somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

যুঁথি-৩

০৩ রা ডিসেম্বর, ২০২১ রাত ৮:৩০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


মাঝে মাঝে সানভীকে বড় দূর্বোধ্য লাগে আমার। যেমন এখন ভীষন ভয় লাগছে ওর মুখের দিকে চেয়ে। এমন অদ্ভুতুড়ে চাহনী। আমি শিউরে উঠলাম। ভয়ও পেলাম একটু। এখন এই প্লেনের ভেতরে আবার সিনক্রিয়েট করলে তো বিপদ। সানভী আমার হাতটা এতটাই শক্ত করে চেপে ধরে আছে যেন ভেঙ্গে গুড়িয়ে ফেলবে। ব্যাথায় আমার চোখে পানি এসে যাচ্ছিলো। আমি দাঁতে দাঁত চেপে রইলাম। আমি বুঝতে পারছিলাম সানভীর এই আচরণগুলো ওর ভেতরে চেপে রাখা কষ্ট বা দুঃখ বা অপ্রতিরোধ্য কোনো আবেগিক কারণেই হচ্ছে। যদিও ওর চোখ দুটো তখন হিংস্র শ্বাপদের মত জ্বলছিলো।

প্রথমদিকে ঘাবড়ে যেতাম আমি। আজও প্রায়ই আমার কাছে সানভী দূর্বোধ্য হয়ে ওঠে। সানভী ভাবে ওকে কেউ বোঝে না। কেউ জানে না, চিনতেই পারেনা ওকে। আমি ঠিকই বুঝি, ঠিকই চিনেছি ওকে। হাড়ে হাড়ে চিনেছি। সানভী আমাকে ভুল জানে। সে ভাবে আমার মত বোকা এবং জেদী মেয়ে পৃথিবীতে আর একটা নেই। নিজেকে বেশি চালাক ভাবলে এমনই পরিনতি হয় জীবনে। তবুও আমি সানভীর এই জীবন, এই পরিনতি বা অস্বাভাবিক লাইফস্টাইলের জন্য ওকে একাই দোষী করতে পারিনা। এর জন্য ওর পুরো পরিবারই দায়ী। এ বাড়িতে আসার পর এই বাড়ির মানুষগুলোর এক এক অস্বাভাবিকতা অবাক করেছে আমাকে।

সত্যি বলতে আর দশটা মানুষ আর সানভীর মাঝে যে পার্থক্যটা, ওর কথা বলা, চলা ফেরা ভিন্ন রকম লাইফস্টাইল মুগ্ধ করেছিলো আমাকে। কিন্তু বিয়ের ১ মাসের মাঝেই আমি চিনে গেলাম সানভীর চারপাশে গড়ে তোলা এ মিথ্যে মোহের আবরনটাকে। বিয়ের আগে ওর সাথে পরিচয়ের অল্প দিনে ওকে যতটুকু দেখেছি বা জেনেছি তা মোটেও তার বাস্তবতা নয়। প্রচন্ড বাস্তববাদী সানভী আসলে সেই অলীক জগৎ তৈরী করেছে তার জালে রুই কাতলা ধরবার অভিপ্রায়েই। আমিও সেই জালেই আটকে গেলাম। যদিও আমি কোনো রুই কাতলা নই বা আমার বাবা মা পুরো পরিবারেই কোনো রাঘব বোয়ালও নেই। এখানেই আমার একটু খটকা আছে। এই জালে সানভী আমাকে বাঁধলো কেনো? ভেবে পাইনা আমি। সে যাইহোক সানভীর নিজের স্বার্থে তার এই পাতানো জালে সাজানো জীবনচক্র যে আমি জেনে গেছি সানভীও তা হয়ত বুঝেছে।

প্রথম দেখা, তারপর নাটকীয় স্টাইলে ঘোরের মাঝে স্বপ্ন স্বপ্ন কিছু ক্ষন, ফাইভ স্টারে ডিনার করে দু'জনে যখন ফিরলাম মাঝ রাত্তির করে ওদের বাড়িতে, বাড়িতে পা দিয়েই এক নিমিষে চোখের সামনে থেকে গোলাপী স্বপ্নীল পর্দা খসে পড়লো আমার। দরজা খুলেই শাড়ি আর ঘোমটা মাথায় আমাকে দেখে যেন ভূত দেখলেন আমার শ্বাশুড়ি সানভীর মা। কোনো কথা না বলেই কপাল চাপড়ে ডুকরে উঠলেন তিনি। যেন মহা সর্বনাশ হয়েছে। ভূমিকম্প বা প্লাবনে ভেসে গেছে তার ঘর বাড়ি সর্বস্ব। ওমনই কি সব বলছিলেন উনি।

আমাকে অবাক করে দিয়ে আমার দেখা এবং জানা চিরায়ত বাঙ্গালী পরিবারের সন্তানদের জানা আচরনকে ভেঙ্গে দিয়ে প্রচন্ড ধমকে উঠলো সানভী ওর মাকে। বললো একদম মরা কান্না বন্ধ রাখো। এসব অনেক দেখা আছে। অনেক জানা আছে। ধমক খেয়ে ওর মা সাথে সাথে চুপ হয়ে গেলো কিন্তু আমার মাথাই তখন কাজ করছিলো না। সানভী আমাকে চমক লাগিয়েছে বার বার কিন্তু এই চমকে আমার ব্রেইন স্ট্রোক হবার কথা ছিলো সেদিন। আমি আছন্ন হয়ে পড়লাম কোনো এক অজানা ঘোরে। সানভী আমাকেও ধমক লাগালো। বললো, দাঁড়িয়ে আছো কেনো ভেতরে আসো।

আমি মনে হয় ফ্যাকাশে হয়ে গেছিলাম। ঘোরগ্রস্থা প্রেতিনীর মত ওর রুমে গিয়ে ঢুকলাম। আরও অবাক করা ব্যপারটা যেটা দেখলাম সেটা সানভী তার রুমের দরজা চাবি ঘুরিয়ে খুললো। একটা বাড়ির মধ্যে মানুষ নিজের রুম লক করে রাখে যেখানে বাবা মাই বাস করেন সেখানে এমন অবিশ্বাস্য অবিশ্বস্ততা আমি আগে কখনও দেখিনি। ভেতরে ঢুকে সানভী স্যুইচ অন করতেই মৃদু এবং মিষ্টি সূরের মূর্ছনা ছড়িয়ে পড়লো সারাঘরে। আর অদ্ভূত এক মায়াবী বেগুনী নীল গোলাপী আভার আলোতে ঘর ভাসিয়ে নিলো। আমি এক নিমিশে ভুলে গেলাম একটু আগে ঘটে যাওয়া তার বর্বর আচরণের কথা।

আমার ভাবনায় ছেদ পড়লো। এয়ার হোস্টেস ফুড সার্ভ করতে এসেছে। সানভী ঘুমিয়ে পড়েছে। আচ্ছা ঘুমিয়ে গেলে কি সবাইকেই শিশুর মত দেখায়? একজন দূধর্ষ খুনী কিংবা জঘন্য অপরাধকারীও যখন ঘুমায় সে কি তখন শিশু হয়ে পড়ে? মানুষ ঘুমালে কি সব শোক তাপ দোষ অপরাধের উর্ধে চলে যায়? তারপর চিরতরে যখন ঘুমায় তখন শোক তাপ দুঃখ ভালোবাসার মায়া মমতারও অবসান ঘটে। দীর্ঘশ্বাস পড়ে আমার। যাইহোক, আমার এভাবে হুট করে বিয়ে করে ফেলা নিয়ে আমার নিজের মা বা বাবার কোনোই মাথা ব্যথা নেই। বরং সানভীর এই চাকচিক্য এবং মোহময় জগৎটা দেখে আমার মা বাবা ভাইবোনেরাও ভুলেছে। তারা ভাবছে আমি বড় সুখে আছি। ভালো আছি। তারা নিজেরাও সানভীর মোহ ছড়ানো জগতে ঢুকে পড়েছে। তারা মনে করেন, তারা নিজেরা কখনই সানভীর মত জামাই খুঁজে আনতে পারতো না।

আসলে সানভী আর আমার পরিবারের কিছু মিল আছে। আমাদের পরিবারেও মূলত মায়ের আয়েই সংসার চলেছে। বাবার আয় বড় কম ছিলো। আমরা বোনেরা নিজেদের মত করেই নিজেদের পড়ালেখার খরচ চালিয়েছি বলতে গেলে। আমার এ বছরে গ্রাজুয়েশন শেষ হবার কথা ছিলো। মনে হয় আর হচ্ছে না। তবুও আমি টিউশনি করেছি আমার স্কুল লাইফ থেকেই। এছাড়াও বানিজ্যমেলায় স্টলগুলোতে সেলস গার্ল থেকে শুরু করে এবং যখন যা এসেছে সামনে অতি ক্ষুদ্র হলেও সৎ পথে আয়ের চেষ্টা করেছি। আসলে আমাদের দু'জনের লাইফেই সোনার চামচ মুখে দিয়ে জন্ম হয়নি। দু'জনের লাইফই স্ট্রাংলিং ছিলো। শুধু পার্থক্য এক খানে আমি সততার সাথেই ছিলাম আর সানভী.....

যাক সেসব কথা। এ বাড়িতে আরেক আশ্চর্য্য ও ভয়ানক চরিত্র সানভীর মা। ফরশা টুকটুকে ছিপছিপে সুন্দরী এই মাঝ বয়সী রমনীকে দেখলেই বুঝা যায় এককালে ডাকসাইটে সুন্দরী ছিলেন। কিন্তু এমন অকর্মন্য স্বামী জুটলো কি করে তার কপালে সেও এক রহস্য আমার কাছে। এ কারনেই মনে হয় কথায় বলে অতি বড় সুন্দরী না পায় বর। আর আমি! আমার বেলায় কি খাঁটলো? অতি বড় ঘরনী না পায় ঘর। আমি অতি বড় ঘরনী নই হয়ত তবে হ্যাঁ আমি সংসার চেয়েছিলাম। আমার ধারণা আমি বোধ হয় বড়ই সংসারী মেয়ে। সংসার করতে আমার বড় সাধ জাগে। সুন্দর ছিমছাম একটি পরিবারের বড় সাধ ছিলো আমার। বেশি প্রাচুর্য্যের দরকার নেই। শুধু যেখানে থাকবে শান্তির ছোঁয়া। এমনই একটা জীবন চেয়েছিলাম আমি।

আমার মা বাবাকে আমি কখনও ঝগড়া করতে দেখিনি। দেখিনি কোনো অশান্তি করতেও। আমার মা তার অদৃশ্য ছড়ি দিয়ে পুরো সংসারটাকে তার ছড়ির ডগায় রেখেছিলেন। সেখানে কোনো উচ্চবাচ্য ছিলো না ছিলোনা কোনো ঝুট ঝামেলা। অতি সুনিপুন পরিচালনায় ডাল ভাত বা ছোট মাছের চচ্চড়ি দিয়ে ভাত খেয়েও আমরা মোটামুটি ভালোভাবেই তিন বোন বড় হয়ে উঠেছিলাম। আমার পরিবারে অনেক প্রাচূর্য্য ছিলো না তবে শান্তিও ঠিক ছিলো বলা যায়না। কারণ আমার বাবা মাকে কখনও আমি হাসতে দেখিনি। দু'জনের ভালোবাসা বোধ হয় ফুরিয়ে গিয়েছিলো। ছিলো শুধু সংসার নামক বেড়াজালে আটকে থাকা এক দায়িত্ববোধ।

আমার পরিবার থেকে পাওয়া অমূল্য সম্পদটাই আমার নিজের পাওয়া স্বাধীনতা। আমার মা মনে করতে তার অতি কনজারভেটিভ ফ্যামিলীর কারণে তার স্বাধীনতা খর্ব হয়েছে তাই তার মা বাবার কথায় মেনে নেওয়া এই সংসারের ঘানি টেনে নিয়ে যেতে হলো আজীবন। আর তাই তিনি আমাদেরকে আর কিছু না দিতে পারুক স্বাধীনতা দিয়েছিলেন। নিজের মত করে ভাবতে বুঝতে ও পদক্ষেপ নিতে শেখা। কিন্তু সেই স্বাধীনতাই আমার কাল হলো।

আসলে কপালে না থাকলে ঘি। ঠকঠকালে হবে কি?
দূর্বলেরা এভাবেই নিজেদেরকে হয়ত সান্তনা দিয়ে থাকে। আমিও তাই দিচ্ছি।
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা ডিসেম্বর, ২০২১ রাত ৮:৩০
২৯টি মন্তব্য ২৮টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

মেঘ ভাসে - বৃষ্টি নামে

লিখেছেন লাইলী আরজুমান খানম লায়লা, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৩১

সেই ছোট বেলার কথা। চৈত্রের দাবানলে আমাদের বিরাট পুকুর প্রায় শুকিয়ে যায় যায় অবস্থা। আশেপাশের জমিজমা শুকিয়ে ফেটে চৌচির। গরমে আমাদের শীতল কুয়া হঠাৎই অশীতল হয়ে উঠলো। আম, জাম, কাঁঠাল,... ...বাকিটুকু পড়ুন

= নিরস জীবনের প্রতিচ্ছবি=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৪১



এখন সময় নেই আর ভালোবাসার
ব্যস্ততার ঘাড়ে পা ঝুলিয়ে নিথর বসেছি,
চাইলেও ফেরত আসা যাবে না এখানে
সময় অল্প, গুছাতে হবে জমে যাওয়া কাজ।

বাতাসে সময় কুঁড়িয়েছি মুঠো ভরে
অবসরের বুকে শুয়ে বসে... ...বাকিটুকু পড়ুন

Instrumentation & Control (INC) সাবজেক্ট বাংলাদেশে নেই

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৫৫




শিক্ষা ব্যবস্থার মান যে বাংলাদেশে এক্কেবারেই খারাপ তা বলার কোনো সুযোগ নেই। সারাদিন শিক্ষার মান নিয়ে চেঁচামেচি করলেও বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরাই বিশ্বের অনেক উন্নত দেশে সার্ভিস দিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

জীবনের গল্প

লিখেছেন ঢাকার লোক, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:৩৫

মাত্র মাস দুই আগে আমার এক আত্মীয়ের সাথে দেখা আমার এক বোনের বাড়ি। তার স্ত্রী মারা গেছেন তার সপ্তাহ দুই আগে। মক্কায় উমরাহ করতে গিয়ে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

অভিমান

লিখেছেন জিনাত নাজিয়া, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১০:১২

" অভিমান "

তোমার ঠোঁটে বোল শিখেছি
তুমি আমার মা, কেমন করে
ভুলছ আমায় বলতে
পারিনা। এমন করে চলে
গেলে, ফিরে ও এলেনা। হয়তো
তোমার সুখেই কাটছে দিন,
আমায় ভাবছ না।

আমি এখন সাগর... ...বাকিটুকু পড়ুন

×