এর আগের পর্বটি পড়তে পারবেনঃ এখানে
পাঁচ মিনিট বিলম্বে দুবাই সময় রাত তিনটা পঁয়ত্রিশ মিনিটে শতভাগ পূর্ণ আসনে যাত্রী নিয়ে এমিরেটস ফ্লাইট EK241 টরন্টোর উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করলো। দুর্ভাগ্যক্রমে এ যাত্রায় আমার এবং আমার স্ত্রীর আসন পাশাপাশি পড়ে নাই। তবে পরপর পড়েছিল, আইলের ধারে, ফলে কমিউনিকেশনে সমস্যা হয় নাই। কিন্তু সমস্যা হয়েছিল অন্য জায়গায়। সুদীর্ঘ চৌদ্দ ঘণ্টার এই উড়ন্ত সফরে আমাদের পাশের দুজন করে যাত্রীর (সবাই বয়স্ক) ওয়াশরুম তাগিদ মেটাবার জন্য আমাদের উভয়কে অনেকবার আসন থেকে উঠে তাদেরকে বের হবার পথ করে দিতে হয়েছিল। কি আর করা! এত দীর্ঘ সময়ের পথ, এটুকু তো সহ্য করতেই হবে! তবে আমার গিন্নীর পাশের যাত্রী ডায়েবেটিক (সম্ভবতঃ) হবার কারণে তাকে এ কষ্টটা একটু বেশিই সহ্য করতে হয়েছিল। ওয়াই-ফাই সংযোগ না থাকার কারণে প্লেনে আমাদের আসন গ্রহণের খবরটি ছেলেদেরকে জানাতে পারিনি বলে ওরা কিছুটা দুশ্চিন্তায় থাকবে ভেবে মনটা একটু খারাপ হয়েছিল। টরন্টো পৌঁছে পরবর্তী গন্তব্য রিজাইনার ফ্লাইট ধরার জন্য হাতে সময় পাবো মাত্র তিন ঘণ্টা পঁচিশ মিনিট। এরই মধ্যে ব্যাগেজ কালেকশন, ইমিগ্রেশন ও কাস্টমস ক্লীয়ার করে ডমেস্টিক টার্মিনালে গিয়ে পুনরায় চেক-ইন করতে হবে। স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় এসব কাজ সম্পন্ন করতে হলে কিছুটা দৌড়ের উপর থাকতে হবে ভেবে মনে একটা উদ্বেগ থেকে থেকে মাথাচাড়া দিচ্ছিল।
দুবাই এর আকাশে ওড়ার কিছুক্ষণ পরই ভোরের আলো ফোটা শুরু হলো। সুদীর্ঘ পথ, পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে দুবাই এ জড়ো হওয়া যাত্রীরা এমনিতেই ক্লান্ত ছিল। প্লেনে উঠে তাই অনেকেই যার যার আসনে ক্লান্ত শিশুদের মতই ঘুমিয়ে পড়লো। কেবিন ক্রুদের নির্দেশে প্লেনের জানালাগুলোর 'ব্লাইন্ড' নামিয়ে রেখে কৃত্রিম অন্ধকার সৃষ্টি করা হলো যেন ক্লান্ত যাত্রীরা একটু আরামে ঘুমোতে পারে। আমিও এই সুযোগে ঘণ্টাখানেক ঘুমিয়ে নিলাম। আগে থেকেই মনে মনে ঠিক করে রেখেছিলাম যে চৌদ্দ ঘণ্টার এ যাত্রাপথে আমি অনেকটা সময় কাটিয়ে দিব লেখালেখি করে কিংবা সাথে আনা বই পড়ে। এতদুদ্দেশ্যে আমার আসনের রীডিং লাইট জ্বালাবার সুইচ স্পর্শ করলাম। সেটা জ্বললো ঠিকই, কিন্তু আলোটা গিয়ে আছড়ে পড়লো সামনের সারিতে বসা মাঝখানের যাত্রীর মাথার উপর। আমার পাশে বসা ভারতের কেরালা রাজ্যের অধিবাসী ভদ্রলোক জেগেই ছিলেন। তাকে অনুরোধ করলাম, একটু দাঁড়িয়ে আলোটাকে এ্যাডজাস্ট করে দিতে, যেন সেটা আমার লেখার জায়গাটিতে পড়ে। উনি কিছুক্ষণ চেষ্টা করে জানালেন, ওটা ফিক্সড, নড়াবার কোন উপায় নেই। আমি হতাশ হয়ে পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়া একজন কেবিন ক্রু'র সাহায্য চাইলাম। তিনিও কিছুক্ষণ চেষ্টা করে অবশেষে রণে ভঙ্গ দিয়ে জানালেন, আপাততঃ করার কিছুই নেই! আমি খানিক বিরক্ত হয়ে তাকে বললাম, "I am not happy with this situation. I wanted to spend some time here by writing and reading which I cannot do because of insufficient light. I am disappointed." তিনি সম্ভবতঃ আমার বিরক্তি অনুধাবন করতে পারলেন, তাই প্রথম বারের মত কাঠখোট্টা জবাব না দিয়ে কিছুটা apologetic হয়ে বললেন যে সমস্যাটির কথা তিনি তার সিনিয়র স্টাফ কে জানাবেন।
অল্প কিছুক্ষণ পরেই অন্য একজন মহিলা এসে লাইটের আলো এ্যাডজাস্টমেন্টের জন্য এটা ওটা নাড়াচাড়া করে তিনিও ব্যর্থ হলেন। উনি জানালেন যে এই এয়ারক্র্যাফটে লাইটগুলো ফিক্সড, অন্য এয়ারক্র্যাফটের মত এ্যাডজাস্টিবল নয়। এটাকে ঠিক করতে হলে পুরো সেটটাকে খুলতে হবে, যা করার অনুমতি তাদের নেই। আমি অগত্যা মেনে নিলাম এবং তাকে জিজ্ঞাসা করলাম যে আপাততঃ জানালার ব্লাইন্ড উঠিয়ে দিয়ে আমি খানিকক্ষণ লেখালেখি করতে পারি কিনা। উনি জানালেন যে এতে আমার পাশের দুইজন সহযাত্রী আপত্তি না জানালে তাদের তরফ থেকেও কোন আপত্তি নেই। এ কথা শুনে কেরালা-দম্পতিও স্বতঃস্ফূর্তভাবে বলে উঠলেন, "No no, we have no objection. We also want light." আমি আগেই লক্ষ্য করেছিলাম যে জানালার পাশে বসা মহিলাটি কেবিন ক্রুদের (এবং তার স্বামীরও) নির্দেশ অমান্য করে ব্লাইন্ডটি সম্পূর্ণ বন্ধ না করে নীচের দিক থেকে সামান্য একটু উপরে তুলে রেখেছিলেন, যার ফলে কিছু আলো ভেতরে আসছিল। এবারে কেবিন ক্রু'র কথা শুনে এবং আমার প্রয়োজনীয়তার কথা ভেবে তিনি সোৎসাহে ব্লাইন্ডটিকে আরও খানিকটা ওপরে ঠেলে দিলেন। ভদ্রলোকটি তার স্ত্রীকে দেখিয়ে বিমানবালাকে বললেন, "She needs vitamin-D"। মুচকি হেসে 'ওকে, ওকে' বলে বিমানবালা অন্যত্র চলে গেল, সেই সুযোগে প্লেনে বসেই আমি আমার এ লেখাটি শুরু করলাম। মহিলাও মনের সুখে তার অনাবৃত হাতে ও মুখে 'ভিটামিন-ডি' মাখতে শুরু করলেন। ভূমি থেকে প্রায় চল্লিশ হাজার ফিট ঊর্ধ্বে বসে প্লেনের জানালার পুরু কাঁচ দিয়ে আসা রোদের আলো থেকে তিনি কতটুকুই বা 'ভিটামিন-ডি' পাবেন, সে কথা ভেবে এবং তার সিরিয়াসনেস দেখে আমি মনে মনে হাসছিলাম।
এখন আমাদের প্লেনটি ইরান, ইরাক, তুরস্ক, ইউক্রেন, পোল্যান্ড, ডেনমার্ক, নরওয়ে, ইউকে, আইসল্যান্ড ও গ্রীনল্যান্ড এর আকাশ সীমা পেরিয়ে পশ্চিম থেকে দক্ষিণ-পশ্চিমে দিক পরিবর্তন করলো। গন্তব্যে পৌঁছতে আরও চার ঘণ্টার (কিছুটা কমবেশি) মত সময় লাগার কথা। গন্তব্য যতই নিকটে আসছে, ওয়াশরুমগুলোর সামনে লাইন ততই দীর্ঘতর হচ্ছে। চৌদ্দ ঘণ্টায় যদি প্রতি যাত্রীকে অন্ততঃ দু'বার করেও ওয়াশরুমে যেতে হয়, তাহলেও ১৬০০ বারের অধিক ওয়াশরুম ভিজিট হয়। এ ছাড়া প্লেন ওঠানামার সময় এবং পথের যে কোন দুর্যোগের (টারবুলেন্স) সময় ওয়াশরুম লকড রাখা হয়। তাই এ ধরণের দীর্ঘ ফ্লাইটগুলোতে ওয়াশরুমগুলোর সামনে সার্বক্ষণিক একটা লাইন লেগেই থাকে। পাইলট স্বয়ং কিংবা তার পক্ষ থেকে অন্য কেউ অবশ্য ওয়াশরুম লক করার আগে প্রতিবারই এ বিষয়ে আগাম সতর্কবাণী ঘোষণা করে থাকেন। আইলের পাশের যাত্রীগণ ছাড়া ভেতরে বসা যাত্রীদের জন্য ওয়াশরুম ভিজিট একটা অস্বস্তির কারণ হয়ে থাকে। আর ডায়াবেটিক যাত্রীদের জন্য তো এটা একটা বিরাট মাথা-ব্যথা হয়ে দাঁড়ায়। তবে এর একটা উপকারিতাও আছে। দফায় দফায় জলবিয়োগের তাগিদের কারণে একটানা বেশিক্ষণ স্থি্র হয়ে বসে থাকা কিংবা ঘুমানো যায় না। ওঠাবসা ও হাঁটাহাঁটির কারণে স্বাভাবিক ভাবেই শরীরে রক্ত সঞ্চালন বৃদ্ধি পায়। ছেলের পরামর্শে আমি এবং আমার স্ত্রী ওয়াশরুম ভিজিটের তাগিদ ছাড়াও এমনিতেই কয়েকবার উঠে আইলের পাশে হাঁটাহাঁটি করে হাত পায়ের স্থবিরতা দূর করার প্রয়াস পেয়েছি। এমনকি প্লেনের মনিটরে দেখানো পদ্ধতি অনুযায়ী কয়েক ঘণ্টা পরপর পায়ের আঙুলের উপর ভর করে সমতল থেকে গোড়ালি ওঠানামা করার অনুশীলনও মনযোগ দিয়ে করেছি।
শরীরের স্থবিরতা পরিহারের জন্য এসব নানা ধরণের কার্যক্রমের মাঝে হঠাৎ ঘোষণা এলো যে অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই প্লেন অবরোহণ শুরু করবে। যাত্রীদের ওয়াশরুম ভিজিটের প্রয়োজন থাকলে তারা যেন দ্রুত সে কাজটি সেরে নেন এবং অন্যরা সীট-বেল্ট বেঁধে নিজ নিজ আসনে বসে থাকেন। এমন একটা ঘোষণা এলে যাদের তেমন প্রয়োজন নেই, তারাও সাবধানতা অবলম্বনের জন্য দাঁড়িয়ে যান। তাই পুনরায় ওয়াশরুমগুলোর সামনে দীর্ঘ লাইন পড়ে যায়। চৌদ্দ ঘণ্টার যাত্রা সমাপ্ত করে অবশেষে আমাদের প্লেনটি টরন্টোর পিয়ারসন বিমানবন্দরের ভূমি স্পর্শ করলো কাঁটায় কাঁটায় ঘড়ি ধরে স্থা্নীয় সময় ঠিক সাড়ে নয়টায়, তবে প্লেনের দরজা খুলতে আরও পনের মিনিট বিলম্ব হলো। মাত্র তিন ঘণ্টা দশ মিনিটের মধ্যে প্লেন থেকে বের হয়ে ব্যাগেজ কালেকশন, ইমিগ্রেশন ও কাস্টমস ক্লীয়ার করে ডমেস্টিক টার্মিনালে গিয়ে পুনরায় চেক-ইন করতে হবে। তাই সময়াভাব হবে কিনা, এই নিয়ে টেনশন বাড়তে থাকলো। তবে আল্লাহ সহায়, তাই একজন স্টাফের সহায়তায় খুব দ্রুতই আমাদের পাসপোর্ট স্ক্যান করে, মেশিনের সামনে দাঁড়িয়ে আমাদের ছবি তুলে এবং মেশিনের সাহায্যেই কাস্টমস ডিক্লারেশন ফরম পূরণ করে ফেললাম এবং উনি পূরণকৃত ফর্মের একটা প্রিন্টও নিয়ে দিলেন। এ কাজগুলো বুঝে বুঝে আমার একার করতে হলে অন্ততঃ তিনগুণ বেশি সময় লাগতো। কাস্টমস অফিসার এক মিনিটেরও কম সময়ে আমাদের ছবি আঁটা সেই ফর্মটিতে একটা লম্বা দাগ দিয়ে সেটা নিজের কাছে রেখে দিলেন এবং আমাদেরকে ক্লীয়ার করে দিলেন। সব কাজ শেষ করে পিয়ারসনের ডমেস্টিক টার্মিনালে যখন চেক-ইন করলাম, তখন আমার হাতে আরও এক ঘণ্টা সময় বাকি। ভেবেছিলাম, এ সময়টা ইতস্ততঃ পায়চারি করে কাটিয়ে দেব। নতুন বোর্ডিং পাসটা হাতে নিয়ে সাথে সাথে আর সেটা পড়ে দেখিনি। কিছুটা থিতু হয়ে বসার পর সেটা পড়ে দেখি, আমাদের কানেক্টিং ফ্লাইট দুই ঘণ্টা বিলম্বে ছাড়বে। অর্থাৎ সব মিলে তিন ঘণ্টার (যেন অন্তহীন, সে সময়ে মনে হচ্ছিল) অলস অপেক্ষা! প্রথম প্রচেষ্টাতেই ফ্রী ওয়াই-ফাই সংযোগ পেয়ে গেলাম। শুরু হলো ঘরে ঘরে বার্তা পৌঁছানোর পালা। তার পরেও, সময় যেন কিছুতেই কাটে না!
পিয়ারসন টার্মিনাল-১ লাউঞ্জ, টরোন্টো
০৬ মে ২০২৩
শব্দ সংখ্যাঃ ১১৫২
এর পরের পর্বটি পড়তে পারবেনঃ এখানে
লেখালেখি চলছে।
On board flight EK241, on 06 May 2023
ছবিটি টরন্টো'র পিয়ারসন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে আমাকে ইমিগ্রেশন, কাস্টমস এবং ব্যাগেজ কালেকশনে সহায়তা প্রদানকারী রুশভ এর সাথে তোলা। তিনি ভারতীয় বংশোদ্ভূত, মুম্বাই থেকে আগত, বিমানবন্দরে সহায়তা প্রদানকারী হিসেবে কর্মরত আছেন। অত্যন্ত ভব্য ও বিনয়ী আচরণ দিয়ে তিনি আমাকে মুগ্ধ করেছেন, সহায়তা দিয়ে কৃতজ্ঞতাপাশে আবদ্ধ করেছেন।
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে মে, ২০২৩ রাত ১:৩৩