বাঙ্গালী জাতীয়তাবোধের সাথে ধর্মের বিরোধটা কোন জায়গায় বা আদৌ বিরোধ আছে কিনা ? বা ধর্ম পালন করলে কি বাঙ্গালী জাতীয়তাবোধে বিশ্বাস করা যায়না ? দেশপ্রেম যদি ঈমানের অঙ্গ হয় তাহলে আমি ধর্মের সাথে রাষ্ট্রের বা জাতীয়তাবোধের কোন বিরোধ দেখি না। অথচ একটি বিশেষ ধর্র্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল তাদের মতাদর্শের অনুসারী লোকদের কাছে সবসময় বাঙ্গালী জাতীয়তাবোধের সাথে ধর্মীয় পরিচয়ের বিরোধের কথা প্রচার করে আসছে।তাদেরকে যে কোন আলোচনায় বুক ফুলিয়ে বলতে শিখানো হচ্ছে, আমি আগে মুসলমান তারপর বাঙ্গালী। আপাতদৃষ্টিতে অত্যন্ত নিরীহ কথাটির মাঝের তাৎপর্য অনুধাবন করা যায় যখন তারা বাঙ্গালী জাতীয়তাবোধে বিশ্বাসী একজন ভিন্ন ধর্মানুসারী লোককে হত্যার নির্দেশ দেয় শুধুমাত্র পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধে বাঙলাদেশী জাতীয়তাবোধকে সমর্থন করায়। তখন সেটা আর নিরীহ বাক্যের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনা, তখন সেটা উগ্র ধর্মান্ধতার নিকৃষ্টতম উদাহরন হয়ে দাঁড়ায়। ধর্মীয় অনুভূতিকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহারের জন্যই মূলত বাঙ্গালী জাতীয়তাবোধের সাথে ধর্মীয় পরিচয়ের বিরোধটি উদ্ভাবন করা হয়েছে। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, ৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে বিরোধিতার কারন হিসেবে তারা বলেছিল পাকিস্তানীরা এবং বাঙলাদেশীরা মুসলমান ভাইভাই। তারা তখনই এদুটোর মধ্যে বিরোধকে নিজেদের স্বার্থে সফলভাবে কাজে লাগিয়েছে। বাবরী মসজিদ ভাঙ্গার পর এদেশে হিন্দু মুসলিম দাঙ্গাকে সম্প্রসারিত করার জন্যও তারা এদেশের মুসলমানদের কাছে বাঙ্গালী জাতীয়তাবোধের চেয়ে মুসলমান পরিচযটাকে বড় করে উপস্থাপন করেছিল।বাবরি মসজিদ ভাঙার জন্য বা ভারতীয় মুসলমানদের হত্যা করার জন্য ভারতের তৎকালীন ক্ষমতাসীন সরকার বা সেদেশের হিন্দুরা দায়ী থাকতে পারে কিন্তু সেজন্য কোনোভাবেই এদেশের হিন্দুরা দায়ী নন, এ চরম সত্যটাকে নির্মমভাবে উল্টে দিয়ে তারা ভোটের রাজনীতির স্বার্থে ব্যবহার করেছেন। মায়ানমারের রোহিঙ্গা ইস্যুতেও তারা সামনে নিয়ে এসেছিল তাদের মুসলমান পরিচয়। এদেশে যেসকল রোহিঙ্গা অবৈধভাবে আছে তাদের আশ্রয়দাতা যে জামায়াত শিবির এটা চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার এলাকায় রোহিঙ্গাদের আধিক্য এবং ঐ সকল স্থান জামায়াত শিবিরের ভোট ব্যাংক হওয়াই প্রমান করে। নিজেকে প্রবলভাবে আগে মুসলমান তারপর বাঙ্গালী দাবী করা কোন ব্যাক্তি বা গোষ্ঠী মুক্তিযুদ্ধ করেনি, মুক্তিযুদ্ধ করেছে এদেশের আপামর জনসাধারন। যাদেরকে দিনে এনে দিনে খেতে হত, যাদেরকে নির্যাতিত হতে হত সমাজের প্রতিটি স্তরে, যাদের প্রবাসে পালিয়ে থাকার মত কোন নিরাপদ আশ্রয় ছিলনা, যাদেরকে নিজেদের অস্তিত্ত্ব রক্ষা করতে হলে হয় মরতে হত নয় মারতে হত, তারাই মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে এদেশকে স্বাধীন করেছে । মুক্তিযোদ্ধা হিশেবে তাদের প্রত্যেকের মূল পরিচয় ছিল বাঙ্গালী, মুসলমান নয়। ধর্মের সঙ্গে যদি বাঙ্গালী জাতীয়তাবোধের বিরোধ থাকত তাহলে বাংলার হিন্দু-মুসলমান সেদিন কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করতে পারত না। ধর্মীয় দিক থেকে বিবেচনা করলে আমার সবার আগে মুসলমানই, কিন্তু ভৌগোলিক, আঞ্চলিক বা ভাষাগত বৈশিষ্ট্যের দিক থেকে বিবেচনা করলে আমরা আগে বাঙ্গালীই থাকি। মুসলমান পরিচয় উপস্থাপন করতে চাইলে ব্যক্তি বিবেচিত হবে পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা সমস্ত মুসলমানদের একজন হিশেবে, শুধুমাত্র বাঙলাদেশের মুসলমান হিশেবে নয়। আর বাঙ্গালী পরিচয় দিলে ব্যক্তি বিবেচিত হবে বাঙলাদেশী জাতীয়তাবোধে বিশ্বাসী, এদেশের নিজস্ব সংস্কৃতি ধারন করে এমন ব্যক্তি হিশেবে। এদুটো সম্পূর্ন পৃথক সত্ত্বা। দুটো ভিন্ন সত্ত্বার মধ্যে বিরোধ দেখা দেওয়ার প্রশ্নই আসেনা। দুটো সত্ত্বাকেই সমানভাবে ধারন করা সম্ভব। যারা মুক্তিযুদ্ধের সময়ও সত্ত্বা দুটোর মাঝে বিরোধ দেখেছে বা একটাকে অন্যটার পরে স্থান দিয়েছে তারাই মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীতা করেছে এবং বীরযোদ্ধাদের বেইমান সাব্যস্ত করে তাদের পরিবারে লুটপাট, হত্যা, ধর্ষন চালিয়েছে। বাঙ্গালী পরিচয়ে হিন্দু মুসলিম নির্বিশেষে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সংগঠিত হওয়ার পর, দেশ স্বাধীন করার পর কারো মুসলমানিত্ব কিন্তু খারিজ হয়ে যায়নি, তারপরও তারা প্রত্যেকে ধর্মপ্রাণ মুসলমানই ছিলেন। দেশের প্রয়োজনেই তারা বাঙ্গালী হিসেবে সংগঠিত হয়েছিলেন। দেশের প্রয়োজন হলে তারা একইভাবে মুসলমান হিসেবেও সংহঠিত হবেন।
বর্তমানের প্রেক্ষাপটেও যারা মুসলমান পরিচয়ের সঙ্গে বাঙ্গালী পরিচয়ের বিরোধ দেখছে বা নিজেকে আগে মুসলমান পরে বাঙ্গালী দাবী করছে তারা প্রকৃতপক্ষে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকেই অস্বীকার করছে। নিজেদের স্বার্থে ধর্মকে অসাধারনভাবে ব্যবহার করছে মাত্র ! আমি মুগ্ধ হয়ে ধর্মের বহুরুপী ব্যবহার দেখি।
স্বাধীনতার ৪২ বছর পরেও আমাদের দেশে স্বাধীনতা বিরোধীরা একই কৌশল নিয়ে একই উদ্দেশ্যে বর্তমান। যুদ্ধপরাধীদের বিচার বানচাল করার জন্য তারা আবার সামনে এনেছে বাঙ্গালীর সাথে মুসলমানের বিরোধ। যুদ্ধপরাধীদের বিচার দাবী করা বৃহৎ জনগোষ্ঠীর একটি ক্ষুদ্র অংশের ইসলাম বিরোধী কর্মকান্ডকে তারা সমস্ত লোকের কর্মকান্ড হিশেবে দেখিয়ে যুদ্ধপরাধীদের বিচারের দাবীকে ইসলাম বিরোধী কর্মকান্ড হিশেবে সাধারন মানুষের কাছে প্রমান করার চেষ্টা করছে। বলাই বাহুল্য তারা অনেকাংশে সফল হয়েছে।
৪২ বছরে আমরা বাঙ্গালীরা অনেক কিছুতেই সচেতন হয়েছি কিন্তু রাজনীতি এ হিশাবের বাইরেই থেকে গেল।
(এই দেশে বসবাসকারী প্রত্যেকটি মানুষকে আমি সমান মনে করি। শুধুমাত্র মুসলমান নয় বলে কারো ধর্মীয় উপাসনালয় ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে দেয়ার বা তাকে এই দেশ থেকে বের করে দেয়ার চরম বিরোধী আমি। এতে যদি ধর্মের জাত যায় তো যাক তাতে আমার কিছুই যায় আসেনা। আসলে এতে ধর্মের জাত যাবেনা, যদি যায় যাবে ধর্মকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহারকারী গোষ্ঠীর। ধর্মের উৎপত্তি কোন ব্যক্তিস্বার্থে বা গোষ্ঠীস্বার্থে হয়নি, হয়েছে সমস্ত মানবজাতির কল্যানে।)
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে মার্চ, ২০১৩ দুপুর ১২:৩৯