প্রায় ১০২ বছর আগে আজকের দিনে (১৯২১ সালের ২০ জুন) নজরুলের সঙ্গে বিয়ে হয়েছিলো নার্গিসের। কিন্তু বিয়ের রাত শেষ না হতেই তীব্র অভিমানে নার্গিসকে ছেড়ে চলে যান ভবঘুরে নজরুল। বলেছিলেন পরের শাওন মাসে ফিরবেন। কিন্তু কত শাওন এলো-গেল, কবি আর এলেন না। তারপর ১৬টি বছর পর নজরুলকে একটি চিঠি লিখেন নার্গিস। প্রত্যুত্তরে নার্গিসকে একটি গান লিখে পাঠান নজরুল। তাতে লেখা-
যারে হাত দিয়ে মালা গেঁথে দিতে পারো নাই কেনো মনে রাখো তারে
ভুলে যাও মোরে, ভুলে যাও মোরে একেবারে...
১৯২১ সালে কলকাতা থেকে পুস্তক ব্যবসায়ী আলী আকবার খানের সঙ্গে কবি নজরুল চলে আসেন কুমিল্লার দৌলতপুর খান বাড়িতে। একদিন খান বাড়ির পুকুর ধারে বসে আপন মনে বাঁশি বাজাছিলেন নজরুল। কৃষ্ণের বাঁশির টানে যেমন রাধা পাগল হয়েছিলেন, নজরুলের বাঁশির সুরে মোহিত হয়েছিলো খান বাড়ির কিশোরী সৈয়দার চপল মন। বাঁশির সুরেই ষোড়শীর বুকে জাগে নবযৌবনের দোলা। বুকে সঞ্চারিত হয় প্রেমের স্পন্দন, নজরুলের প্রতি আকৃষ্ট হলেন সৈয়দা। পরদিন কবিকে সুধালেন- “গত রাত্রে আপনি কি বাঁশি বাজিয়েছিলেন? আমি শুনেছি।”
কিশোরী সৈয়দার গ্রাম্য সারল্যে প্রেমে পড়ে যান নজরুল। প্রথম যৌবনের উন্মত্ত আবেগে শুরু হয় দু’জনার প্রণয়। প্রথম যৌবনের টগবগে কবি-হৃদয়ে এই প্রেম যেন এক নতুন জোয়ার। আশৈশব ভবঘুরে জীবনের পর হঠাৎ একটা শান্তির নীড়ের দেখা পাওয়া। ষোড়শী সৈয়দার প্রেমে ছিন্নমূল এক কবি মায়ার জালে আটকা পড়লেন। কবিতাও ফুটে ওঠে সে স্বীকারোক্তি-
কেন আমার ঘরের দ্বারে এসেই আমার পানে চেয়ে এমন থমকে দাঁড়ালি?
এমন চমকে আমায় চমক লাগালি?
এই কি রে তোর চেনা গৃহ, এই কি রে তোর চাওয়া স্নেহ হায়!
তাই কি আমার দুঃখের কুটির হাসির গানের রঙে রাঙালি?
ভালোবেসে তিনি কিশোরী সৈয়দা খাতুনের নাম দেন নার্গিস, ফার্সি ভাষায় যার অর্থ গুল্ম। শুধু-ই কি তা-ই। জীবনের প্রথম প্রেমে মশগুল হয়ে নার্গিসকে ‘মানস-বধূ’ ভেবে ফেলেছিলেন। এভাবেই নজরুলের প্রণয় কাননে ফোটে নার্গিসের ফুল। কবির ভেতরের সমস্ত সত্ত্বা জুড়ে বিরাজ করছিলো এক ষোড়শী। তাই নার্গিসকে উৎসর্গ করে লিখলেন একের পর এক কবিতা। সেসব কবিতায় প্রথম প্রেমে তরুণ কবির হৃদয়ের সমস্ত আবেগ যেন ঝরে পড়ে। কবি লিখেছিলেন-
সে যেন কোন্ দূরের মেয়ে আমার কবিমানস-বধূ;
বুকপোরা আর মুখভার তার পিছলে পড়ে ব্যথার মধু।
আহা!
তাদের প্রণয় পরিণয়ে গড়ায়। কিন্তু বিপত্তি বাঁধে ঘর জামাই হওয়ার শর্ত নিয়ে। সারাজীবন যে নজরুল ভবঘুরে, তাকে কি আর আটকে রাখা যায়! নার্গিসের পরিবারের এমন শর্তারোপে কবি নজরুলের মনে হয়, এ যে প্রতারণা! স্বভাবতই এমন শর্তে থাকতে ভবঘুরে নজরুলের রাজী হওয়ার কথা না। চেয়েছিলেন নার্গিসকে নিয়েই চলে যাবেন কলকাতায়। কিন্তু চাল-চুলোহীন অখ্যাত কবির সঙ্গে অনিশ্চিত অজানার উদ্দেশ্যে পাড়ি দিতে সাহস পাননি কিশোরী-বধূ নার্গিস। ফলতঃ দুখু মিয়ার অনিশ্চিত জীবনের নিশ্চিত দুঃখবোধকে বরণ করতে পারেননি নার্গিস।
নার্গিসের এমন উন্মাসিকতায় তীব্র আঘাত পান নজরুল। প্রেয়সী থেকে সদ্য সঙ্গিনী হয়ে ওঠা নার্গিসের কাছ থেকে আকুণ্ঠ সমর্থন পাবেন আশা করেছিলেন। কিন্তু হায়! পেলেন কই? একদিকে ঘর জামাই হওয়ার শর্তে অপমানের বোধ, অন্যদিকে কবির ওপর বিশ্বাস আনতে নববধূর সংশয়। তাই বিয়ের রাতেই তীব্র অভিমানে প্রাণপ্রিয়াকে ফেলে এসেছিলেন তিনি। সে অভিমানে ছিল তীব্র বেদনা। সেই বেদনার ছাপ যেন স্পষ্ট ফুটে ওঠে ‘বিদায়-বেলায়’ কবিতায়-
হাসি দিয়ে যদি লুকালে তোমার সারা জীবনের বেদনা,
আজো তবে শুধু হেসে যাও, আজ বিদায়ের দিনে কেঁদো না।
কলকাতায় ফিরে এলেও মন পড়ে ছিলো অনেক দূর এক গাঁয়ে প্রতীক্ষা নিয়ে বসে থাকা কিশোরী নার্গিসের কাছেই। এক মুহূর্তের জন্য কবি ভুলে থাকতে পারেননি প্রিয় নার্গিসকে। কেবলি কিশোরী বধূর সরল মুখখানিই কবির মানসে বারংবার প্রকট হয়েছে। এ যেন রাঁধা-কৃষ্ণেরই খেলা! হাসতে এসে যে কেঁদে বুক ভাসালো যে ষোড়শী বধূ, তারে যদি সঙ্গে আনা যেত! এই আফসোসে পুড়েছেন কবি বারংবার। একলাই কেঁদেছেন আরাধ্য দেবীর বিচ্ছেদে। ব্যাথাভরা হৃদয়ে কবি লিখেছিলেন-
পথ ভুলে তুই আমার ঘরে দু-দিন এসেছিলি,
সকল সহা! সকল সয়ে কেবল হেসেছিলি!
হেলায় বিদায় দিনু যারে
ভেবেছিনু ভুলব তারে হায়!
ভোলা কি তারে যায়?
ওরে হারা-মণি? এখন কাঁদি দিবস-যামিনী।
তারপর, কেটে গেছে ১৭ বছর। এই ১৭টি বছরে ফেলে আসা প্রেমের অনলে পুড়েছেন কবি, স্মৃতি-খরতাপে অঙ্গার হয়েছে তাঁর হৃদয়। মাত্র দুই মাসের প্রেম আর একটি দিনের পরিণয় স্মৃতির জ্বালা নিয়ে কেটে গেছে কবির জীবন। একদিকে প্রাণপ্রিয়ার কাছে ফেরত যাওয়ার আকুতি, অন্যদিকে তীব্র অভিমান। দুইয়ের মাঝখানে পড়ে একেকটি রাত যেন দুঃসময়ের মত কেটে গেছে তাঁর। নিভৃতে তাই কবির হৃদয় কেঁদেছে। কবির ভাষায়-
বৃথাই ওগো কেঁদে আমার কাটলো যামিনী।
অবেলাতেই পড়ল ঝরে কোলের কামিনী-
ও সে শিথিল কামিনী।।
নার্গিসও কি পোড়েনি সে-ই একই অনলে! প্রথম প্রণয় ও পরিণয়ের সময় সবে মাত্র তিনি ষোড়শী। হাতের মেহেদী আর রাতভর ঝরে পড়া শিশির জল শুকানোর আগেই নববধূর স্বামী ছেড়ে চলে যায়। এত অল্প বয়সে স্বপ্ন ভাঙ্গার ক্ষত কি এত সহজে যায়! ১৭টি বছর নিভৃতচারী রাঁধার মত একেকটি দিন কৃষ্ণের অপেক্ষায় প্রহর গুণেছেন। প্রথম প্রেমের সার্থক পরিণয়ে না গড়ানোর অপমান, হতাশা আর দুঃখবোধে কবিপত্নী নার্গিসও ছিলেন ম্রিয়মান। যাবার বেলায় বলে গিয়েছিলেন, পরের শাওনে আবার আসবেন। কিন্তু কবি আর আসে নি। যদি নজরুলের মত নার্গিসও কবি হতেন, হয়ত চোখের জলে লেখা হতো এক অভাগিনীর যাতনার ভেতর থেকে গজিয়ে ওঠা কবিতার চারা গাছ।
কবিও বুঝেছিলেন প্রেয়সী নার্গিসের অন্তরের গোপন ব্যাথা। প্রায়শ্চিত্ব বোধও ছিলো তাঁর। তাই তো কুমিল্লা ছেড়ে আসার পর শ্বশুড়কে লেখা একটি চিঠিতে তিনি ক্ষমা চেয়েছেন নার্গিসের কাছে- “অন্যান্য যাদের কথা রাখতে পারি নি তাদের ক্ষমা করতে বলবেন। তাকেও ক্ষমা করতে বলবেন, যদি এই ক্ষমা চাওয়া ধৃষ্টতা না হয়।”
১৯৩৭ সালে কলকাতার চিৎপুর থেকে আরেকটি চিঠিতে নার্গিসকে কবি লিখেছিলেন- “তোমার উপর আমি কোনো ‘জিঘাংসা’ পোষণ করিনা- এ আমি সকল অন্তর দিয়ে বলছি। আমার অন্তর্যামী জানেন তোমার জন্য আমার হৃদয়ে কি গভীর ক্ষত, কি অসীম বেদনা! কিন্তু সে বেদনার আগুনে আমিই পুড়েছি- তা দিয়ে তোমায় কোনোদিন দগ্ধ করতে চাইনি। তুমি এই আগুনের পরশ মানিক না দিলে আমি ‘অগ্নিবীণা’ বাজাতে পারতাম না- আমি ধুমকেতুর বিস্ময় নিয়ে উদিত হতে পারতাম না। তোমার যে কল্যাণ রূপ আমি আমার কিশোর বয়সে প্রথম দেখেছিলাম, যে রূপকে আমার জীবনের সর্বপ্রথম ভালবাসার অঞ্জলি দিয়েছিলাম, সে রূপ আজো স্বর্গের পারিজাত-মন্দীরের মতো চির অম্লান হয়েই আছে আমার বক্ষে। অন্তরের সে আগুন- বাইরের সে ফুলহারকে স্পর্শ করতে পারেনি।”
অবশেষে ১৭টি বছর দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর অবশেষে মিলন হয় রাধা-কৃষ্ণের। নজরুলের দেখা পান নার্গিস। তবে এ মিলন মধুর নয়, বেদনাবিধুর। ১৯৩৮ সালে শিয়ালদহতে তাদের আবার দেখা হয়, বিবাহ বিচ্ছেদে সই করার জন্যই। এই বিচ্ছেদে আনুষ্ঠানিকতায় শেষ যায় তাদের দীর্ঘ ১৭ বছরের এক করুণ প্রেমের অধ্যায়। তার কয়েক মাস পর ঢাকায় কবি আজিজুল হাকিমের সঙ্গে দ্বিতীয়বার বিয়ে হয়ে যায় নার্গিসের। এই বিয়ের সংবাদে বিমর্ষ হয়ে পড়েছিলেন নজরুল। হৃদয়ের ভেতর এক চূড়ান্ত ধাক্কা খেয়েছিলেন তিনি। বিয়ের কথা শুনে নার্গিসকে ‘পথ চলিতে যদি চকিতে কভু দেখা হয় পরানপ্রিয়’ গানটি লিখে পাঠিয়েছিলেন। সঙ্গে ছিল একটি চিরকুট।
তাতে লেখা ছিল- “জীবনে তোমাকে পেয়ে হারালাম, তাই মরণে পাব এই বিশ্বাস ও সান্ত্বনা নিয়ে বেঁচে থাকব।”
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে জুন, ২০২৩ রাত ১২:০৯