@রিজাইনা বিমানবন্দর, ০৬ মে ২০২৩
একেতো পরবর্তী ফ্লাইটের এক ঘণ্টা আগেই চেক-ইন, ইমিগ্রেশন ইত্যাদি সম্পন্ন করা শেষ হলো, তারপরও আবার পরবর্তী ফ্লাইট দুই ঘণ্টা বিলম্বে ছাড়বে- একেবারে শেষ স্টেশনে এসে মোট এই তিন ঘণ্টার অলস সময় যেন আর কিছুতেই কাটতে চাচ্ছিল না। লাউঞ্জে উদ্দেশ্যহীন, ইতস্ততঃ পায়চারি করা ছাড়া আর করার তেমন কিছুই ছিল না। ফ্রী ওয়াই-ফাই সংযোগ থাকা সত্ত্বেও ঢাকায় তখন গভীর রাত বিধায় কারো সাথে কথা বলারও ইচ্ছে হচ্ছিল না। সবাইকে শুধুমাত্র "আমরা ভালো আছি, সবকিছু ঠিকঠাক আছে"- এ ধরণের একটা সংক্ষিপ্ত বার্তা দিয়ে রাখলাম। বোর্ডিং না হওয়া পর্যন্ত একটা অহেতুক টেনশন ও অস্বস্তি মাথা চাড়া দিয়ে উঠছিল, ফলে ক্লান্তি ও অবসাদও বেড়ে যাচ্ছিল। কিছুক্ষণ হাঁটাহাটি করে সময় কাটিয়ে লাউঞ্জের পরিষ্কার ওয়াশরুমে ফ্রেশ হয়ে নিলাম, এতে অবসাদ কিছুটা লাঘব হলো বলে মনে হলো। সব ক্লান্তি, সব অবসাদ, সব অনিশ্চয়তার অবসান ঘটিয়ে এক সময় প্লেনে আসন গ্রহণের ডাক এলো। দুর্ভাগ্যক্রমে এবারেও আমার এবং আমার স্ত্রীর আসন পাশাপাশি পড়েনি, সামনে-পিছনে পড়েছে। দু'জনেরটাই তিন আসনের মধ্যবর্তী আসনে। আমরা দু'জন যার যার আসন খুঁজে বসে পড়লাম, দু'জনেরই আশেপাশের আসন দুটো তখনও খালি ছিল। একটু পরে এক বিশাল বপুর মধ্যবয়সী মহিলা আস্তে আস্তে হেঁটে আমার সারির (row) দিকে অগ্রসর হচ্ছিলেন। তাকে দেখে আমি মনে মনে প্রমাদ গুণতে শুরু করলাম এই ভেবে যে তিনি সারির অভ্যন্তরে প্রবেশ করবেন কিভাবে! আমার সারির কাছে এসে তিনি ইশারায় আমাকে জানালেন যে আমার পাশের জানালার ধারের আসনটিই তার। আমি তৎক্ষণাৎ সারি থেকে পুরোপুরি বের হয়ে এসে ওনাকে প্রবেশের জন্য gesture করলাম। আমার খুব কৌতুহল হচ্ছিল এটা দেখতে যে তিনি এই অস্বাভাবিক বপু নিয়ে কিভাবে প্রবেশ করেন। বেশ খানিকটা কসরৎ করে তিনি অবশেষে ধপাস করে তার আসনের উপর দেহ স্থাপন করলেন। এবারে আইলের পাশের আসনে কেমন যাত্রী আসেন সেটা দেখার অপেক্ষায় থাকলাম।
একটু পরেই দেখি স্যান্ডো গেন্জী আর শর্টস পড়া এক মোটাসোটা মধ্যবয়স্ক লোক কাঁধে একটা ব্যাগ ঝুলিয়ে আর হাতে একটা ক্যারী-অন লাগেজ টেনে আমাদের সারির দিকে আসছেন। বোধকরি এসব টানাটানির কারণে তার সাদা চামড়াটা ঈষৎ লাল বর্ণ ধারণ করেছিল। টাক-মাথা, গোলগাল মুখের এই ভদ্রলোকও আমার কাছে এসে ইশারায় জানালেন যে আমার পাশের খালি আসনটি তার। আমি সম্মতিসূচক ইঙ্গিত করলে তিনিও একরকম ধপাস করেই তার আসনে বসে পড়লেন। আমি ভেবে অবাক হচ্ছিলাম যে আমার পাশের দুজন যাত্রীই অস্বাভাবিক রকমের স্থূ্লদেহী, তবুও আসন গ্রহণের সময় তাদের উভয়ের হাতেই একটি করে কোকের ক্যান ধরা ছিল। আসন গ্রহণের পর ওরা দু'জনেই প্রথমে ঢকঢক করে কোক পান করলেন, তারপর সীট বেল্ট বাঁধার কাজে মনোনিবেশ করলেন। আমার সন্দেহ হচ্ছিল যে হয়তো প্লেনের সীট বেল্ট তাদের বিশাল বপুকে বাঁধতে পারবে না। তবে না, তারা সফলভাবেই সীট বেল্ট বাঁধতে পেরেছিলেন। আমার স্ত্রী পেছন থেকে আমাকে একটা খোঁচা দিয়ে বললেন, দুই মোটকা-মুটকির মাঝখানে চিড়ে চ্যাপ্টা হয়ে বসেছো, সাবধানে থেকো। ঘাড় ঘুরিয়ে সীটের ফাঁক দিয়ে দেখতে পেলাম, সে মুখ টিপে হাসছে। ওর একপাশে অবশ্য একজন মহিলাই ছিলেন, অপর আসনটি তখনও খালি ছিল।
আমাদের এ বিমানভ্রমণ মোট তিনটি সেক্টরে ভাগ করা ছিলঃ ঢাকা-দুবাই, দুবাই-টরন্টো এবং টরন্টো-রিজাইনা। তিনটির মধ্যে কেবল শেষেরটি পুরোপুরি দিবাভাগে ছিল। আমাদের যাত্রার দিনটি ছিল পূর্ণিমার দিন/রাত। ইচ্ছে ছিল, রাতের বেলায় পূর্ণিমার চাঁদ আর মেঘের লুকোচুরি খেলা দেখতে দেখতে কিছুটা সময় পার করে দিব। কিন্তু বিরূপ আসন বণ্টনের কারণে সে ইচ্ছেটি এ যাত্রায় পূরণ হলো না। তবে টরন্টো থেকে আমাদের প্লেনটি আকাশে উড্ডীন হবার পর আলো-ঝলমল, রৌদ্রোজ্জ্বল আকাশটাকে দেখতেও খুব ভালো লাগছিল। আমাদের দেশের শরতের আকাশের মত অনেকটা। উন্মুক্ত আকাশ দেখতে দেখতে এক সময় বিমান অবতরণের প্রস্তুতিমূলক ঘোষণা শোনা গেল। স্থানীয় সময় বিকেল ঠিক চারটার সময় আমাদের বিমানটি রিজাইনার ভূমি স্পর্শ করলো। আনায়াকে দেখার জন্য বের হবার তর সইছিল না, তাই মাত্র ছয় মিনিট পরেই দরজা খোলার সাথে সাথে আমরা দ্রুত বের হয়ে হাঁটা শুরু করলাম। ক্লান্তিকর এক যাত্রা শেষ করে ব্যাগেজ কালেকশন পয়েন্টের দিকে তরতর করে এগোচ্ছিলাম।
ভেবেছিলাম, ব্যাগেজ পয়েন্টে পৌঁছে ছেলেকে ফোন দিব। দোতলা থেকেই দেখতে পেলাম তিন ক্ষুদে সদস্যসহ মোট ছয়জনের একটি রিসেপশন টীম আমাদেরকে রিসীভ করার জন্য অপেক্ষমান। ওদের মধ্যে ছিল আমার বড় ছেলে এবং নাতনি আনায়া, ভাগ্নি তানিয়া, ভাগ্নি-জামাই সবুজ আর ওদের দুই মেয়ে আর্শী ও আয়রা। ওরা নিজেদের মধ্যে আলাপরত ছিল। আমি তাদেরকে দেখে হাত নাড়াতে নাড়াতে নীচে নামছিলাম। ওদের মধ্যে সবুজই প্রথমে আমাকে দেখতে পেয়ে হাত নাড়ালো। ওকে দেখে বাকি সবাই একে একে আমাদের দিকে তাকিয়ে হাত নাড়াতে থাকলো। বাচ্চাগুলোর সবার হাতে ধরা ছিল একটা করে কার্ড। নীচে নেমেই সবাইকে একে একে বুকে জড়িয়ে ধরলাম। ওরা আমাদের দিকে কার্ডগুলো এগিয়ে ধরলো। আমি আগ্রহ সহকারে ওদের হাত থেকে কার্ডগুলো নিয়ে পড়া শুরু করলাম। প্রতিটি কার্ডের লেখায় এবং ছবিতে ওদের কচি মনের উষ্ণ অভিব্যক্তি প্রকাশ পেয়েছে। ওদের উষ্ণতায় সকল অবসাদের অবসান হলো।
বাচ্চারা ওদের দিদি/নানুর সাথে সোফায় বসে গল্প শুরু করে দিল। তানিয়াও ওদের সাথে যোগ দিল। আমরা বাকি তিনজন লাগেজ সংগ্রহের জন্য এগিয়ে চললাম। অবাক হ'লাম দেখে যে এখানকার ডমেস্টিক বিমানবন্দরে ভিজিটরদেরকে baggage carousel পর্যন্ত আসতে দেয়া হয়। নাগরিকরা স্বভাবে ভালো হলে সুযোগ দিতে তো কোন অসুবিধে নেই। চলমান কনভেয়র বেল্টের উপর রাখা লাগেজের মধ্যে আমাদেরগুলোকে আমি শনাক্ত করে দিলাম, আমার ছেলে আর সবুজ মিলে সেগুলো নামিয়ে ট্রলীতে তুললো। বিমানবন্দর থেকে বের হয়ে সেগুলোকে দুই গাড়িতে ভাগ করে তোলা হলো। খোলা আকাশের নীচে এটুকু সময় দাঁড়িয়ে থাকার মধ্যেই ঠাণ্ডা বাতাস গায়ে লেগে শীতের দেশ কানাডার গ্রীষ্মকালের একটু ধারণা দিয়ে গেল, মনে হলো তা আমাদের দেশের শীতকালের ঠাণ্ডার চেয়েও বেশি। তানিয়া তাড়াতাড়ি করে গাড়ি থেকে একটা জ্যাকেট বের করে আমার হাতে দিল। আমি সেটা গায়ে চড়িয়ে গাড়িতে প্রবেশ করলাম।
বিকেল ঠিক পাঁচটায় ছেলের বাসায় প্রবেশ করলাম। সূর্যাস্তের সময় নির্ধারিত ছিল সাড়ে আটটায়। আমরা গোসল সেরে নিয়ে মাগরিবের আগেই ডিনার করে ফেললাম। এখানে অবশ্য প্রতিদিনই সবাই তাই করে বলে জানলাম। ডিনারের পর বাচ্চারা খেলা এবং বাকিরা গল্প শুরু করে দিল। মাগরিবের নামায পড়ে একটু বিশ্রাম নিব বলে আমি বিছানায় একটু গা এলিয়ে দিলাম। সাথে সাথেই গভীর ঘুমে চলে গেলাম। ঘুম যখন ভাঙলো, তখন ঘড়িতে সময় দেখি রাত সাড়ে দশটা। ইতোমধ্যে তানিয়ারা ওদের বাসায় চলে গেছে। আনায়া একমনে কিছু ছবি আঁকছে।
(সমাপ্ত)
রিজাইনা, কানাডা
০৬ মে ২০২৩
শব্দ সংখ্যাঃ ৯১৮
@রিজাইনা বিমানবন্দর, ০৬ মে ২০২৩
@রিজাইনা বিমানবন্দর, ০৬ মে ২০২৩
@রিজাইনা বিমানবন্দর, ০৬ মে ২০২৩
@রিজাইনা বিমানবন্দর, ০৬ মে ২০২৩
@রিজাইনা বিমানবন্দর, ০৬ মে ২০২৩
@রিজাইনা বিমানবন্দর, ০৬ মে ২০২৩
@রিজাইনা বিমানবন্দর, ০৬ মে ২০২৩
@রিজাইনা বিমানবন্দর, ০৬ মে ২০২৩