somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

সানভী-২

২৯ শে নভেম্বর, ২০২১ রাত ১১:০২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


- আমি চাই তুমি আবার আজ সেই লাল শাড়িটাই পরো যুঁথি। সেই লাল টুকটুক জামদানী পরা নতুন নতুন বৌটাকে নিয়ে আমি যেদিন প্রথম আকাশে উড়েছিলাম। সেই ছবিটাই দেখতে চাই আরেকবার।
জানিনা এত রাগ আর বিদ্বেষের পরেও কেনো যুঁথি আমার কথাই মেনে নিলো। মনে হলো আমার এই প্রস্তাব মেনে নিতে ওর বড্ড কৌতুক হচ্ছিলো। যুঁথির এই কৌতুকে নেচে ওঠা চোখের তারাগুলি আমার বড় প্রিয়। যুঁথি জানেনা একটা কথা যে ওর মাঝে এই চেপে রাখা আনন্দের ঝিলিক খেলে যাওয়া মুখটাকে আমি দারুন ভালোবাসি। অন্যান্য সব বারের মতনই যুঁথি মনে হয় ভাবছিলো এটাও আমার নতুন কোনো খেলা। তাই সব হারিয়ে ফেলতে ফেলতেও যুঁথি সেই খেলাতেই মেতে উঠলো আবারও। যুঁথি রাজী হয়ে গেলো।

তিন বছর আগের সেই প্রথম ভ্যালেনটাইনে উপহার দেওয়া লাল শাড়িটাই পরেছে যুঁথি। আর আমি সেই সাদা টি শার্ট আর ব্লু জিনস। আমার মনে হচ্ছিলো সেই দিনগুলোতেই ফিরে গেছি আবারও। মাঝে এতগুলো দিন কোনোরকম তিক্ততায় কাটেনি আমাদের। যেন সেই নতুন দিনেরই আমরা। প্লেনে উঠবার পর যুঁথির হাতে হাত রাখলাম আমি সেই দিনটির মতই। আমার মনে পড়ছিলো সেই স্বপ্নের দিনগুলোর কথা। যুঁথিরও মনে পড়ছে নিশ্চয়ই একই কথা মানে একই ঘটনাগুলি। জানতে চাইলাম খুব আস্তে ওর কানের কাছে মুখ নিয়ে-
- কি মনে পড়ছে বাবুনী?
আমরা ভালোবেসে কতইনা নাম দেই একেকজন একেকজনকে তারপর দিন বদলের সাথে সাথে আমরাও বদলে যাই ভালোবাসাও হারিয়ে যায় শুধু থেকে যায় নামগুলো, থেকে যায় স্মৃতিগুলো। কখনও কখনও সেসব মনে করে ব্যথায় মুসড়ে পড়ি, কখনও বা এক চিলতে হাসি ফুটে ওঠে আমাদের মুখে। সে যাইহোক আমি যুঁথিকে বললাম,
- যুঁথি আমরা এই একটা মাস মাঝে ঘটে যাওয়া সবকিছু ভুলে যাবো। যেন নতুন করে চিনেছি আমরা দু'জন দু'জনকে। যুঁথি হেসে ফেললো।বললো,
- আমার বড় হাসি পাচ্ছে সানভী। তোমার এই পাগলামীতে সায় দিয়ে যাচ্ছি। কারণ আমিও তো আরেক পাগলই তাই নয় কি? এক পাগলই শুধু আরেক পাগলের পাগলামীকে মূল্য দেয়। আর সেটাই দিয়েছিলাম আমিও আসলে। যুঁথির গলা ধরে আসলো। আমারও একটু কষ্ট হচ্ছিলো।

আমি নিশ্চুপ রইলাম। মনে মনে বললাম, আমি এমনটা চাইনি যুঁথি। সত্যিই চাইনি। তোমাকে হারাতে চাইনি আমি। হুট করেও তোমাকে আমি বিয়ে করেছি এটাও সঠিক নয়। আমি ভেবে চিন্তেই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। এই জীবন আমাকে শিখিয়েছে ভেবে চিন্তে জাল ফেলা। হ্যাঁ জাল ফেলাই বলবো আমি এটাকে। এই জীবনে চলতে গেলে সোজা আঙ্গুলে ঘি না উঠলে আঙ্গুলটা বাঁকাতেই হয়। সে আমি জেনে গেছি বহুদিন আগেই। এই আঙ্গুলটা বাঁকানো শিখতে হয়েছে আমাকে বড় চতুরতার সাথেই তবে আঙ্গুল বাঁকানোটা আসলে একটু কঠিন। সে বড় বড় মানুষেরা পারে। তাতে অর্থ বিত্ত বৈভব বা প্রাচুর্য্যের শক্তি থাকতে হয় অথবা পেশীর জোর। কোনোটাই আমার ছিলো না তাই আঙ্গুল বাঁকানোর পরিবর্তে আমাকে জাল ফেলাটাই শিখতে হলো। নিজের মাঝের এই আমিকে আমি ছাড়া কে চেনে আর?

যুঁথির আঙ্গুলের ভাঁজে আঙ্গুলগুলো ঢুকিয়ে সিটে মাথা রেখে চোখ বুজলাম আমি। চোখ বুজলেই আমার চোখের পাতায় চলে আসে আমার অতীত। মাঝে মাঝে দুঃস্বপ্ন দেখে ঘুমের মাঝেও আমি আর্তনাদ করে উঠে বসি। আমার অতীত বিশেষ করে আমার ছেলেবেলা আমাকে তাড়া করে ফেরে। আজকের এই আমি, যে সাজানো আমিকে দেখছে যুঁথি এই আমিটার আসলে অন্যরকম থাকবার কথা ছিলো। আজকের এই সাজানো ফ্লাটের চাকচিক্যময় জীবনের এই আমিকে আসলে হয়তবা নর্দমা বা আস্তাকুড়েই পড়ে থাকতে হত। এমন পড়েও থাকে হাজারে হাজারে আনাচে কানাচে এই শহরের। কিন্তু আমি থাকিনি। উঠে এসেছি সুকোৌশলে। সকল প্রতিবন্ধকতাকেই জয় করে ফেলার দৃঢ় মনোবল অর্জন করেছি আমি।

হ্যাঁ এর জন্যই কিছু শঠতার আশ্রয় নিতেও হয়েছিলো আমাকে। সে আমি জানি। আর তার জন্য আমি মোটেও অনুতপ্ত নই। আমি মনে করি পৃথিবীতে মানুষ জন্মায় লড়াই করবার জন্যই। এই লড়াই এ প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করে টিকে থাকতে হয়। এই লড়াই এ ইতিবাচক নেতিবাচকতার ধার ধারতে গেলে আস্তাকুড়ে পড়ে থাকার সম্ভাবনাটাই আসলে বেশি। তাই যে ভাবেই হোক লড়াই এ জিততেই হবে। সেখানে শঠতা, ধূর্ততা বা নিয়ম অনিয়মের কোনো বালাই নেই। শুধু ভালোবাসার মাঝে কোনো খাঁদ থাকতে নেই। সেখানে কোনো কপোটতা থাকলেই পরাজয় অনিবার্য্য। পৃথিবীতে গায়ের জোরে সবই কেড়ে নেওয়া যায়। বুদ্ধির জোরেও। কিন্তু ভালোবাসা? দীর্ঘশ্বাস পড়ে আমার।

তবে কি আমি ভালোবাসার মাঝেও কপোটতার আশ্রয় নিয়েছিলাম? হ্যাঁ এই ব্যপারটা মনের মাঝে চেপে রাখলেও, যুঁথি এবং আর সকলের চোখে ধুলো দিতে পারলেও আমি খুব ভালো করেই জানি এখানেও আমি শঠতার আশ্রয় নিয়েছি। যুঁথির চারপাশে অদ্ভুত এক ঘোর লাগিয়েছি। সুকৌশলে এবং খুব সাবধানে। নাহ আমি এই ঘোর কেটে ওর বেরিয়ে আসবার আগেই ওকে বিয়ে নামক ঘেরাটোপে আটকে ফেলতে চেয়েছিলাম। ওকে বেশি বুঝে উঠবার আগেই আমি বন্দী করে ফেলেছিলাম। কিন্তু কেনো?

এই সব কেনোর উত্তরও একমাত্র আমারই জানা। তবুও কখনও নিজের মুখোমুখি দাঁড়াইনা আমি। ছেলেবেলায় যখন থেকেই বুঝে উঠলাম অন্য অনেকের মত আমাকে মুখে তুলে কেউ দেবে না। এমনকি নিজের মা বাবা পরিবারও না। তখনই বুঝে গেলাম এই জগতের লড়াই এ আমাকে ছিনিয়ে নিতে হবে। তখন থেকেই আমার কঠিন কঠোরতার দীক্ষার শুরু। এই পৃথিবীর কোনো মায়া দয়া প্রেম ভালোবাসাই আমাকে টানেনি। টেনেছে বেঁচে থাকার লড়াই এ উপরে ওঠার প্রতিযোগীতার সিড়িতে কিভাবে এবং কেমন করে উঠে যাবো এই নগন্য আমি সেই চিন্তাটা। বিধাতা আমাকে উপরে ওঠার সিড়ি দেননি। নীচে পড়ে থাকবার জন্যই আমার জন্ম। অতি ক্ষুদ্র ও নগন্য আমি, কিচ্ছু নেই আমার কিন্তু এই যে চারপাশে এত মানুষ তাদের এত আছে কেনো? এ কি বিধাতার অবিচার? কারো থাকবে কারো থাকবে না তা তো হয় না।

আমি খুব ভালো করেই জানি আর দশটা পরিবারের মত আমার পরিবার ছিলো না। আর সবার বাবারা উপার্জন করতো আর মায়েরা সংসারের কাজ কিন্তু আমার অলস এবং অকর্মন্য বাবার কারণে মাকেই সংসারের হাল ধরতে হয়েছিলো। স্কুলের বেতন যখন বাকী পড়তো দিনের পর দিন আমি মুখ বুজে শিক্ষকদের সকল অপমান সহ্য করতাম। আমার ছোট বোনটা পারতোনা। বাড়ি ফিরে কান্নাকাটি করতো, যেতে চাইত না। মা যা পারতো তাই তাকে দিয়ে পাঠাতো। তাকে কষ্ট সহ্য করতে যেন না হয় সেই চেষ্টা ছিলো আমার এবং মায়েরও। কিন্তু বিধাতার উপর অভিমনােই বোধ হয় আমি মুখ বুজে সহ্য করতে শিখে গিয়েছিলা। এই পৃথিবীর সকল অত্যাচার সহ্য করার ব্রত নিতে পারিনি।

এইভাবেই কাটছিলো দিন। অবজ্ঞা এবং অভিমানে আমি দিনে দিনে ক্রুড় কঠিন রুঢ় হয়ে উঠছিলাম সকলের অগোচরে। ক্লাস ৭ থেকেই টার্গেট করলাম ক্লাসে নতুন আসা বিশাল ধনী পরিবারের ছেলে ইমতিয়াজকে। বলতে গেলে তখন থেকেই আমার এই মোহ লাগানো অভিনয়ের শুরু। ওর সাথে সখ্যতা গড়ে তুললাম সুকৌশলে। ধীরে ধীরে ওর মন জয় করে নিলাম। ওর সঙ্গের কারণে আমার ভেতরে আরও দৃঢ় বিশ্বাস প্রোথিত হলো টাকাই যে জীবনের সব। যে কোনো মূল্যে নীতি বা নীতিহীনতার ধার না ধেরে টাকা উপার্জনে আসলে কোনো দোষ নেই। আমার ভেতরের বোধ বু্দ্ধি বিবেক সকলই বিসর্জিত হলো । নিজেকেই নিজে সকল নীতিহীনতার প্রবোধ দিতে শুরু করলাম নিজেরই অগোচরে .....

- দেখো দেখো জানালার বাইরে কি সুন্দর পেঁজা তুলো মেঘ।
চোখ মেলে আমি পেঁজা তুলো মেঘ না যুঁথির মুখে দেখলাম সেই আনন্দের ঝিলিক। যেই সৌন্দর্য্যের কাছে পেঁজা তুলো মেঘেরাও হার মেনে যায়।
যুঁথি আমার দিকে তাকিয়ে লজ্জিত হলো।
-স্যরি। ঘুম ভাঙ্গিয়ে দিলাম।
আমার মন খারাপ হচ্ছিলো। এই মেয়েটাও চলে যাবে আমাকে ছেড়ে। কেউ থাকবে না আমার। কেউ না। এই পৃথিবীতে কেউ নেই আমার। কেউ কখনও থাকবেও না। ছিলও না কখনও।


আমার আবার ভেতরে ভেতরে প্রচন্ড রাগ হতে থাকে। সেই চন্ডাল ক্রোধ। আমি যুঁথির হাত চেপে ধরি শক্ত করে। যুঁথি ভয় পেয়ে হতবাক তাকিয়ে থাকে আমার মুখে......
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে নভেম্বর, ২০২১ রাত ১১:০২
২৮টি মন্তব্য ২৮টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ছায়ানটের ‘বটমূল’ নামকরণ নিয়ে মৌলবাদীদের ব্যঙ্গোক্তি

লিখেছেন মিশু মিলন, ১৭ ই এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



পহেলা বৈশাখ পালনের বিরোধীতাকারী কূপমণ্ডুক মৌলবাদীগোষ্ঠী তাদের ফেইসবুক পেইজগুলোতে এই ফটোকার্ডটি পোস্ট করে ব্যঙ্গোক্তি, হাসাহাসি করছে। কেন করছে? এতদিনে তারা উদঘাটন করতে পেরেছে রমনার যে বৃক্ষতলায় ছায়ানটের বর্ষবরণ... ...বাকিটুকু পড়ুন

বয়কটের সাথে ধর্মের সম্পর্কে নাই, আছে সম্পর্ক ব্যবসার।

লিখেছেন ...নিপুণ কথন..., ১৭ ই এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:৫০


ভারতীয় প্রোডাক্ট বয়কটটা আসলে মুখ্য না, তারা চায় সব প্রোডাক্ট বয়কট করে শুধু তাদের নতুন প্রোডাক্ট দিয়ে বাজার দখলে নিতে। তাই তারা দেশীয় প্রতিষ্ঠিত ড্রিংককেও বয়কট করছে। কোকাকোলা, সেভেন আপ,... ...বাকিটুকু পড়ুন

মানুষের জন্য নিয়ম নয়, নিয়মের জন্য মানুষ?

লিখেছেন রূপক বিধৌত সাধু, ১৭ ই এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৫:৪৭



কুমিল্লা থেকে বাসযোগে (রূপান্তর পরিবহণ) ঢাকায় আসছিলাম। সাইনবোর্ড এলাকায় আসার পর ট্রাফিক পুলিশ গাড়ি আটকালেন। ঘটনা কী জানতে চাইলে বললেন, আপনাদের অন্য গাড়িতে তুলে দেওয়া হবে। আপনারা নামুন।

এটা তো... ...বাকিটুকু পড়ুন

একজন খাঁটি ব্যবসায়ী ও তার গ্রাহক ভিক্ষুকের গল্প!

লিখেছেন শেরজা তপন, ১৭ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:০৪


ভারতের রাজস্থানী ও মাড়ওয়ার সম্প্রদায়ের লোকজনকে মূলত মাড়ওয়ারি বলে আমরা জানি। এরা মূলত ভারতবর্ষের সবচাইতে সফল ব্যবসায়িক সম্প্রদায়- মাড়ওয়ারি ব্যবসায়ীরা ঐতিহাসিকভাবে অভ্যাসগতভাবে পরিযায়ী। বাংলাদেশ-ভারত নেপাল পাকিস্তান থেকে শুরু করে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছিঁচকাঁদুনে ছেলে আর চোখ মোছানো মেয়ে...

লিখেছেন খায়রুল আহসান, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:০৯

ছিঁচকাঁদুনে ছেলে আর চোখ মোছানো মেয়ে,
পড়তো তারা প্লে গ্রুপে এক প্রিপারেটরি স্কুলে।
রোজ সকালে মা তাদের বিছানা থেকে তুলে,
টেনে টুনে রেডি করাতেন মহা হুলস্থূলে।

মেয়ের মুখে থাকতো হাসি, ছেলের চোখে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×