somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

দাদা ভাইয়ের এতেকাফ

২৫ শে নভেম্বর, ২০১৯ রাত ৯:১৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

জীবনের শ্রেষ্ঠ স্মৃতিগুলোর একটি হল দাদা ভাইয়ের এতেকাফের স্মৃতি। অনেক আগের কথা। তখন আমি ছোট। বয়স দশ কি বার। দাদার বয়স তখন সত্তরেরও বেশি। চুল দাড়ি সব সাদা। পল্লি-গাঁয়ের সাদাসিধা মানুষ। ছিলেন গাঁয়ের এক সাধারণ কৃষক। কিন্তু দিল ছিল আল্লাহপ্রেমে ভরপুর। আল্লাহর ভয়ে তার হৃদয় ছিল সদা কম্পমান। চোখে থাকত সর্বদা অশ্রুর বান।

প্রতি রমযানে এতেকাফে বসতেন। গ্রামের মসজিদে। বাড়ি থেকে মসজিদ খানিকটা দূরে। পায়ে হাঁটা দশ মিনিটের পথ। তিনি ছিলেন গ্রামের মসজিদের অঘোষিত মুয়ায্যিন। একাধারে অনেক বছর আযান দিয়েছেন। মসজিদের ছোট্ট একটি বারান্দা ছিল। সেখানেই আমার কুরআন মাজীদের হাতেখড়ি।

২০ই রমযান। জোহরের পর। বাড়ির সবাই ব্যস্ত। দাদা ভাই এতেকাফে যাবেন। কেউ বিছানা ভাঁজ করছে। কেউ বা জামা-কাপড়। কেউ ঠিক করছে পানের বাটা।

এরই মধ্যে দাদা ভাই বাড়ির সবাইকে ডাকতেন। আমরা ছোটরা দৌড়ে যেতাম তার কাছে। তিনি আমাদেরকে বলতেন, দুষ্টামি করবে না। দাদির কথা শুনবে। বৌমাদের বলতেন দাদির প্রতি খেয়াল রাখতে। তাঁর কথা মেনে চলতে। দাদিকে বলতেন, সবার দিকে খেয়াল রেখো। আমার জন্য দুআ করো।

বিদায় নিয়ে দাদা আস্তে আস্তে হেঁটে চলতেন। আমরাও পেছনে পেছনে। কারো হাতে বিছানা, কারো হাতে ব্যাগ। এতেকাফের দিনগুলোতে মসজিদে আমরা দাদাকে ঘিরে বসতাম। তিনি আমাদেরকে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও সাহাবায়ে কেরামের গল্প শোনাতেন।

দাদা এতেকাফে বসার পর আমার ইফতারি মসজিদেই হত। প্রতিদিন তার জন্য ইফতারি নিয়ে যেতাম মসজিদে। ইফতারের সময় দাদা আমার জন্য বাটিতে কিছু খেজুর ও ইফতার রেখে দিতেন। নামাযের পর পাশে বসিয়ে খেতে দিতেন। আর তিনি নামাযে দাঁড়িয়ে যেতেন।

নামায শেষে প্রাণ খুলে দুআ করতেন। আমিও পাশে বসে হাত উঠাতাম তার সঙ্গে। এখনো যেন কানে বাজে দাদার দুআ ‘গোনাহ করছি ভুল কইরাছি/ জীবনের গোনাহ মাফ করো গো আল্লাহ/ এ জীবনে আর গোনাহ করব না।’

দাদা এ বলে কাঁদতেন আর কাঁদতেন। আমি তাকিয়ে থাকতাম দাদার মুখের দিকে। তারাবির নামায পড়ে বাড়ি ফিরতাম ছোট চাচার সঙ্গে। তখন খুব খারাপ লাগত। আবার সকাল হতে না হতেই দৌঁড়ে যেতাম দাদার কাছে। বাড়িতে ভালো লাগত না।

দাদা এতেকাফের সময়টা কুরআন তিলাওয়াত, নফল নামায, যিকির আযকার আর নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও সাহাবায়ে কেরামের জীবনী আলোচনায় কাটাতেন। অন্য কোনো কথা বলতেন না। মাঝে মাঝে বাড়ির খোঁজ-খবর নিতেন। এভাবে কখন যে দশটা দিন কেটে যেত টেরই পেতাম না।

২৯ রমযানে আমরা ছোটরা মসজিদে যেতাম দলবেঁধে। পশ্চিম আকাশে একফালি বাঁকা চাঁদ। কি মিটমিট করে হাসছে। আর এরই মাঝে আমাদের ‘ঈদ’ শুরু হয়ে যেত, দাদা বাড়ি যাবেন বলে। সকলের মাঝে খুশির জোয়ার। চোখেমুখে আনন্দের ঝিলিক।

এতেকাফ শেষে দাদা বাড়ি ফেরার সময় গোল বেঁধে যেত ছোটদের মাঝে, কে কী নিয়ে যাবে- এ নিয়ে। ও বলে আমি বিছানা নিব, এ বলে আমি নিব। পানের বাটা একজন, ব্যাগ আরেকজন।

মাগরিবের পর খুব মজা করে সবাই মিলে দাদার সামানা নিয়ে রওয়ানা হতাম বাড়িতে। দাদা এশার নামায পড়ে তারপর আসতেন। এভাবে দাদা প্রতি বছর এতেকাফে বসতেন। আর চাঁদ ওঠার পর দাদার এতেকাফ শেষ হলে আমরা ঈদের আগেই ‘ঈদ’ করে ফেলতাম।

এই তো ক’দিন হল, দাদা আমার জান্নাতে এতেকাফে চলে গেছেন (এমনটিই আল্লাহর কাছে আশা রাখি)। তখন বিছানা গোছানোর ব্যস্ততা ছিল না। ছিল না ব্যাগ ও পানের বাটা ঠিক করার ব্যস্ততা। কিছুই দেওয়া হয়নি তাঁর সাথে। শুধু একটা সাদা কাফন। তাও সেলাই ছাড়া।

এখন আর আমাদের ঈদের আগে ‘ঈদ’ আসবে না। দৌড়ে যাব না দাদাকে আনতে। কারণ দাদা আর আসবেন না। আসল বাড়ি থেকে কেউ আর ফিরে আসে না!

আল্লাহ! আমার দাদাকে তুমি জান্নাতের উঁচু মকাম দান কর! আমাদের দাদা-দাদি সকলের সব গোনাহ মাফ করে দাও! তাদের কবরকে জান্নাতের বাগিচা বানিয়ে দাও! আমাদেরকে তাঁদের মত ভালো মানুষ হওয়ার তাওফীক দাও। আমীন।
২০/০৮/২০১০ ঈ.
সকাল ৭টা

সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে নভেম্বর, ২০১৯ রাত ৯:১৯
২টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

বন্ডাইর মত হত্যাকাণ্ড বন্ধে নেতানিয়াহুদের থামানো জরুরি...

লিখেছেন নতুন নকিব, ১৬ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১১:২৫

বন্ডাইর মত হত্যাকাণ্ড বন্ধে নেতানিয়াহুদের থামানো জরুরি...

বন্ডাই সৈকতের হামলাস্থল। ছবি: রয়টার্স

অস্ট্রেলিয়ার সিডনির বন্ডাই সৈকত এলাকায় ইহুদিদের একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠানে সমবেত মানুষের ওপর দুই অস্ত্রধারী সন্ত্রাসী অতর্কিতে গুলি চালিয়েছে। এতে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আল্লাহ সর্বত্র বিরাজমাণ নন বলা কুফুরী

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ১৬ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:১৪



সূরাঃ ২ বাকারা, ২৫৫ নং আয়াতের অনুবাদ-
২৫৫। আল্লাহ, তিনি ব্যতীত কোন ইলাহ নেই।তিনি চিরঞ্জীব চির বিদ্যমাণ।তাঁকে তন্দ্রা অথবা নিদ্রা স্পর্শ করে না।আকাশ ও পৃথিবীতে যা কিছু আছে সমস্তই... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিজয়ের আগে রাজাকারের গুলিতে নিহত আফজাল

লিখেছেন প্রামানিক, ১৬ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৫:১৩


ঘটনা স্থল গাইবান্ধা জেলার ফুলছড়ি থানার উড়িয়া ইউনিয়নের গুণভরি ওয়াপদা বাঁধ।

১৯৭১সালের ১৬ই ডিসেম্বরের কয়েক দিন আগের ঘটনা। আফজাল নামের ভদ্রলোক এসেছিলেন শ্বশুর বাড়ি বেড়াতে। আমাদের পাশের গ্রামেই তার... ...বাকিটুকু পড়ুন

৫৫ বছর আগে কি ঘটেছে, উহা কি ইডিয়টদের মনে থাকে?

লিখেছেন জেন একাত্তর, ১৬ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৫:৫৮




ব্লগের অনেক প্রশ্নফাঁস ( Gen-F ) ১ দিন আগে পড়া নিউটনের ২য় সুত্রের প্রমাণ মনে করতে পারে না বলেই ফাঁসকরা প্রশ্নপত্র কিনে, বইয়ের পাতা কেটে পরীক্ষার হলে নিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

১৯৭১ সালে পাক ভারত যুদ্ধে ভারত বিজয়ী!

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ১৭ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৯


দীর্ঘ ২৫ বছরের নানা লাঞ্ছনা গঞ্জনা বঞ্চনা সহ্য করে যখন পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বীর বাঙালী অস্ত্র হাতে তুলে নিয়ে বীরবিক্রমে যুদ্ধ করে দেশ প্রায় স্বাধীন করে ফেলবে এমন সময় বাংলাদেশী ভারতীয়... ...বাকিটুকু পড়ুন

×