বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থি্থতিতে 90 দিনের সাংবিধানিক বিধানানুযায়ী গ্রহণযোগ্য সুষ্ঠু নির্বাচন সম্পন্ন করা নির্বাচন কমিশনের জন্য প্রায় অসম্ভ্ভব হয়ে পড়েছে। তারপরও সরকারি মহল এবং মতা থেকে সদ্য বিদায় নেওয়া চারদলীয় জোট নেতারা সংবিধানে উল্লেখিত 90 দিনের সময়সীমার মধ্যে নির্বাচন শেষ করার জন্য অব্যাহত তাগিদ দিচ্ছেন। এ পরিস্থি্থতিতে চারবার নির্বাচনী তফসিল বদল করা হয়েছে। আওয়ামী লীগসহ ভিন্নমতের রাজনৈতিক দলগুলো মহাঐক্যজোট গঠন করে ঘোষিত তফসিল প্রত্যাখ্যান করেছে।
সংবিধানের নির্বাচন সংক্রান্ত সপ্তম ভাগে 123(3) অনুচ্ছেদে সংসদ সদস্যদের সাধারণ নির্বাচনের যে সময়সীমা দেওয়া আছে তা সংবিধানের কোনো মৌলিক বিধান নয়। সাধারণ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার প্রণালী সম্পর্কিত এবং একটি নির্দেশনামূলক বিধান। সংবিধানের বাধ্যতামূলক ও নির্দেশনামূলক বিধানগুলোর তাৎপর্য বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে রাষ্ট্র্রপরিচালনার মূলনীতি সম্পর্কিত নির্দেশগুলোর েেত্র সংবিধানেই বলা আছে, এগুলো আদালতের মাধ্যমে প্রযুক্ত হবে না। অর্থাৎ রাষ্ট্র এর আলোকে পরিচালিত হবে, কিন্তু এগুলোর বিপরীতমুখী পথে অগ্রসর হতে পারবে না। সাধারণ ভাবে এগুলোকেই নির্দেশনা মূলক বিধান বলা হয়। এর বাইরেও কিছু নির্দেশনামূলক বিধান রয়েছে। যার মধ্যে অন্যতম বিচার বিভাগের স্বাধীনতার সঙ্গে সম্পর্কিত নিম্ন আদালতের বিচারকদের নিয়ন্ত্রণ সম্পর্কিত বিধিমালা তৈরি, ন্যায়পাল প্রতিষ্ঠা, কয়েক বছর আগে প্রতিষ্ঠিত স্বাধীন সংসদ সচিবালয়, স্থানীয় সরকার বিষয়ক নির্দেশনার মতো গুরুত্বপূর্ণ বিধানগুলো। এত বছরেও এসব সাংবিধানিক বিধান অনুসরণ না করায় দেশে সাংবিধানিক সংকট সৃষ্টি হয়নি। নির্বাচনের সময়সীমা সম্পর্কিত নির্দেশনাটিকেও অনেকেই এই দৃষ্টিতে দেখেন। তাদের মতে, এই নির্দেশনাটি পালিত না হলে প্রজাতন্ত্রের অপর কোনো অঙ্গ বা প্রতিষ্ঠানের কাজকর্মে আইনগত সমস্যা বা জটিলতা দেখা দেবে না। কারো কর্তৃত্ব কিংবা কৃতকর্ম সম্পর্কে বৈধতার প্রশ্ন উঠবে না। এ সম্পর্কে আইন বিশেষজ্ঞদের কারো কারো মত হচ্ছে, নির্বাচনের সময়সীমা সম্পর্কিত নির্দেশনাটি শুধু নির্বাচন কমিশনের জন্য। রাষ্ট্রের অপর কোনো অঙ্গ বা বিভাগের প্রতি নয়। সরকারের দায়িত্ব হচ্ছে শান্তিপূর্ণ, সুষ্ঠু ও নিরপে নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য কমিশনকে সহায়তা দেওয়া। নির্ধারিত 90 দিনের সময়সীমার মধ্যে নির্বাচন সম্পন্ন না হলে কী হবে_ এ ব্যাপারে সংবিধানে কিছু বলা নেই। তারপরও যথাসময়ে নির্বাচন সম্পন্ন না হলে সরকার কিংবা দেশের অপর কোনো কাজকর্ম বিঘি্নত হওয়ার সুযোগ নেই। সংবিধানে বলা আছে, পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী শপথ না নেওয়া পর্যন্ত তত্ত্বাবধায়ক সরকার দায়িত্ব পালন করবেন। অর্থাৎ সংসদ নির্বাচন সম্পন্ন হওয়ার পর সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ না হওয়া পর্যন্ত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের রাষ্ট্র্রের নিয়মিত কার্যক্রম পরিচালনা করতে থাকায় কোনো বাধা নেই। এই সরকার সাংবিধানিক সরকার হিসেবেই দায়িত্ব পালন করবে এবং এর কোনো কাজকর্মই কোনো আদালত অবৈধ বলে ঘোষণা করতে পারবেন না।
সরকারি ব্যয় মেটানোর জন্য 'আদেশ' দিয়ে টাকা তোলার এখতিয়ার সংবিধানের 92(3) অনুচ্ছেদে রাষ্ট্র্রপতিকে দেওয়া আছে। সে হিসেবে আগামী বছর 30 আগস্ট পর্যন্ত দেশ চালাতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাংবিধানিক কোনো বাধা নেই। তার আগে যে কোনো সময় নির্বাচন সম্পন্ন করে সংসদের অধিবেশন বসানোর ব্যবস্থ্থা করতে পারলে দেশে কোনো সংকট সৃষ্টি হবে না।
তবে 90 দিন অতিক্রান্ত হওয়ার পর নির্বাচন সম্পন্ন করতে গেলে নির্বাচন কমিশনের এখতিয়ার নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে। এমনকি সে নির্বাচনের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠলে এখতিয়ারবহিভর্ূত কাজ হিসেবে ফলাফল বাতিল হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে বলে অনেকে মনে করেন। এই আশঙ্কা উড়িয়ে দিয়ে আইনজীবীদের অনেকেই সংবিধানের 125(খ) অনুচ্ছেদের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। এই অনুচ্ছেদটিতে নির্বাচনী বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য নির্ধারিত পদ্ধতির দরখাস্ত ছাড়া রাষ্ট্রপতি বা সংসদ নির্বাচনের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। তাদের মতে, নির্বাচন কমিশন তাদের ওপর অর্পিত সাংবিধানিক দায়িত্ব পালনের জন্য একাধিক দফা তফসিল ঘোষণা করেছে। কিন্তু সংবিধানসম্মত নির্বাচন অনুষ্ঠান অর্থাৎ সংবিধানের 7(2) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটে না_ এমন কোনো নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্ভব না হলে দায়িত্ব পালন করতে না পারার দায়ে তাদের আর শপথ লঙ্ঘনের অভিযোগে অভিযুক্ত করা যাবে না। এেেত্র সংবিধানের 106 অনুচ্ছেদের আওতায় সুপ্রিম কোর্টের মতামতের জন্য নির্বাচন কমিশন বিষয়টি রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠাতে পারবেন। বর্তমান পরিস্থিতি মনুষ্যসৃষ্ট হলেও এটাকে দুর্বিপাক এবং নির্ধারিত সময়ের মধ্যে অতিক্রমের অযোগ্য বলে তুলে ধরতে পারলে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ 90 দিনের পরের কোনো তারিখে নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য মত দিতে পারেন। সংবিধানের অবিভাবক হিসেবে সুপ্রিম কোর্টের এই এখতিয়ার রয়েছে। এরূপ েেত্র 'ডকট্রিন অব নেসেসিটি'র নীতি অনুসরণ করে আদালত নির্দেশ দেন। এ ব্যাপারে আইন বিশেষজ্ঞ ড. শাহদীন মালিক ফৌজদারি কার্যবিধির বিভিন্ন আইনের উদ্বৃতি দিতে গিয়ে বলেন, ফৌজদারি আইনে 90 দিনের মধ্যে বিচারকাজ শেষ করার বিধান সংবলিত ধারায় নির্ধারিত সময়ের মধ্যে বিচার শেষ না হলে কী হবে বলা নেই। এর সুযোগ নিয়ে অনেকেই মামলা খারিজ করিয়ে নিতে চাওয়ায় আপিল বিভাগ থেকে রায় দিয়ে বলা হয়, নির্দেশনামূলক বিধান পালিত না হলেও মামলার কাজ চলবে। তার মতে, ফৌজদারি আইন অপোকৃত সুনির্দিষ্ট এবং সেখানে যখন বলা হচ্ছে, যেসব েেত্র সময় বেঁধে দেওয়া আছে সেখানে তা বাধ্যতামূলক নয়। এই আলোকে বিবেচনা করলে, নির্বাচনের মতো বিষয়ে জাতির ভালো-মন্দটাই বড় কথা। তিনি বলেন, এেেত্র সাংবিধানিক ব্যাখ্যা করতে হলে সংবিধানের 7 অনুচ্ছেদকে বিশেষভাবে প্রাধান্য দিতে হবে। এই অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সংবিধান সর্বোচ্চ আইন, তবে তা 'জনগণের অভিপ্রায়ের পরম অভিব্যক্তি রূপে' হতে হবে। নির্বাচনে দেশের জনসংখ্যার অধিকাংশের মত প্রতিফলিত না হয়ে মাত্র কয়েক শতাংশের মতের প্রতিফলন ঘটার সম্ভ্ভাবনা থাকলে সময়সীমার বিষয়টিকে প্রাধান্য দেওয়ার অবকাশ থাকে না। সে েেত্র গ্রহণযোগ্য ও অধিকসংখ্যক লোককে সম্পৃক্ত করার প্রয়োজনে পরবর্তী সময়ে নির্বাচন করার ব্যবস্থ্থা হতেই পারে। তিনি আরো বলেন, 90 দিনের সময়সীমা বিবেচনার আগে নির্বাচন কমিশনকে দেখতে হবে সংবিধানের 119(ঘ) অনুযায়ী তারা সংসদ নির্বাচনের জন্য ভোটার তালিকা প্রস্তুত করেছেন কি-না। এই ভোটার তালিকা যথাযথভাবে প্রণয়নের জন্য তাদের প্রতি সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশ রয়েছে। অতএব ভোটার তালিকা যথাযথভাবে প্রস্তুত না হওয়া পর্যন্ত নির্বাচনী তফসিল নিয়ে তারা অগ্রসর হতে না পারলে সুপ্রিম কোর্টের কাছ থেকে প্রয়োজনে সময় চাইতে পারেন। এরপরও সাংবিধানিক শাসনের ধারাবাহিকতা রার প্রশ্নে বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
সূত্র: সমকাল
সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে ডিসেম্বর, ১৯৬৯ সন্ধ্যা ৭:০০

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



