মা,
তোমাকে এর আগে কখনও মা বলে ডাকিনি আমি। কখনও ডাকবো বলেও ভাবিনি। জানিনা তুমি আমার ছেলেবেলায় এলে আমি তোমাকে মা বলে ডাকতাম কিনা কিন্তু যখন তুমি এলে আমাদের কাছে তখন আমি আমার ছেলেবেলা বেশ কয়েক বছর আগেই পেরিয়ে এসেছি। এই বয়সটাতে নাকি মানুষ অদ্ভুত সব আচরণ করে। কাউকেই ভালো লাগে না। নিজের মত থাকতে চায়। আমিও আমার মতই থাকতে চেয়েছি এবং এ কারণেই এই কথা আমাকেও বহুবার শুনতে হয়েছে নানা মানুষের কাছে। তোমাকে আমার একেবারেই ভালো লাগলো না। বলতে গেলে সহ্যই হলো না। নতুন করে মা বলে ডাকতে আমার অন্তর সায় দিলো না। আসলে আমি নিজে থেকেই চাইনি হয়ত।
সে যাইহোক, তুমি এবং এ বাড়িতে তোমার আগমন এসবই আমাদের কাছে খুব সহজবোধ্য ছিলো। এই সহজ কাজটাই করে রেখে গিয়েছিলেন আমাদের মা। মা আমাদেরকে পাখিপড়ার মত করেই শিখিয়ে গিয়েছিলেন তোমার সাথে আমরা ঠিক কিভাবে থাকতে পারি। কি ভাবে তোমাকে গ্রহন করবো, কি করে তোমাকে আপন করে নেবো সে সব নিয়ে মায়ের চিন্তার শেষ ছিলোনা শেষের দিনগুলোতে। আমার খুব কষ্ট হত। মা চলে যাবে। নিশ্চিৎ জানা স্বত্তেও মা সে ব্যপারে বড় উদাসীন ছিলেন। তার সকল চিন্তা ঘিরেই ছিলো তার অবর্তমানে আমাদেরকে নিয়ে। সে যখন থাকবে না কেমন থাকবো আমরা? এ ভাবনাটাই তার শেষ দিনগুলোতে তাকে অশান্তি দিয়েছিলো খুব বেশি।
না বাবাকে নিয়ে মায়ের কোনো চিন্তা ছিলো না। ব্যপারটা নিয়ে আমি ভেবেছিও। কিন্তু পরে জেনেছি এবং বুঝেছিও কেনো মায়ের বাবাকে নিয়ে কোনো চিন্তাই ছিলো না। যা চিন্তা ছিলো আমাদেরকে নিয়ে। আমরা কেমন থাকবো? কে আমাদেরকে মায়ের স্নেহে ভালোবাসবে? কে আমাদের পাশে থাকবে? এই নিয়ে বাবার উপরে মনে হয় মা ঠিক ভরসা করতে পারছিলেন না। তাই মা তোমাকেই নির্বাচন করেছিলেন বিশেষ কারণেই এবং বেঁধে দিয়ে গেলেন আমাদের সাথে। তখন না বুঝলেও এখন আমি সবই বুঝি।
কিন্তু জানো? ব্যপারটা আমার একেবারেই পছন্দ হলো না। মা যতই বলুক না কেনো তুমি আমাদের নতুন মা হয়ে আসবে আমি মেনে নিলেও আমার মন মানতে পারেনি অনেকগুলো দিন। তোমার ব্যবহারে আচার আচরনে কাজে কর্মে কোথাও কোনো ত্রুটি ছিলো না তবুও আমার মায়ের জায়গায় অন্য কেউ! এই ব্যপারটা আমাকে কষ্ট দিত বহু বহু দিন। কত কত দিন আমি লুকিয়ে কেঁদেছি আমার ঘরের দরজা বন্ধ করে তোমরা কেউ তা জানোনি।
তুমি আমাদের প্রতিটা ক্ষনের খেয়াল রাখতে। এক অসাধারণ দক্ষতায় তুমি এত কিছু কি করে সামলাতে সেও ভেবেছি আমি। আমাদের এতটুকু সমস্যা যেন না হয় তার প্রতি তোমার আগাম দৃষ্টি ও সতর্কতা দেখে মনে হত যেন তুমি মানুষ নও অন্তর্যামী। তবুও তবুও বাবার পাশে তুমি বা তুমি আর বাবা হেসে কথা বলছো বা বাবার সাথে কোনো অনুষ্ঠানে হেসে হেসে যাচ্ছো এই জিনিসগুলো পীড়া দিত আমাকে। মা মারা যাবার আগে তার সমস্ত ছবি, তার ব্যবহারের জিনিসপত্র তালাবদ্ধ করে রেখে এসেছিলো নানুর বাড়িতে। কোথাও কোনো স্মৃতি রেখে যেতে চাননি মা।
কেনো জানো? আমি জানি সেসব শুধুই তোমার জন্য। হ্যাঁ তোমার জন্যই মা এমনটা করেছিলেন। এই ব্যপারটাও কষ্ট দিত আমাকে। ক্রোধ জন্মাতো তোমার উপরে। প্রতিহিংসায় জ্বলতাম আমি। এমনকি তোমার মৃত্যু পর্যন্ত কামনা করতে দ্বিধা হয়নি আমার। অনেক আত্মীয় স্বজনকেই বলতে শুনেছি আহারে কি নিয়তি! বাচ্চাগুলো মা হারা হলো। মনে হত তোমার কারনেই মাকে চলে যেতে হলো এই পৃথিবী ছেড়ে বড় অসময়ে। অথচ তোমার তো কোনো দোষ ছিলো না। তবুও আমার ভেতরের চেপে রাখা অপ্রকাশিত ক্রোধে ভেতরে ভেতরে ফুসতাম আমি।
তুমি এ বাড়িতে আসার কয়েকদিন পরে অদ্ভুৎ এক বাদ্যযন্ত্রের শব্দে খুব ভোরে ঘুম ভেঙ্গেছিলো আমার। সারারাত ঘুমাইনি সেদিন। মাত্র ঘুমাতেই সেই করুণ সূরের মূর্ছনায় ঘুম ভেঙ্গেছিলো আমার। প্রথমে ঘাবড়ে গিয়েছিলাম। তারপরই মেজাজ খারাপ হলো। কোথা থেকে আসছে সেই সূর! ভারী পর্দার ফাক গলে আসছিলো ভোরের অস্ফুট আলো। প্রায় অন্ধকার তখন। গেস্টরুমের পরে আমাদের অব্যবহৃত রুমটা থেকে আসছিলো সেই সূর। আমি চুপিসারে উঠে গিয়ে দেখলাম তুমি চোখ বন্ধ করে তোমার ভায়োলিনটা নিয়ে সূর তুলে চলেছো। মেজাজ বিগড়ে গেলো আমার। নাহ ঘুম ভাঙ্গার জন্য না তোমার সামনে বসে ছিলো বাবা। বাবার সেই মুগ্ধ নেত্র যা তোমার পানে চেয়েছিলো সহ্য করতে পারিনি আমি। চুপচাপ সেখান থেকে চলে আসলেও আমি ব্যপারটা ভুলতে পারিনি। পরদিন সকালে তোমার মন খুব খারাপ ছিলো কারণ তোমার বেহালার তারগুলি ছিন্নভিন্ন পেয়েছিলে তুমি। তুমি খুব কষ্ট পেয়েছিলে। অবাক হয়েছিলে তার থেকেও বেশি হয়ত। কিন্তু কাউকে কিছুই বলোনি। কেনো বলোনি? সে এক প্রশ্ন আমার কাছে। উত্তরটা হয়ত আমি জানি। তুমিও জানো মা। আমি সেই কাজটার জন্য আজ বড় অনুতপ্ত।
আমার সকল ক্রোধ পানি হয়ে গেলো গত বছর যখন সচ্ছ এর ডেঙ্গু জ্বর হলো। সারাটা রাত ওর শিওরে তোমার নিদ্রাহীন রাত জাগার সাক্ষী ছিলাম আমি। এক মুহুর্তও চোখের পাতা এক না করে তুমি তার সেবা করে গেছো। আমার কি মনে হয় জানো? তুমি না থাকলে ওকে বাঁচানোই যেত না। আমি বুঝলাম মা সঠিক মানুষটাকেই নির্বাচন করে বসিয়ে দিয়ে গেছেন আমাদের মাথার উপরে। সচ্ছকে ঐ অপরিসীম ভালোবাসা যত্ন ও সেবায় সুস্থ্য করে তোলার জন্য সেদিন থেকেই কৃতজ্ঞ হয়ে পড়েছিলাম তোমার কাছে। সচ্ছ খুব জেদ করতো কিন্তু তুমি তাকে ভুলিয়ে দিতে এক আশ্চর্য্য মায়াজালে। তোমার যাদুকাঁঠির ছোঁয়ায় সচ্ছ ধীরে ধীরে সন্মোহিত হয়ে পড়লো। আগের মত জেদ অবাধ্যতা সবই কমে গেলো ওর।
তবুও কি এক সংকোচে আমি তোমার থেকে দূরেই রয়ে গেলাম। তুমি এবং মায়ের মাঝে অনেক প্রভেদ তবুও তুমি সকল প্রভেদ ঘুচিয়ে এ বাড়ির সকল আধিপত্য দখলে নিয়ে নিলে। মায়া মমতা ও এক অনাবিল আনন্দে হেসে উঠলো আমাদের ম্রীয়মান বাড়ি ঘর। সচ্ছ খুব দ্রুতই তোমার নেওটা হয়ে উঠলো। সচ্ছের সাথে কম্পুিউটার গেইমস থেকে শুরু করে ওর স্কুটিতে উঠতে গিয়ে তোমার দড়াম করে পড়ে যাবার দৃশ্য দেখে আমিও হেসে ফেলেছিলাম। আমি মাঝে মাঝে কি ভাবি জানো? এত আনন্দ তুমি কোথা হতে পাও?
আমাদের মা নেই। চলে গেছে ঐ দূরের দেশে। ঐ তারাদের মিছিলে। একদিন সচ্ছ তোমাকে জিগাসা করেছিলো তোমার মায়ের কথা। তুমি বলেছিলে তোমার মা আছেন তোমার বুকের মধ্যে, তোমার চোখের তারায় কিন্তু তুমি তাকে দেখতে পাও না। তোমার চির হাসিখুশি উজ্বল মুখ তখন কি রকম ম্লান হয়ে গিয়েছিলো। আমি জানি কোনো এক অজানা দুঃখ বুকে নিয়ে তুমি চলো। কিন্ত আমাদেরকে তা বুঝতে দাওনি। জানতে দাওনি কখনও।
কখনও তোমাকে এত কিছু লিখবো ভাবিনি। এই কিছুদিন হলো তোমাদেরকে ছেড়ে থাকতে শুরু করেছি। আমার পড়ালেখার জন্য আমাকে চলে আসতে হলো তোমাদেরকে ছেড়ে। আমার জীবনের এই নতুন পথ চলায় তোমার অবদানও কম কিছু নয়। তবুও প্রথমে খুশিই ছিলাম আমি। যে বাড়িতে মা নেই সে বাড়িতে না থাকাই ভালো মনে করেছিলামও। শুধু সচ্ছের জন্য মন খারাপ হবে এমনটাই ভেবেছিলাম আমি। কিন্তু অবাক হলাম তোমরা যখন চলে যাচ্ছিলে আমাকে এখানে রেখে । তুমি যখন হাত নেড়ে বিদায় নিলে। আমার বুকের ভেতরটা শূন্য হয়ে গেলো! অবাক হয়ে খেয়াল করলাম আর কারো জন্য নয় শুধু তোমার জন্য সেদিন আমার মন কেঁদে উঠলো। এমনটা হবে বা হতে পারে তার এক মুহুর্ত আগেও বুঝিনি আমি। ঠিক এর পর পরই বুঝলাম তুমি এই কয়েক বছরে আমাদের হৃদয়ে জায়গা করে নিয়েছো কতখানি। আমার হৃদয় চিরে বের হয়ে আসছিলো একটি ডাকই- মা। কিন্তু সে ডাক তোমার কানে পৌছুলোনা। তুমি তখন দূরে।
ঠিক তুমি যা শিখিয়ে দিয়েছো তেমনই ভাবেই আমি চলছি ফিরছি। তোমার সাজিয়ে দেওয়া কাপড়, শুকনো খাবার সবখানেই মিশে আছো তুমি। তোমার শেখানো উপায়ে সেদিন খিঁচুড়িও রেঁধেছি আমি। সেদিন বুঝেছিলাম তুমি না থাকলে সচ্ছ বাঁচতো না আজ বুঝেছি তুমি না থাকলে আমিও হয়ত ........
যাইহোক ভালো থেকো মা। তোমাকে ভালোবাসি। তোমাকে আসলেও না ভালোবেসে হয়ত কেউ পারে না। সচ্ছ তোমাকে ভালোবাসে, মা তোমাকে ভালোবেসেছিলো আজ আমি ভালোবাসছি। আর তুমি যে বাবার প্রথম ভালোবাসা তা জানতে আমার আর বাকী নেই আজ।
সে যাইহোক আমাদের সবার ভালোবাসায় ভালো থেকো তুমি মা। অনেক ভালো থেকো।
রুদ্র
এই চিঠি কোনো ডাকবাক্সে আসেনি। এই চিঠি কোনো লাল নীল বা হলুদ সবুজ খামেও আসেনি। এ চিঠি এসেছে মেইলে। অনলাইন মেইলে। চিঠিটা খুলে নির্বাক নিশ্চুপ বসে আছে কঙ্কাবতী। দু'গাল বেয়ে নিজের অজ্ঞাতে গড়িয়ে পড়ছে অশ্রুজল। এই অশ্রুজলে মিশে আছে তার নিজের অতীত, ছেলেবেলার দুঃখ কষ্ট লাঞ্ছনা ও গঞ্জনার ইতিহাস। এই অশ্রুজলে মিশে আছে এই জীবনে হারিয়ে ফেলা প্রিয় মানুষগুলোর বেদনা। এই অশ্রুজলে মিশে আছে তার সকল ভালোবাসা ও প্রাপ্তি এবং অর্জিত সফলতা এবং একটি কৈশোর পেরুনো অবুঝ হৃদয় জয় করে নেবার আনন্দ বারতা...
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে জুলাই, ২০২২ রাত ৮:৩২