
বাংলার ইতিহাসে হুসাইনি ব্রাহ্মণ এক অনন্য নাম। এই শব্দযুগল শুনলেই অনেকের মনে প্রশ্ন জাগে—‘ব্রাহ্মণ আবার হুসাইনি হয় কীভাবে?’ কিন্তু ইতিহাস বলে, হয়! এবং এই অসাধারণ ঐতিহ্য আজও ধর্মীয় সহনশীলতা, পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ এবং আন্তঃসম্প্রদায়িক বন্ধনের এক অনন্য উদাহরণ।
কে এই হুসাইনি ব্রাহ্মণ?
হুসাইনি ব্রাহ্মণ হলেন এমন এক দল হিন্দু ব্রাহ্মণ, যারা মহরম মাসে ইমাম হুসাইনের শোক পালন করে থাকেন। তাঁরা শিয়া মুসলিমদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কারবালার শহীদদের জন্য মাতম করেন, তাজিয়া মিছিলে অংশগ্রহণ করেন, এমনকি কিছু জায়গায় 'সীমিত রক্তপাত' অনুষ্ঠানেও জড়িত থাকেন। এই চর্চা শতাব্দীজুড়ে চলে এসেছে বিশেষ করে ভারতের উত্তর প্রদেশ, বিহার ও বাংলার কিছু অঞ্চলে।
ইতিহাসের পেছনের গল্প
এটির শিকড় প্রাচীন মিথ ও বিশ্বাসে প্রোথিত। জনশ্রুতি মতে, করবালার যুদ্ধের সময় ইমাম হুসাইনের সেনাবাহিনীতে হিন্দু রাজা পোরাস বা রাজারাজার এক বংশধরের কিছু যোদ্ধা নাকি অংশ নিয়েছিলেন। যদিও একে ঐতিহাসিক সত্য বলা কঠিন, তবে বহু শতাব্দী ধরে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে এই গল্প প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে ছড়িয়ে পড়েছে এবং একটি সামাজিক ঐতিহ্য গড়ে উঠেছে।
কেন হুসাইনি ব্রাহ্মণরা শোক পালন করেন?
হিন্দু ধর্মে ‘ধর্ম’ মানে শুধু পূজা নয়, বরং ন্যায়ের পক্ষে দাঁড়ানো, অন্যায়ের প্রতিবাদ করা। অনেক ব্রাহ্মণ পরিবার মনে করেন, ইমাম হুসাইন ছিলেন সত্য ও ন্যায়ের প্রতীক। তাঁর আত্মত্যাগ কেবল ইসলাম ধর্মের জন্য নয়, বরং মানবতার জন্য। এই চিন্তাধারা থেকেই তাঁরা এই শোকানুষ্ঠানে যোগ দেন।
বাংলায় হুসাইনি ব্রাহ্মণদের প্রভাব
বাংলাদেশের কিছু অঞ্চলে, বিশেষ করে রাজশাহী, দিনাজপুর, পাবনা ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ এলাকায় এখনও হুসাইনি ব্রাহ্মণদের ঐতিহ্য দেখা যায়। মহরম মাস এলেই তাঁরা কালো কাপড় পরেন, কোনো কোনো পরিবার উপবাস পালন করেন, এমনকি কিছু ক্ষেত্রে ‘শোক ভোজন’ আয়োজন করেন। শোক মিছিলে তাঁরা অংশ নেন হৃদয়ে ইমাম হুসাইনের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিয়ে।
ধর্মীয় সম্প্রীতির অনন্য নিদর্শন
হুসাইনি ব্রাহ্মণদের এই প্রথা আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়—বাংলা এবং উপমহাদেশের মাটিতে ধর্মীয় বিভাজনের চেয়ে মানবিক মূল্যবোধ অনেক বড়। এখানে এক ব্রাহ্মণ পরিবার ইমাম হুসাইনের জন্য অশ্রুপাত করতে পারে, আবার এক মুসলিম পরিবার দুর্গা পূজায় খুশি হয়ে বন্ধুদের বাড়িতে যেতে পারে। এটাই তো ছিল আমাদের চিরায়ত সংস্কৃতি—সহাবস্থান ও সহমর্মিতা।
হুসাইনি ব্রাহ্মণদের ইতিহাস শুধু একটি ধর্মীয় বা সাংস্কৃতিক ব্যতিক্রম নয়, বরং তা একটি শক্তিশালী বার্তা—মানবতা, ন্যায় ও একতার। এমন ইতিহাস আমাদের মনে করিয়ে দেয়, মানুষ হিসেবে আমাদের সবচেয়ে বড় পরিচয়—আমরা একে অপরের প্রতি দয়ালু, সহানুভূতিশীল এবং সম্মাননীয় হতে পারি, ধর্মীয় পরিচয়ের ঊর্ধ্বে গিয়েও।
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা জুলাই, ২০২৫ রাত ১০:১৮

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




