শেখাতেন। আমার মায়ের মুখে আমি প্রথম ছড়া ও কবিতা শুনি। কবিগুরু, নজরুল এবং জসীম উদ্দিনের অনেক কবিতা তার মুখস্ত ছিল। আমাকে এবং পরে আমার ছোট ভাইবোনদেরকে, এবং তারও পরে আমার এবং আমার ভাইবোনদের ছেলেমেয়েদেরকে ঘুম পাড়ানোর সময় তিনি সেসব কবিতা সুর করে বলে যেতেন, সেগুলো শুনে ওরা এবং আমরা নিমেষেই ঘুমিয়ে যেতাম। আমার নানা সেই আমলে একজন জমিদার ছিলেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় লালমনিরহাট এ্যারোড্রাম বানানোর জন্য ব্রিটিশ সরকার নানাদের জমিদারীর তিন চতুর্থাংশ নামমাত্র মূল্যে দখল করে নেয়। কিন্তু তার পরেও ওনাদের রেহাই হয়নি। যুদ্ধের ডামাডোলে নানাকে তার বাড়ন্ত চার কন্যাসহ সপরিবারে ভিটে মাটি ছেড়ে মোগলহাটে গিয়ে তার শ্বশুরবাড়ীতে আশ্রয় নিতে হয়। এ কারণে আমার মায়ের প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়া বেশিদূর এগোয়নি, কিন্তু তিনি ততদিনে যতটুকুই শিক্ষা পেয়েছিলেন, নির্দ্বিধায় বলা চলে তা সুশিক্ষা ছিল। কবিতার প্রতি আমার অনুরাগ জন্মে তার মুখে কবিতা পাঠ শুনে শুনেই। তিনি অত্যন্ত পরিচ্ছন্ন জীবন যাপন করেছেন। কারও কাছে তার কখনো কোন দেনা থাকতো না। দেনা পরিশোধের ব্যাপারে তিনি কঠোর নিয়মানুবর্তী ছিলেন এবং আব্বাকেও তিনি ঋণহীন থাকার ব্যাপারে সদা সর্বদা উৎসাহিত করতেন। পরিচ্ছন্ন জীবনাচার ছাড়াও, তিনি পরিচ্ছন্ন ব্যক্তিগত স্বাস্থ্য তথা ‘পার্সোনাল হাইজিন’ সম্পর্কে অত্যন্ত সচেতন ছিলেন। কভিডের কারণে আজ আমরা নতুন করে হাত ধোয়া শিখছি। উনি আমাদেরকে সঠিক পন্থায় হাত ধোয়া শিখিয়েছিলেন আমাদের শৈশবে। ওনার কারণে আমরা সামান্য অপরিচ্ছন্ন পরিধেয় বস্ত্রেও কখনো ঘর হতে বের হতে পারতাম না। উনি আমাদেরকে টয়লেট ব্যবহারের আগে ও পরে সতর্কতার সাথে পরিচ্ছন্নতা অবলম্বনের উপর গুরুত্বারোপ করতেন। অবশ্য এ অভ্যাসটি তিনি পেয়েছিলেন তার বাবার কাছ থেকে। তিনিও ‘পার্সোনাল হাইজিন’ এর ব্যাপারে কঠোর নিয়মানুবর্তী ছিলেন। হাটবাজার থেকে এসে তিনি কখনো গোসল না করে গৃহপ্রবেশ করতেন না।

আমার মা খুবই ন্যায়পরায়ণ ছিলেন। এ কারণে তিনি সকলের নিকটা সম্মানীয়া ছিলেন। তিনি নিজেও মানুষকে সম্মান করতেন। বাসায় কখনো মেহমান এলে উনি সাধ্যমত চেষ্টা করতেন তার সমাদর করতে। নিবিড় স্নেহের ছায়ায় রেখে তিনি আমাদেরকে বড় করেছেন, কিন্তু আমাদের কোন দোষকে তিনি কখনো ছোট করে দেখতেন না, অর্থাৎ আমাদের দোষকে তিনি আদরের আতিশয্যে প্রশ্রয় দিতেন না। মধ্যবিত্তের সংসারে উনি অনেক কষ্ট করে আমাদেরকে ‘মানুষ’ করেছেন। এক হাতে ঘর গেরস্থালি সামলাতেন। আমাকে ক্যাডেট কলেজে দেয়ার পর উনি মনে মনে অনেক কষ্ট পেতেন, কিন্তু আমার কল্যাণের কথা ভেবে উনি কখনো তা আমার সামনে প্রকাশ করতেন না। আমরা কখনো তার মুখে কারও সম্বন্ধে কোন মন্দ কথা শুনিনি। যার কাছে তিনি সামান্যতমও সাহায্য পেয়েছেন, উনি আজীবন তা কৃতজ্ঞতার সাথে স্মরণে রেখেছেন এবং সুযোগ পেলেই তার প্রতিদান দেয়ার চেষ্টা করেছেন। আমরা ভাই বোনেরা একে একে বড় হতে থাকি, মা-বাবার সান্নিধ্য ছেড়ে পড়াশুনার জন্য কিংবা কর্মোপলক্ষে গৃহত্যাগ করতে থাকি, সেই সাথে মায়ের সাংসারিক ব্যস্ততাও ক্রমান্বয়ে কমতে থাকে। তারপর আমরা একে একে বিয়ে শাদি করি, আমাদের ঘরেও সন্তানাদি আসতে থাকে, মায়ের দায়িত্ব ও কর্মব্যস্ততা আবারও বাড়তে থাকে। ওনার পাঁচ বউ এর মধ্যে কে যে তার কাছে একটু বেশি প্রিয় ছিল, এ কথা কেউ ঘূর্ণাক্ষরেও বলতে পারবে না। তবে নাতি-নাতনিদের কথা বলা যাবে। যাদেরকে তিনি নিজ হাতে বেশি নাড়াচাড়া করেছেন, স্বাভাবিকভাবেই তাদের প্রতি তিনি একটু বেশি আসক্ত ছিলেন।

এক সময় আমাদের পৈত্রিক বাড়িটা খালি হয়ে যায়, কারণ সরকারি চাকুরিতে বদলিজনিত কারণে ভাইদের কারও পক্ষে আর মায়ের সাথে বাড়িতে থাকা সম্ভব হয় না। আম্মা থাকতে শুরু করেন তার সর্বকনিষ্ঠ সন্তান, অর্থাৎ আমাদের সবচেয়ে ছোট ভাই এর সাথে, তার রংপুরের বাসায়। ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে মা আমার ঢাকার বাসায় শেষবারের মত বেড়াতে এসেছিলেন। তখনও তিনি বিমানে যাতায়াত করতে পারতেন, কাউকে সাথে নিয়ে। খাওয়া দাওয়ার পর ডাইনিং টেবিলে তিনি তার পানসুপারির ডিব্বা খুলে বসতেন। তখনও চিকণ করে কাটা কাঁচা সুপারি চিবিয়ে খেতে পারতেন। তারপর থেকে শুরু হয়ে যায় তার স্মৃতিশক্তি লোপ, তিনি দ্রুত হারাতে থাকেন তার স্মৃতি এবং বোধশক্তি। ২০২১ এর জানুয়ারীতে তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করে নিউরো সার্জন এবং নিউরো মেডিসিন এর দু’জন প্রফেসর এর অধীনে চিকিৎসা করানো হয়। তাদের পরামর্শ অনুযায়ী বাকিটা সময় বাসায় রেখে তার চিকিৎসা চালানো হয়। তখনও আমি মায়ের সাথে কয়েকদিন ছিলাম। গতবছর ঈদুল আযহার আগে পরে মিলিয়ে একনাগাড়ে মোট পাঁচ সপ্তাহ মায়ের সান্নিধ্যলাভ নিমিত্ত রংপুরে ভাই এর বাসায় অবস্থান করেছিলাম। এবারে অস্ট্রেলিয়ায় আসার তিন দিন আগেও রংপুরে গিয়ে বোধশক্তিহীন, চলৎশক্তিহীন, স্মৃতিহীন মায়ের সাথে দু’দিন থেকে এসেছিলাম। আসার আগ মুহূর্তে মায়ের কক্ষে গিয়ে তার গলা জড়িয়ে ধরে অনেক দোয়া করেছিলাম স্রষ্টার কাছে তার সুস্থতা ও শান্তি কামনা করে। তার গলা ছেড়ে আসার সময় উনি আমার দিকে নিষ্পলক তাকিয়ে ছিলেন।

এখানে এসে সব সময়েই একটা ভয়ের মধ্যে ছিলাম, কখন কোন দুঃসংবাদ আসে! গত ঈদের দিনে ছোটভাইকে ফোন করে তার কুশল জেনেছিলাম। শেষ বারের মত এই গত সপ্তাহেও তার স্বাস্থ্যের আপডেট নিয়েছিলাম। আমরা প্রতিবছর রোযার ঈদের পর শাওয়াল মাসে ৬টি দিন রোযা রাখি। আজ ছিল আমার শাওয়ালের রোযার পঞ্চম দিন। আসরের নামাযের পর পবিত্র ক্বুর’আন মজিদ থেকে সুরা হিজর তিলাওয়াৎ করছিলাম। আমার তিলাওয়াতের মাঝেই স্ত্রী এসে পাশে দাঁড়িয়ে কিছু একটা বললেন, যা আমি শুনিনি। ক্বুর’আন পাঠের সময় সাধারণতঃ এরকমভাবে তিনি কোন বিঘ্ন সৃষ্টি করেন না। তাই ভয়ে আমার মন কেঁপে উঠলো। ক্বুর’আন পাঠ বন্ধ করে আমি তার দিকে তাকালাম, তিনি জীবনের সবচেয়ে বড় দুঃসংবাদটি আমাকে জানালেন। আমি ঐ অবস্থায় রোযা মুখে সিজদায় অবনত হয়ে আকুলভাবে স্রষ্টার কাছে প্রার্থনা জানালাম, আমার সহজ সরল মাকে যেন তিনি ক্ষমা করে দিয়ে জান্নাতের সৌভাগ্যবান অতিথিদের কাতারে দলভুক্ত করে নেন। তার জীবনের সমস্ত নেক আমলসমূহ কবুল করে নিয়ে তিনি যেন তার ক্ববরকে চিরশান্তিময় করে রাখেন। পরলোকে তার এই নবযাত্রাকে মহিমান্বিত করেন। “রাব্বির হামহুমা কামা রাব্বা ইয়ানি সাগিরা”!

আট বছর আগে মাকে নিয়ে লেখা আমার একটা কবিতার লিঙ্ক এখানে উদ্ধৃত করলামঃ

মায়ের আক্ষেপ


সুদীর্ঘ ৯২+ বছরের একটি পরিশ্রমী, পরিচ্ছন্ন জীবনের অবসান হলো। একটু আগে, মাগরিবের নামাযের পর মায়ের জানাযা এবং দাফনকার্য আদিতমারি উপজেলার বিন্যাগাড়ি গ্রামে আমাদের পারিবারিক গোরস্থানে সম্পন্ন হলো। সকলের কাছে আমার মায়ের জন্য দোয়ার দরখাস্ত রইলো।


মেলবোর্ন, অস্ট্রেলিয়া
২৫ মে ২০২২


সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে মে, ২০২২ বিকাল ৩:৫৬
২৯টি মন্তব্য ২৯টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

হার জিত চ্যাপ্টার ৩০

লিখেছেন স্প্যানকড, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



তোমার হুটহাট
চলে আসার অপেক্ষায় থাকি
কি যে এক ছটফটানি
তোমার ফিরে আসা
যেন প্রিয় কারো সনে
কোথাও ঘুরতে যাবার মতো আনন্দ
বারবার ঘড়ি দেখা
বারবার অস্থির হতে হতে
ঘুম ছুটে... ...বাকিটুকু পড়ুন

জীবনাস্ত

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৪৪



ভোরবেলা তুমি নিশ্চুপ হয়ে গেলে একদম,
তোমার বাম হাত আমার গলায় পেঁচিয়ে নেই,
ভাবলাম,তুমি অতিনিদ্রায় আচ্ছন্ন ,
কিন্তু এমন তো কখনো হয়নি
তুমি বরফ জমা নিথর হয়ে আছ ,
আমি... ...বাকিটুকু পড়ুন

যে দেশে সকাল শুরু হয় দুর্ঘটনার খবর দেখে

লিখেছেন এম ডি মুসা, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:১১

প্রতি মিনিটে দুর্ঘটনার খবর দেখে অভ্যস্ত। প্রতিনিয়ত বন্যা জলোচ্ছ্বাস আসে না, প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনার খবর আসে। আগে খুব ভোরে হকার এসে বাসায় পত্রিকা দিয়ে যেত। বর্তমানেও প্রচলিত আছে তবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমাদের দাদার দাদা।

লিখেছেন নাহল তরকারি, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:৫৫

বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১, ০৮ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী।

আমার দাদার জন্মসাল আনুমানিক ১৯৫৮ সাল। যদি তার জন্মতারিখ ০১-০১-১৯৫৮ সাল হয় তাহলে আজ তার বয়স... ...বাকিটুকু পড়ুন

জেনে নিন আপনি স্বাভাবিক মানুষ নাকি সাইকো?

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:১৮


আপনার কি কারো ভালো সহ্য হয়না? আপনার পোস্ট কেউ পড়েনা কিন্তু আরিফ আর হুসাইন এর পোস্ট সবাই পড়ে তাই বলে আরিফ ভাইকে হিংসা হয়?কেউ একজন মানুষকে হাসাতে পারে, মানুষ তাকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×