আট এপ্রিলের পর দশ মে আরো একটা প্রাকৃতিক আইকন বিষয় ঘটে গেলো আমার জীবনে এবছর। এমন দারুণ একটা বিষয়ের সাক্ষী হয়ে যাবো ঘরে বসে থেকে ভেবেছি অনেকবার। কিন্তু স্বপ্ন দেখার মতন সত্যি হয়ে গেলো ইচ্ছা । যাকে দেখার জন্য নিরন্তর ভাবি। মাঝে মাঝে ঘুম থেকে জেগে অন্ধকার আকাশে চোখ রাখি। কখনো রাত জেগে ঘুরে বেড়াই পথে, অন্ধকারে তাকে দেখার জন্য। কারণ তার সাথে দেখা হওয়ার সুযোগ শুধু অন্ধকার রাতে।
মনে প্রাণে কিছু চাইলে তা পাওয়া হয়। প্রকৃতির সাথে আমার ভাব ভালোবাসা। তাই প্রকৃতি আমাকে নিরাশ করেনি। লাইফ টাইমে একবার হলেও তাকে আমার দেখতে হবেই। এমন একটা ইচ্ছা মনে নিয়ে ঘুরতাম।
তাকে দেখার জন্য চলে যাবো আইসল্যাণ্ড, নয়তো নরওয়ে, ফিনল্যাণ্ড বা সুইডেন। ইয়েলনাইফ, বা নর্থওয়েস্ট টেরিটরি। আলাসকা বা নোনভেট।
প্রচণ্ড শীত হবে তাও তা সহ্য করে অপেক্ষা করব তার সাথে দেখা করার। কারণ মেরু অঞ্চলের এই জায়গাগুলো শীতকালে দীর্ঘ সময় ধরে রাত থাকে তাই শীতকালেই তাকে দেখার সুযোগ বেশি। বিশেষ করে অক্টোবর থেকে মে এই সময়ে।
গরমের সময় হয় উল্টা দীর্ঘ সময় ধরে দিনের আলো থাকে রাত হয় ক্ষণস্থায়ী। যাকে দেখার এত আশা তিনি হচ্ছেন মেরুপ্রভা, আরোরা বা উত্তরের আলো নর্দান লইটস। মেরুর কাছাকাছি জায়গায় অন্ধকার আকাশে আলোর নৃত্য দেখা যায়। যদিও দিনের বেলায়ও হয় সৌর ঝড় কিন্তু দিনের আলোয় আমরা দেখতে পাইনা মেরুজ্যোতি। যেমন দেখতে পাইনা দিনের আকাশে তারা। এরমানে এই নয় তারা দিনের বেলা আকাশে থাকে না। আকাশে তারা নিজের অবস্থানেই থাকে সূর্যের আলোর জন্য শুধু দৃষ্টিতে ধরা দেয় না।
মেরুজ্যােতি পুরো একটা প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া বায়ুমণ্ডলের বিভিন্ন স্তরে আলোর প্রতিফলনের মাধ্যমে যা তৈরি হয়। যখন সৌরজগতে ঝড় উঠে, বায়ুমন্ডলের এক্সোস্ফিয়ার অন্তর্গত আয়োনেস্ফিয়ার স্তরে মেরুজ্যোতি দেখা যায়।
আয়ন বায়ুমণ্ডলের বিভিন্ন গ্যাসের পরমাণুর মধ্যে প্রতিক্রিয়া তৈরি করে তখন ইলেকট্রন গুলি তীব্র গতিতে নিউক্লিয়াসকে কেন্দ্র করে চারপাশে ঘুরতে থাকে। এবং এই ঘূর্ণন এর ফলে মহাকাশে অনেক ধরনের আলোর সৃষ্টি হয়। এই রঙ বেরঙ এর আলোই হলো মেরুপ্রভা। এই আলো আবার অনুপরমানুর গ্যাস উত্তাপ, শীতলতা, ইত্যাদি নানা কিছুর উপর নির্ভর করে নানা রঙ ধরে। তাই বিভিন্ন রঙে দেখা যায় অরোরা।
বন্ধু, পরিচিত অনেকের কাছে শুনেছি তারা অরোরার আলো দেখার জন্য গিয়েছে নানা জায়গায় কিন্তু সাতদিন, দশদিন থেকেও তাদের ভাগ্যে অরোরা দেখার সৌভাগ্য হয়নি। আবার কেউ বলেছে প্লেনে করে যাচ্ছে রাতের বেলা দেখে গায়ের উপর রঙিন আলোর ঝলকানি। ঠিক তেমনি অনেক জাহাজীদের কাছে গল্প শুনেছি। হঠাৎ করে ওদের মাথার উপর নেচে উঠেছে রাতের বেলা আকাশে রঙিন আলো। যারা আগে জানতই না মেরুজ্যোতি নামের কিছু আছে এই পৃথিবীতে। ক্রুজের যাত্রীদের বাড়তি পাওনা হয়ে যায় অরোরার আলো দেখা।
কখনো ঈর্ষা হয়েছে ইস তারা দেখতে পেলে আমি কেন প্লেনে উড়ে যাওয়ার সময় তেমন কিছু দেখি না। আমি তো রাত হলেও জানলা খুলে বাইরে তাকিয়ে থাকি না ঘুমিয়ে। উত্তর মেরুর কাছাকাছি আকাশ পথে কতবারই তো উড়লাম।
তবে আমি আশা রাখি কোন একদিন তাকে আমার কাছে ধরা পরতেই হবে।
আমার এত আগ্রহ জেনে বাচ্চারাও যখনই শুনে জম্যাগ্নেটিক স্ট্রমের খবর তাড়াতাড়ি আমাকে জানায়। আর আমি না ঘুমিয়ে রাস্তায় অন্ধকারে ঘুরে বেড়াই যতটা উত্তরে যাওয়া যায় তাই যাই। তার সাথে দেখা করার আশায়।
কিন্তু অনেক বছর চেষ্টা করেও তার সাথে দেখা হয় না। কখনো খবর দেখি কাছাকাছি কোথাও দেখেছে মানুষ অথচ আমি খবর জানতে পারিনি আগে। আবার কাজের এত চাপ থাকে অনেক সময়, যেখানে যেতে হবে সেই জায়গায় যাওয়ার সময় সুযোগ করে উঠতে পারি না। মনে মনে কষ্ট পাই। আবার কবে এতটা নিচে নেমে আসবে, আমি কোথাও না গিয়ে কাছাকাছিই তাকে দেখতে পাব।
গত বছর চব্শি সেপ্টেম্বর অথার ফেস্টিভেল থেকে ফিরে রাতের আকাশ দেখছিলাম অন্ধকারে। আর মোবাইল ফোনে তারার ছবি তোলার চেষ্টা করছিলাম। কিন্তু সবুজ আলোর যে ঝলকটা ছবিতে ধরা পরল তাকে মেরুজ্যোতির আলো ভাবলেও কাউকে আর বললাম না। কারন ছবির আলো ছাড়া চোখে সবুজ আলো ধরা পরেনি। যদিও সেই রাতে সৌর জগতে ভূ-চৌম্বকীয় ঝড় হওয়ার কথা ছিল।
কিছুদিন আগে ইয়েলনাইফে ট্যুরিস্ট গাইডদের সাথে কথা বললাম। কখন গেলে ভালো দেখতে পাবো। কেমন খরচ হবে এসব বিষয়ে। এই বছর শরতে না হলে আগামী শীতে একটা চক্কর দিতেই হবে।
এর মাঝে খুব জোড়ে সরে খবর বলতে লাগল দশ মে থেকে বারো মে এই সময় খুব বড় সর ঝড় হবে সৌরমন্ডলে। জম্যাগ্নেটিক স্ট্রম মানে অরোরার আলোয় ভরে যাবে আকাশ। এবার খুব শক্তশালী এই ঝড়ের জন্য আলো ছড়াবে অনেকটা দক্ষিণে। এর প্রভাবে ইন্টারনেট, বিদ্যুৎের উপর প্রভাব পরতে পারে বলেও সতর্ক করা হচ্ছিল। এখন সুবিধা হয়েছে আগে ভাগে সময় জানা যায়। দেখা যায় কোন এলাকায় হবে অরোরা।
এবার আমার ঘরে বসে তাকে দেখার সুযোগ হবে। যদি না আবহাওয়া বিরোধিতা না করে। গত কিছুদিন ধরে আমেরিকার উপর দিয়ে অনেকগুলো হারিকেন হয়েছে। তার প্রভাবে আকাশ গোমড়ামুখো আর বৃষ্টি ঝরছে। তবে এই দুদিন বৃষ্টি হওয়ার কথা নেই। তাই মনে অনেক আশা নিয়ে থাকলাম। এবার আর মিস হবে না। দেখা হবেই তার সাথে।
সন্ধ্যা নামার সময় মনে হলো ঝড় উঠেছে সৌরমণ্ডলে। এত সুন্দর আলোয় ছেয়ে গেল চারপাশ। আকাশ পুরো বেগুনি, গোলাপী, কমলা সোনালী রঙ। সূর্যের শেষ সময়ের তীর্যক আলো মাঠ, ফুল পাতায় এমন অদ্ভুত সুন্দর রঙ লাগিয়ে দিয়েছে। মনে হচ্ছিল যেন আমি এক স্বপ্নপুরির মাঝে বসে আছি। ঘরে কাজ করছিলাম। সব ফেলে বাইরে চলে গেলাম। কয়েকটা ছবি তোলে, উপভোগ করছিলাম এই সৌন্দর্য।
খুব অল্প সময় স্থায়ী হলো এই রঙের বাহার স্বপ্নপুরির ফেইরি টেল, হারিয়ে গেল চট করে সূর্য ডুবার সাথে সাথে। কয়েক মিনিট সময়ে কত রকমের রঙ বদল হলো তাই শুধু দেখলাম। এরপরই ঝুপ করে অন্ধকার নামল।
আমি ডিনার সেরে ঘরের আলো নিভিয়ে বাইরে তাকিয়ে রইলাম। আজ আমার অন্য কোন কাজে মন নেই আমি আকাশে আলোর নাচ দেখব।
সাড়ে নটার দিকে একঝলক সবুজ আলো চোখে পরার সাথে সাথে ঘর থেকে বেরিয়ে দ্রুত মাঠে চলে গেলাম। অন্ধকার হয়ে যাওয়া রাতের আকাশ চারপাশ অন্ধকার থাকার কথা। অথচ আলো যেন স্নিগ্ধ চাঁদের জোছনা ঝরে পরছে। যদিও আকাশে তৃতীয়ার চাঁদ আছে। তৃতীয়া চাঁদের আলো এত বেশি নয়।
ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলাম আকাশ ভর্তি রঙ। গোলাপী, সবুজ, বেগুনি রঙ ঘুরে ঘুরে নাচছে আলোর পাখা মেলে। ক্ষণে ক্ষণে পরিবর্তিত হচ্ছে মূদ্রা। ঘুরে ঘুরে যাচ্ছে একদিক থেকে অন্য দিকে কি দারুণ কোরিওগ্রাফি।
ঘন হয়ে থাকা আলোর জায়গায় মনে হচ্ছে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। এক একটা রঙের দেয়াল তৈরি হচ্ছে আকাশ জুড়ে। অপূর্ব সৌন্দর্য, রঙের খেলা। আমার ধারনা ছিল শুধু উত্তর প্রান্তের আকাশে মেরুজ্যােতি খেলা করে। কিন্তু দেখলাম পশ্চিম থেকে উত্তরের অনেকটা অংশ জুড়ে ছড়িয়ে আছে রঙ। আমার মাথার উপর সপ্তর্ষি, তা ছাড়িয়ে আরো দক্ষিণে চলে গেছে আলোর ডানা। সারা আকাশ জুড়েই যেন আলোর খেলা চলছে আজ রাতে। এবং চলবে সারা রাত। এত বড় ঝড় অনেকদিন হয় না তাই এবারের প্রভাবটা অনেক বেশি। যার ফলে নেমে এসেছে অনেকটা নিচে দক্ষিণে আমার ঘরে। কোথাও না গিয়ে ঘরে বসে তার সাথে দেখা হলো। এতবার তার জন্য দৌড়াদৌড়ি করেছি তার প্রতিদান দিতেই প্রকৃতি যেন চলে এসেছে আমার কাছে।
দুই ঘন্টা আকাশের দিকে চোখ রেখে ঘাড় ব্যাথা হয়ে গেল। তাও আমার দেখার সাধ মিটে না। খোলা মাঠে ঘুরে বেড়াচ্ছি আমিও আকাশে চোখ রেখে। আবাহওয়া খুব সুন্দর ছিল। শীত ছিল সহনীয়। বাতাস ছিল না তাই শীতের প্রকোপ কম ছিল।
কত জায়গায় যাওয়ার পরিকল্পনা করেছি তাকে দেখার জন্য আর সে এসে ধরা দিল আমার ঘরে। হালকা পাতলা নয় বেশ জোড়েসরে আয়োজন করে প্রচুর রঙ নিয়ে এলো যাতে আমার সাধ পুরণ হয় তাকে দেখে।
সাধ মিটিয়ে দেখলাম। সবার সাথে ভাগ করলাম ফোন করে। কিছুটা ভিডিও কলে ছবি দেখিয়ে। ডিএসএলআর ক্যামেরায় ছবি তোলার চেষ্টা করলাম, হলো না। তেমনি বাইনোকুলারেও কিছু চোখে পরল না। খালি চোখেই দেখতে পেলাম। আর মোবাইল ফোনের ক্যামেরায় ছবি তুলতে পারলাম। তবে ভিডিও করতে পারলাম না। কেউ কেউ দেখলাম সুন্দর ভিডিও করেছে।
সারারাত ধরে বাইরে বসে থাকতে কোন সমস্যা নেই আমার কিন্তু ভোর বেলা উঠতে হবে একটা প্রোগরামে যেতে হবে। সাড়ে বারোটায় ঘরে এলেও ঘরের ভিতর বসেও আকাশই দেখলাম আরো অনেকক্ষণ। অবশেষে রাত আড়াইটায় ঘুমাতে গেলাম।
বড়ই শান্তিতে ঘুমালাম ইচ্ছা পূরণ করে।
পরদিন মেয়ে বলল রাতে আমি তোমার বাসায় এসেছিলাম । দুই ঘন্টা বাইরে থেকে অরোরা দেখে সূর্য যখন জাগছে তখন চলে এসেছি। ডাকোনি কেন আমাকে? তোমার সকালে কাজ ছিল তাই আর ডির্স্টাব করিনি। নয়তো তুমি ঘুমাও না আমি জানি। প্রচুর ছবি তুলেছে সেও। শহরে আলোয় কিছু দেখা যায় না বলে লাইফ টাইমের এক্সপেরিমেন্ট নিতে সেও চলে এসেছিল। সৌভাগ্য সারারাত চলেছে আলোর নাচন। তাই অনেক ভালো দেখতে পেয়েছে।
তারমানে সারারাত আকাশ জুড়ে আলোর নাচন ছিল। যেমন বলেছে বিজ্ঞানীরা। আমার বাড়ি থেকে সারারাত কেউ চোখ রেখেছে আকাশে। সন্ধ্যা রাতের পশ্চিম দিকের আলো ভোর রাতে পূবের দিকে চলে গেছে ওরা দেখেছে তখন যখন আমি পরম আনন্দে ঘুমাচ্ছিলাম।
ছবি আমার নিজের
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই মে, ২০২৪ দুপুর ২:২৯