সংঘাতময় জীবনে নিতান্ত রুটির খোঁজে বেসামাল অবস্থায় থাকায় নিতে পারেননি কোন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা। শৈশবে ছুটা চাকর থেকে শুরু করে ফিল্মমেকার হওয়ার পথে কর্মক্ষেত্র বদলেছেন ১৩ বার । গুপ্ত রাজনীতি করে জেল খেটেছেন কৈশোর থেকে তারুণ্যে। তারপর বদলে ফেলেছেন পুরো জীবনদর্শন। তিনি ইরানের কিংবদন্তী চলচ্চিত্র নির্মাতা মোহসেন মাখমালবাফ।
মোহসেনের জন্ম ১৯৫৭ সালের ২৯ মে, তেহরানে। বিয়ের মাত্র ছয়দিনের মাথায় মোহসেনের বাবা-মার ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। দারিদ্র কৈশোরেই তাকে দিয়েছিলো বিপ্লবের ডাক। চেয়েছিলেন ঘুণে ধরা সমাজটাকে বদলে দেবেন। কিংবদন্তী আর্জেন্টাইন বিপ্লবী চে গুয়েভারার আদর্শকে পুঁজি করে যোগ দিয়েছিলেন সশস্ত্র রাজনীতিতে। তারই অংশ হিসেবে মাত্র ১৭ বছর বয়সে অস্ত্র লুট করতে পুলিশকে ছুরি মেরে বসেন। ফলাফল হিসেবে ৫ বছরের জন্য নিক্ষেপিত হন কারাগারে। এ ঘটনাটাই পরে তাকে উজ্জীবিত করেছিলো ‘এ মোমেন্ট অব ইননোসেন্স’ (১৯৯৬) চলচ্চিত্রটি নির্মাণে।
কারাগারের জীবনই তার আদর্শকে আমূলে পাল্টে দেয়। স্বশিক্ষিত মোহসেন কারাগারে বসেই প্রচুর বই পড়ে ফেলেন। আর তখনই তিনি রাজনৈতিক বিপ্লবের সীমাবদ্ধতা উপলব্ধি করতে পারেন। চে গুয়েভারার প্রতি শ্রদ্ধা সমান রেখেই মহাত্মা গান্ধীকে বানালেন নিজ জীবনের নতুন আদর্শ। তাই কারাবাস শেষে বেছে নেন সাংস্কৃতিক আন্দোলনের পথ। লেখালেখি দিয়ে তার বিপ্লবের শুরু। তারপর ফিল্ম বানানো।
মাখমালবাফ নির্মিত টাইম অফ লাভ (১৯৯০), দি নাইটস অফ জায়ান্দে-রুড (১৯৯১) সহ একাধিক ছবি বিভিন্ন মেয়াদে ইরান সরকার নিষিদ্ধ করেন। সেন্সরবোর্ডের রোষানল থেকে নিজের ফিল্মকে বাঁচানোর জন্য প্রাণপ্রিয় মাতৃভূমি ছেড়েছেন। ফিল্ম বানাতে চষে বেড়িয়েছেন পৃথিবীর বহু দেশের অলিগলি আর রাজপথ। কিন্তু কোন শক্তিই তার বিপ্লবকে দমন করতে পারেনি। ছোটবেলা থেকেই লড়াকু মেজাজের মোহসেনকে পরাভূত করা যায়নি কিছুতেই।
মোহসেন মাখমালবাফের মতে হলিউড আর বলিউড হলো জানালার মত। অলস সময়ে যে জানালায় উঁকি দিয়ে মানুষ হয়তো অনত্র আনন্দ খুঁজছে আর তা দিয়ে কতিপয় ব্যক্তি অন্যত্র ব্যবসা করছে। মাখমালবাফ চলচ্চিত্র নির্মাণকে সবসময় আয়না মনে করেছেন জানালা নয়।
মোহসেন চলচ্চিত্রে তার অবদানের জন্য পেয়েছেন ইউক্রেন প্রেসিডেন্টের সাইদিয়ান ডিয়ার (২০০৭), ইউনেস্কোর ফ্রেডেরিকো ফেলেনি গোল্ড মেডেল (২০০১) সহ অনেক পুরস্কার। বিখ্যাত টাইম ম্যাগাজিনের বিবেচনায় সর্বকালের সেরা ১০০টি ফিল্মের মধ্যে জায়গা করে নিয়েছে মোহসেন মাখমালবাফ নির্মিত ‘কান্দাহার’। এছাড়া তার নির্মিত উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্রগুলো হলো : বয়কট (১৯৮৫), দি স্ট্রিট ভেনডর (১৯৮৬), দি সাইক্লিস্ট (১৯৮৭), দি পেডলার (১৯৮৭), দি ম্যারিজ অব দ্য ব্লেসড (১৯৮৮), টাইম অফ লাভ (১৯৯০), দি নাইটস অফ জায়ান্দে-রুড (১৯৯১), ওয়ানস আপন এ টাইম সিনেমা (১৯৯২), দ্য অ্যাক্টর (১৯৯৩), সালাম সিনেমা (১৯৯৫), গাবেহ (১৯৯৬), সাইলেন্স (১৯৯৭) সেক্স এন্ড ফিলোসফি (২০০৫), স্ক্রিম অব দ্য এন্টস (২০০৬)।
‘ফিল্মমেকার উইদাউট বর্ডার’ এর স্বপ্নদ্রষ্টা মোহসেন মাখমালবাফ নিজের তৈরি ফিল্ম স্কুলে তরুণ নির্মাতাদের দিচ্ছেন ফিল্মের দীক্ষা। তার স্ত্রী ও তিন সন্তানের প্রত্যেকেই নির্মাতা হিসেবে বিশ্ব চলচ্চিত্রাঙ্গনে নিজেদের নাম সমৃদ্ধ করেছেন। আর দুই মেয়ে সামিরা মাখমালবাফ আর হানা মাখমালবাফা তো নাম লিখিয়ে ফেলেছেন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন চলচ্চিত্র নির্মাতাদের তালিকায়।#
(তথ্যসূত্র: আইএমডিবি, উইকিপিডিয়া ও অন্যান্য ওয়েবসাইট, ফিল্মমেকারের ভাষা এবং দেশী ও বিদেশী বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা)
(২৬ মে ২০১১ দৈনিক সমকালে প্রকাশিত)
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে সেপ্টেম্বর, ২০১২ রাত ১২:৫৯