somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

মৃত্যুও জহিরুল আহসান টিপুকে পৃথক করতে পারেনি

২৫ শে এপ্রিল, ২০১০ রাত ৮:৪৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



(সংবাদপত্র জগতে অত্যন্ত প্রিয় মুখ ছিলেন জহিরুল আহসান ওরফে টিপু ভাই। তার মৃত্যুতে দেখলাম ব্লগে একটিও পোস্ট নেই। এ প্রসঙ্গে খুব হৃদয়স্পর্শী একটা লেখা লিখেছেন মনজুরুল হক ভাই । ব্লগে অনুপস্থিত তিনি, তার অনুমতি না নিয়েই লেখাটা পোস্ট করে দিলাম)

এক বৃদ্ধ তার দ্বিতীয় সন্তানটিকেও যখন কবরে নামিয়ে দিলেন তখনো তাকে স্বাভাবিক দেখাচ্ছিল। এর আগে তিনি তার প্রথম সন্তানকেও একইভাবে কবরে নামিয়ে দিয়েছেন। কেউ একজন তার মনের অবস্থা জানতে চাইলে তিনি বলেছিলেন যে মারা যায় সে যদি জানতো তার জন্য আমরা কী পরিমাণ কষ্ট পাবো, তাহলে বোধহয় সে যে করেই হোক বেঁচে থাকতে চাইতো। এটা অনেক দিন আগের কথা। আজ এ কথা মনে পড়লো, কারণ আমাকেও সেই বৃদ্ধের মতো বলতে হচ্ছে আমাকে এভাবে তার মৃত্যুগাথা লিখতে হবে জানলে এই কষ্ট থেকে বাঁচাতে যে করেই হোক বেঁচে থাকতেন টিপু।

জহিরুল আহসান টিপু। আমার বন্ধু। আমার সহকর্মী। আমাদের সবার প্রাণপ্রিয় টিপু ভাই। আজ (২৪ এপ্রিল) তার কম্পিউটার ডেস্কে বসে তার ব্যবহৃত টেবিল, কম্পিউটারের সামনে বসে তারই মৃত্যু নিয়ে শোকগাথা লিখতে হচ্ছে। এই টেবিলে যে মাত্র ১৪ ঘণ্টা আগে বসে কাজ করে গেছেন। ২৪ তারিখের ভোরের কাগজ সংখ্যাটির ডামি, মেকআপ, পেস্টিং দেখে ভোরের কাগজের প্রাক্তন সম্পাদক বেনজির ভাই আর অন্য সহকর্মীদের সঙ্গে প্রাণখোলা আড্ডা দিয়ে শেষবারের মতো বাড়ি ফিরেছিলেন। সেখান থেকে আর মাত্র ঘণ্টাখানেকের ভেতর আর এক চিরস্থায়ী বাড়ির উদ্দেশে যাত্রা করলেন। আমরা এমনই এক মাধ্যমের শ্রমিক যাদেরকে প্রিয়জনের লাশ দাফন করে এসেই শোকগাথা লিখতে হয়। তেমনই এক হৃদয় মোচড়ানো খালি হয়ে যাওয়া বুকের ভেতর পাথর চাপা দিয়ে তোমাকে নিয়ে লিখছি বন্ধু আমার।

গত শুক্রবার ছিল তার ডে-অফ। ছুটি কাটাবেন সেটাই নির্ধারিত ছিল। কিন্তু এর আগের সপ্তাহে তার মায়ের অসুস্থতার কারণে অফিসে না আসায় আমি ছুটি নিতে পারিনি। তাই এদিন নিজেই বললেন- শুক্রবার ছুটি হলেও আজ আমি কাজ করি, আপনি ছুটি নিন, একটু ঘুমান। আপনি তো একেবারেই ঘুমান না! সম্ভবত শেষবার সবার সঙ্গে দেখা করার জন্যই এই দিনটিকে টিপু বেছে নিয়েছিলেন। নতুন একটা শার্ট পরে এসেছিলেন। কাজের ফাঁকে খাবার আনিয়ে সবাইকে নিয়ে খেয়েছিলেন। তারপর চলে গেলেন আর না আসার জন্য। অথচ কয়েকদিন আগে তিনি তার কালো রঙের কলমটি খুঁজে না পেয়ে জিজ্ঞেস করলেন- আপনি নিয়েছেন? আমি কিছুই বলিনি। ওই কলমটা ছিল তার রেজিগনেশন লেটারে সই করার কলম!

ভোরের কাগজ থেকে যেবার আমাদের সময়-এ গেলেন সেবার এই কলম দিয়েই সই করেছিলেন। আবার ভোরের কাগজে ফিরেছেন। তারপর এক সময় ডেসটিনিতে যোগ দেয়ার সময়ও সেই কলমটি দিয়ে সই করেছিলেন। আবারো যেন সেই ‘কুখ্যাত’ কালো কলমটি দিয়ে তিনি অব্যাহতি না নিতে পারেন সে জন্যই কলমটি আমি সরিয়ে রেখেছিলাম! সেই কলমটি যেন ভ্র“কুটি করছে! অব্যাহতি তিনি নিলেন, তবে ভোরের কাগজ থেকে নয় তার চেনা পৃথিবী থেকেই। কী এমন অভিমান ছিল যে এভাবে যাপিত জীবনের অর্ধেকটা না পেরুতেই তাকে চলে যেতে হবে? কতোই বা বয়স হয়েছিল? মোটে তো ৪৭! এই বয়সটা কি চলে যাওয়ার বয়স? নাকি বহমান জীবনে ফুলস্টপ বসিয়ে দেয়ার বয়স? না, এর কোনোটাই না। তবুও তাকে টুপ করে ডুবে যেতে হলো। উদিত হয়ে মধ্যগগনে আলো ছড়ানোর আগেই অস্ত যেতে হলো। নিভিয়ে দিতে হলো একটি দ্রোহী ছাত্র সংগঠনের মশাল। ব্রেক করে থামিয়ে দিতে হলো একটি নতুন আলোঝলমল সংসারের শকট। মুছে দিতে হলো একটি দিগন্ত বি¯তৃত ক্যানভাসের আঁকিবুঁকি। এখন কেবলই শূন্যতা। চারধারে কেবলই বিদায়ের করুণ সাইরেন।

টিপু যখন ছাত্র, তখনই তার সঙ্গে আমার অল্প-বিস্তর পরিচয়। টিএসসিতে নতুন জন্ম নেয়া ছাত্র সংগঠন ‘ছাত্র ঐক্য ফোরাম’ এর সঙ্গে জড়িত ছিল। এরশাদবিরোধী আন্দোলনের সময়টাতে আমরা একে অপরকে চিনতাম। তারপর ভোরের কাগজে কর্মজীবনের শুরু। টানা সংবাদপত্রের কর্মী হিসেবে বেঁচেছেন, বাঁচিয়েছেন, হেসেছেন, ঘুমিয়েছেন এবং শেষ পর্যন্ত ভোরের কাগজ-এর বার্তা সম্পাদক হিসেবেই বিদায় নিয়েছেন। কী হয়েছিল টিপুর? আমরা জানতাম মাস দুয়েক আগে হঠাৎ করেই মাথাঘুরে পড়ে গিয়েছিলেন ভোরের কাগজ অফিসেই। তারপর হাসপাতাল। সেখানে জানা গিয়েছিল তার হার্টের সমস্যার পাশাপাশি আরো এক মারাত্মক ঘুণপোকা তার মাথায় জেঁকে বসেছে। মাথায় থাকা সেই ঘুণপোকার কথা সকলে জানতেন না। কেবল জানতেন আমাদের সম্পাদক শ্যামল দত্ত। তিনি আরো দুয়েকজনকে বলা ছাড়াও বাড়িতে তার ভাইকেও বলেছিলেন। না, তার চিকিৎসা হয়নি। দেশের বাইরে নিয়ে তার মাথায় অস্ত্রোপচারের সুযোগ মেলেনি। দিব্যি ভালো মানুষ অফিসে যাচ্ছেন-আসছেন দেখে কেউ তেমন একটা গা করেনি। কিন্তু রাতে নাইট শিফটে তাকে কাজ করতে দেয়া হতো না। আগে আগেই চলে যেতেন। বেশ কিছুদিন যাবৎ তার মা অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে আছেন। সে কারণে আগের সপ্তায় দুদিন অফিসে আসতে পারেননি। আমার ডে-অফ বাতিল করে কাজ করেছিলাম বলে বৃহস্পতিবারে আমায় বললেন- এই শুক্রবার আমি ডে-অফ নেবো না, আপনি ছুটিটা নেন। এমনই ছিলেন টিপু। মানুষের প্রতি কী অমোঘ ভালোবাসা আর শ্রদ্ধা থাকলেই এমন মানুষ হওয়া যায়। শত কষ্ট, শত দুশ্চিন্তা, কাজের চাপ যে মানুষটি হাসিমুখেই নিতেন, তার তো কোনো শত্র“ থাকার কথা নয়। নেইও। এই প্রিন্ট মিডিয়ায় সম্ভবত এমন একটি মানুষও নেই যার সামান্যতম রাগ, ক্ষোভ বা কষ্ট থাকতে পারে টিপুকে নিয়ে।

সাধারণ আর দশজন আটপৌরে বাঙালির মতোই ছিল টিপুর যাপিত জীবন। কোনো উচ্চাভিলাশ ছিল না। দেশে এখন ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার আনন্দ-উদ্বেল মুখচ্ছবি। সেখানে নানা রঙের বাহার। সেখানে গিয়ে জীবনকে আরো খানিকটা রাঙানোরও কোনো উদ্যোগ ছিল না তার। এই অতি সাধারণ নিরাসক্ত নির্লোভ মানুষটি ‘ফুলস্টপ’ হয়ে আমাদের তো কাঁদিয়েছেনই, আরো বেশি করে কাঁদিয়েছেন তার ছেলেমেয়েকে। তিন বছরের অবুঝ ছেলেটি জানে না তার বাপি রাত সাড়ে এগারটার দিকে আর ঘরে ফিরবে না। অসুস্থ মা আরো অনেকদিন একা একা কাঁদবেন। মৃত্যুর খুব কাছাকাছি থেকেও তিনি দেখলেন তার তরতাজা ছেলেটি কী এক অব্যক্ত অভিমানে চলে গেলো।

এর পরের দৃশ্যগুলো খুবই নিয়মমাফিক। প্রায় রুটিন ওয়ার্কের মতো। তার জন্য আমরা শোক পালন করবো। তাকে প্রেসক্লাবে নিয়ে দ্বিতীয় দফা জানাজা পড়ানো হলো। প্রথম দফা তার কর্মস্থলে পড়ানো হয়েছিল। এরপর শোকগাথা লেখা হবে। কাগজের একটি অংশ শোকে শূন্য থাকবে। তার সকল সহকর্মী পরের দিনের সংখ্যাটি বের করা নিয়ে ভীষণ ব্যস্ত হয়ে পড়বেন। কোনো এক মুহূর্তে হয়তো কারো চোখের সামনে ভেসে উঠবে ছিপছিপে একহারা গড়নের সদাহাস্যোজ্জ্বল জহিরুল আহসান টিপু নেই। শ্যামল দা হয়তো দশটার দিকে অবচেতনে তাড়া লাগাবেন- টিপু সাড়ে দশটার মধ্যে পাতা ছাড়-ন! পরে দেখবেন পাতা ছাড়া হচ্ছে, কিন্তু টিপু নয় আর কেউ, অন্য কেউ। এ আর এক কষ্ট। এ কষ্টের কোনো উপমা দেয়া যায় না। ডেস্কের সবাই হয়তো মনের ভুলে আরো কিছুদিন টিপুর টেবিলের পাশে এসে ডেকে বসবেন। মেকআপে বসে কিবরিয়া হয়তো মনে করবেন টিপু ভাই পাশেই বসে আছেন। হয়তো বলেই বসবেন- ক্যাপশন দেন টিপু ভাই!

না, আমার কোনো ক্যাপশন মনে পড়ছে না। সাধারণত মৃত ব্যক্তির ছবির নিচে লেখাগুলো প্রথামাফিকই হতে হয়। আজ এই লেখায় কোনো প্রথাই মানতে মন চাইছে না। এ লেখাটির ক্যাপশন তাই প্রথার বাইরে গিয়ে লিখছি- ‘মৃত্যুও জহিরুল আহসান টিপুকে বন্ধু-সহকর্মী থেকে পৃথক করতে পারেনি’।
৭টি মন্তব্য ৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

খুন হয়ে বসে আছি সেই কবে

লিখেছেন জিএম হারুন -অর -রশিদ, ০৭ ই মে, ২০২৪ রাত ২:৩১


আশেপাশের কেউই টের পাইনি
খুন হয়ে বসে আছি সেই কবে ।

প্রথমবার যখন খুন হলাম
সেই কি কষ্ট!
সেই কষ্ট একবারের জন্যও ভুলতে পারিনি এখনো।

ছয় বছর বয়সে মহল্লায় চড়ুইভাতি খেলতে গিয়ে প্রায় দ্বিগুন... ...বাকিটুকু পড়ুন

জাম গাছ (জামুন কা পেড়)

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ০৭ ই মে, ২০২৪ সকাল ৯:০৩

মূল: কৃষণ চন্দর
অনুবাদ: কাজী সায়েমুজ্জামান

গত রাতে ভয়াবহ ঝড় হয়েছে। সেই ঝড়ে সচিবালয়ের লনে একটি জাম গাছ পড়ে গেছে। সকালে মালী দেখলো এক লোক গাছের নিচে চাপা পড়ে আছে।

... ...বাকিটুকু পড়ুন

অনির্বাণ শিখা

লিখেছেন নীলসাধু, ০৭ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:৩১



রাত ন’টার মত বাজে। আমি কি যেন লিখছি হঠাৎ আমার মেজো মেয়ে ছুটতে ছুটতে এসে বলল, বাবা একজন খুব বিখ্যাত মানুষ তোমাকে টেলিফোন করেছেন।

আমি দেখলাম আমার মেয়ের মুখ উত্তেজনায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

=ইয়াম্মি খুব টেস্ট=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ০৭ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৪:১৪



©কাজী ফাতেমা ছবি
সবুজ আমের কুচি কুচি
কাঁচা লংকা সাথে
ঝালে ঝুলে, সাথে চিনি
কচলে নরম হাতে....

মিষ্টি ঝালের সংমিশ্রনে
ভর্তা কি কয় তারে!
খেলে পরে একবার, খেতে
ইচ্ছে বারে বারে।

ভর্তার আস্বাদ লাগলো জিভে
ইয়াম্মি খুব টেস্ট
গ্রীষ্মের... ...বাকিটুকু পড়ুন

এশিয়ান র‍্যাংকিং এ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান !!

লিখেছেন ঢাবিয়ান, ০৭ ই মে, ২০২৪ রাত ৮:২০

যুক্তরাজ্যভিত্তিক শিক্ষা সাময়িকী 'টাইমস হায়ার এডুকেশন' ২০২৪ সালে এশিয়ার সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকা প্রকাশ করেছে। এশিয়ার সেরা ৩০০ তালিকায় নেই দেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়।তালিকায় ভারতের ৪০, পাকিস্তানের ১২টি, মালয়েশিয়ার ১১টি বিশ্ববিদ্যালয়... ...বাকিটুকু পড়ুন

×