দু'পাখা মেলে দিয়ে রোদ পোহাচ্ছিল পাখিটা।
২০১৩৪৩ জুন ২০২২
শিরোনামটি দেখে হয়তো অনেকেই চমকে উঠবেন। জীবনে আপনারা অনেক পাখির নাম নিশ্চয়ই শুনেছেন, তবে এমন নাম তো বোধকরি কখনোই শুনেন নি। হ্যাঁ, আজ আমি এখানে যে পাখিটার কথা লিখছি, সেটার প্রকৃত নাম শিরোনামের নামটি নয়। পাখি সম্বন্ধে আমার জ্ঞান খুবই সীমিত। এই পাখিটাকে এখানে যেদিন প্রথম জলে ভাসমান দেখি, সেদিন তার শরীর পুরোটাই জলে ডোবা ছিল। লম্বা গলাটারও অর্ধেকের বেশি পানির নীচে ছিল, শুধু গলার কিয়দংশ এবং সোনালী ঠোঁটটা পানির উপর ভাসমান ছিল। জলের উপরে সেই অংশটুকুর নিঃশব্দ অগ্রসরমান গতিপথ দেখে প্রথমে আমি সাপ বলে ভুল করেছিলাম। একটু পরে সে দিল এক লম্বা ডুব। ডুবন্ত অবস্থায় ওটাকে দেখা যাচ্ছিল না ঠিকই, কিন্তু ওর গতিপথের সমান্তরালে পানির ওপরে একটা হাল্কা হিল্লোল খেলা করছিল। আমি সেইদিকে নজর রাখছিলাম। কিছুক্ষণ পরে দেখি সে ভেসে উঠলো, আর ওর ঠোঁটে গাঁথা রয়েছে একটি চকচকে মাছ।
আমি প্রায় প্রতিদিনই ম্যারিওট ওয়াটার্সের পাশ দিয়ে যাতায়াত করি। এখানে কয়েকটি ঝুলন্ত ফুটব্রীজ আছে, সেখানে যে কোন একটার উপর কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে বিভিন্ন রকমের পাখি দেখি, যার বেশিরভাগই ছোট কিংবা মাঝারি আকারের। এ জলাশয়ে প্রচুর মাছ রয়েছে। পাখিরা পেট ভরে মাছ খেয়ে তীরে উঠে ঝোপ ঝাড়ে দাঁড়িয়ে রোদ পোহায়, নয়তো ডিম পাড়ে এবং ডিমে তা’ দেয়। মানুষ দেখলেও সহজে নড়া চড়া করে না, কারণ ওরা জানে যে এখানকার মানুষ ওদের জন্য কোন হুমকি নয়। তবে এটা হয়তো জানে না যে এখানে ওদের নিরাপত্তা আইন দ্বারাও সুনিশ্চিত।
যাহোক, এই পাখিটাকে আমি আজ নিয়ে বেশ কয়েকদিন পর্যবেক্ষণ করলাম। এটা যে কী পাখি তা আমি জানিনা। এক প্রজাতির বক, নাকি সারস, নাকি আমাদের দেশের পানকৌড়ির অস্ট্রেলিয়ান ভার্সন? আমাদের দেশের পানকৌড়ি সাধারণতঃ আকারে এর থেকে সামান্য ছোট হয়ে থাকে আর বর্ণে কালো কিংবা ধূসর বা ছাই রঙের হয়ে থাকে। আমার পরিচিত একজন পক্ষীবিশারদকে পাখিটির ছবি পাঠিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘এটা কী পাখী?’ সে উত্তরে জানালো, “The great cormorant (Phalacrocorax carbo), known as the black shag in New Zealand and formerly also known as the great black cormorant across the Northern Hemisphere, the black cormorant in Australia”। ওর আসল নাম যাই হোক না কেন, আমি নিজে ওর ডুব সাঁতারের পারদর্শিতা আর লক্ষ্যবস্তু পাকড়াও করার সক্ষমতা দেখে ওর নাম দিয়েছি ‘সাবমেরিন পাখি’। একবার যদি পুরোটা শরীর নিয়ে ডুব দেয়, তবে শিকার না ধরা পর্যন্ত ভেসে ওঠে না। যখন ভেসে উঠবে, তখন অবশ্যই ওর তীক্ষ্ণ ঠোঁটে একটা মাছ গাঁথা থাকবে। মাছের ঠিক মাঝখানের পেট-পিঠ বরাবর ধরে তার ঠোঁট চিমটার মত করে তুলে আনে। সেটাকে ঠোঁটে ধরে রেখেই প্রথমে কয়েকবার মাথাটা এপাশ ওপাশ দ্রুত ঘুরিয়ে পানি ঝেরে ফেলে, তারপর সামান্য শূন্যে ভাসিয়ে পরক্ষণেই গপ করে গিলে ফেলে। মোট তিন ঢোকে সে সেটাকে সাবাড় করে ফেলে। এভাবে পরপর ডুব দিয়ে কয়েকটা মাছ খাবার পর সে শ্রান্ত হয়ে তীরে উঠে আসে।
গুগল ঘেঁটে আরও কিছুটা তথ্য জানলাম। এরা পানকৌড়ি বা cormorant পরিবারের পাখি। এরা ডুবসাঁতারে ওস্তাদ হয়ে থাকে। এদের লম্বা ও সরু গলার নীচে একটা থলে বা ‘পাউচ’ (Pouch) থাকে, যা প্রয়োজনবোধে অনায়াসে স্ফীত হতে পারে। এরা যখন ক্ষুধার্ত হয় তখন রাক্ষসের মত একটার পর একটা মাছ গিলে খেতে থাকে। কিছু মাছ থলেতে জমিয়ে রাখে, পরে বের করে এনে মজা করে খেতে পারে। এদের এই রাক্ষসের মত মাছ খাওয়া স্বভাবের জন্য ইংরেজী অভিধানে cormorant শব্দটির আরেকটি অর্থ যোগ হয়েছে। যে সকল মানুষ অত্যন্ত লোভী এবং রাক্ষসের মত খাওয়া দাওয়া করে, তাদেরকেও এই স্বভাবের জন্য cormorant বলা হয়ে থাকে।
আজ অনেকক্ষণ অপেক্ষা করছিলাম, ও ডুব দেয় কিনা সেটা দেখার জন্য। কিন্তু না, আজ তার চালচলনে আলস্য স্পষ্টরূপে ধরা দেয়। প্রথমে তো অনেকক্ষণ ধরে জলে নামলোই না। এখানে পাখিদেরকে উত্যক্ত করা বা ভয় দেখানো দণ্ডনীয় অপরাধ, তা জেনেও আমি মুখ দিয়ে একটু জোরে আওয়াজ করলাম যেন সে জলে নামে। আমার আওয়াজ শুনে সে আলস্যভরে জলে নামলো ঠিকই, কিন্তু পুরোপুরি ডুব দিতে অনিচ্ছুক ছিল। কিছুক্ষণ অনিচ্ছায় মাথা উঁচু করে জলে সাঁতরে সে এদিক ওদিক তাকিয়ে আবার তীরে উঠে বসলো। আজ আর ওর মাছ শিকার দেখা হলো না।
মেলবোর্ন, অস্ট্রেলিয়া
২০ জুন ২০২২
শব্দসংখ্যাঃ ৬০৭
(ছবিসূত্রঃ ছবিটা আইফোন আই-৭ এ আমার নিজের তোলা, তারিখ ও সময় উপরে উল্লেখিত।)
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা জুলাই, ২০২২ বিকাল ৩:৩৫