
আমরা যারা ঢাকা শহরে বাস করছি প্রতিদিন নানা ঝঞ্ঝাট ঝামেলার পর ঘরে ফিরে নিশ্চিন্ত হই এই ভেবে- যাক আরেকটা দিন কাটল ভালোভাবে! আমরা কখনো ভাবতেই পারি না, এই নিরাপদ দিনের আড়ালে আমাদের সামনে একটা বড় বিপদ ঘাপটি মেরে আছে - আমরা জানিই না যে, অল্প অল্প করে আমাদের পায়ের নিচের মাটি সরে যাচ্ছে!
এই মাটি সরে যাওয়া, যাকে ইংরেজিতে বলে subsidence, তা হচ্ছে ভৌগলিক আর মানব সৃষ্ট- এই দুই কারণে। দুটো টেকটনিক প্লেটের সংযোগস্থলে আমাদের দেশের অবস্থিতির কারনে প্রতিবছর ভূমির ৩.৫ মি. মি. অধোগমন (subsidence) হচ্ছে। ঢাবির ভূগোল বিভাগের এক পর্যবেক্ষণে (https://www.thedailystar.net/news-detail-217458) দেখা গেছে, ঢাকার ভূমি (land mass) প্রতিবছর আধোগমন হচ্ছে ১৩.৯১ মি. মি.। এই যে বাড়তি ১০.৪১ মি. মি. সাবসিডেন্স, এটা হচ্ছে ঢাকার শহরে অনিয়ন্ত্রিতভাবে ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলনের ফলে। ভূগর্ভস্থ পানি বিপুল পরিমাণে প্রতিদিন তোলা হচ্ছে তার কারণ ঢাকার বিপুল জনসংখ্যা। ঢাকার আয়তন চারশো পঞ্চাশ বর্গ কিলোমিটারেরও কম, অথচ এই নগরে বাস করে প্রায় দুই কোটি মানুষ, প্রতিবছর আরো প্রায় পাঁচ লক্ষ মানুষ বাড়ছে, সুতরাং এই বিপুলসংখ্যক মানুষের জন্য পানির প্রয়োজন কেবলই বেড়ে চলছে। ঢাকার পানি ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে আছে ঢাকা ওয়াসা। পানির চাহিদা মেটাতে ওয়াসা সবচাইতে সহজ পথটি বেছে নিয়েছে, তারা ক্রমাগত মাটির নিচের পানি ঢাকাবাসীর ব্যবহারের জন্য উত্তোলন করে চলেছে। এভাবে বেহিসেবি পানি তোলার ফলে পানির স্তর নেমে যাচ্ছে, বছরে তিন মিটার বা দশ ফিট করে- আশির দশকে এই হার ছিল বছরে এক ফুট। পানি তুলতে তুলতে অনাবদ্ধ একুইফারের শতকরা ৮০-৯০ ভাগ পানি শেষ হয়ে যাবার পর ওয়াসা হাত বাড়িয়েছে আবদ্ধ একুইফারের দিকে, ঢাকার ৭০টি পয়েন্টে তারা এখন আবদ্ধ একুইফার থেকে পানি তুলছে। এই কর্মকান্ড ঢাকাবাসীর জন্য বিপদ বয়ে আনতে পারে, এটা জেনেও তারা একাজ করছে
https://www.thedailystar.net/news-detail-83387
অনাবদ্ধ একুইফারে বৃষ্টির পানি বা জলাভূমির পানি ঢুকতে পারে, ফলে এরকম একুইফার থেকে যে পানি উত্তোলিত হয় তা আবার পূরণ (recharge) হতে পারে। আবদ্ধ একুইফার রিচার্জ হয় দূরের কোন জলাশয়ের পানি দিয়ে, বা বৃষ্টির পানি দিয়ে, যদি সেখানে অভেদ্য স্তর না থাকে। যখন নলকূপ দিয়ে পানি বের করে নেয়া হয় তখন একুইফারের মাটির ভিতরের সূক্ষ্ম রন্ধ্র থেকে পানি বেরিয়ে তা বাতাসে পূর্ণ হয়, ফলে মাটির স্থিতিস্থাপকতা কমে যায়, আস্তে আস্তে
মাটি দেবে যেতে থাকে।
এখন যখন ঢাকার ভূগর্ভস্থ পানির স্তর বছরে তিন মিটার করে নামছে তখন কিন্তু ভূগর্ভে পানি রিচার্জ হচ্ছে প্রয়োজনের তুলনায় খুব, খুব কম। কারণ রিচার্জ হতে পারতো তিন ভাবে-
১) বৃষ্টির পানি দিয়ে।
২) ঢাকার চারপাশ দিয়ে বয়ে চলা নদী বুড়িগঙ্গা তুরাগ বালু শীতলক্ষ্যা এই চার নদী, ঢাকা শহরের লেক, খাল ইত্যাদি দিয়ে ।
৩) ঢাকা ও এর আশেপাশের জলাধার ও বন্যাপ্রবাহ এলাকার মাধ্যমে।
রিচার্জ হতে পারত, কিন্তু তা হচ্ছে না। বৃষ্টির পানি চুইয়ে মাটিতে ঢোকার মতো খোলা জায়গা ঢাকাতে খুবই অল্প আছে। খোলা জায়গা ঢেকে অপরিকল্পিতভাবে কেবলই দালানকোঠা তোলা হচ্ছে। দুটি বাড়ির মধ্যে কয়েক ফিট ঘাসওয়ালা জমি দেখা গেলেও সেখান থেকে পানি চুইয়ে ঢোকা সম্ভব নয়, কারণ এর নীচে থাকে বাড়ির ফাউন্ডেশনের অভেদ্য স্তর। ফলে বৃষ্টির পানি মাটিতে না ঢুকতে পেরে জমা হতে থাকে। এই পানি বৃষ্টির পানি যাবার নালা দিয়ে নিকটস্থ খাল, লেক বা জলাভূমিতে গিয়ে পড়ার কথা, কিন্তু পড়ে না কারণ এখন অধিকাংশ স্টর্ম সোয়ার ড্রেন আবর্জনা দিয়ে বন্ধ থাকে। আবার খাল, লেক বা নদীর অধিকাংশই ভরাট হয়ে গেছে, তাই বৃষ্টির পানি এগুলোতেও যেতে পারেনা। তাই গত কয়েক বছর ধরে দেখা যাচ্ছে, অল্প বৃষ্টিতেই রাস্তা ঘাটে পানি জমে যাচ্ছে। এই পানি পরে পয়োনিষ্কাশন নালা দিয়ে নিষ্কাশন করা হয়। তাই বৃষ্টির পানি ভূমিতে ফিরে যেতে পারে না, ভূমিতে পানির রিচার্জও হয় না। অথচ ভূগর্ভস্থ পানি যাতে ঠিকমতো রিচার্জ হতে পারে সেজন্য আমাদের আছে জলাভূমি সংরক্ষণ আইন। এই আইন বলে, ঢাকার ভূমির দশ থেকে তের শতাংশ ভূমিতে জলাধার থাকা উচিত, কিন্তু আছে মাত্র চার শতাংশ।
জলাধার সংরক্ষণ আইন করার পাশাপাশি ড্যাপ প্রণয়ন করা হয়েছিল যাতে ঢাকার বিভিন্ন অঞ্চলে ভূমির শ্রেণী বিভাগ করা যায়, আবাসিক কৃষি, শিল্পাঞ্চল এবং অতি গুরুত্বপূর্ণ জলাধার ও বন্যাপ্রবাহ এলাকা হিসেবে। জলাধার সংরক্ষণ আইন ও ড্যাপ কার্যকর হলে বর্ষাকালে বাড়তি পানি প্রথমে বন্যাপ্রবাহ এলাকায় ও সেখান থেকে নদীতে যাবার কথা, সেখান থেকে ভূগর্ভস্থ পানিস্তরে। কিন্তু জলাধার ও বন্যাপ্রবাহ এলাকা ভরাট করে ব্যাপকভাবে আবাসিক ভূমি তৈরি হচ্ছে, ফলে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি করে পানি রয়েই যাচ্ছে, ভূমিতে রিচার্জ হচ্ছে না। পানি রিচার্জ না হলেও ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলন বেড়েই চলেছে। ২০০৯ সালে ঢাকায় ওয়াসা পানি তুলত ৪৮২টি গভীর নলকূপ দিয়ে, নয় বছর পর তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮১৯টিতে। Click This Link অথচ ভূমিধস ও ভূমিকম্পের কথা বিবেচনা করে পরিকল্পনা করা হয়েছিল ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার ৮৩ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৩০ শতাংশে নামানো হবে আর বাকি পানির চাহিদা মেটানো হবে নদীর পানি শোধন করে। এজন্য সায়েদাবাদ পানি শোধনাগার এর দ্বিতীয় পর্ব চালু হলেও, সেটা চাহিদা মেটাতে পারে মাত্র ২২ শতাংশের। আসলে নদীর পানি এতোটাই দূষিত যে তা শোধন করে খাবার উপযোগী করাটা দুষ্কর।

এই পানি কে খাবার উপযোগী করা কি সোজা কথা?
তাই নদীর পানি শোধন করার চিন্তা বাদ দিয়ে আরো ১০০০ অবৈধ গভীর নলকূপ বসানো হয়েছে। https://www.thedailystar.net/news-detail-83387 ঢাকা শহরে অনেক বহুতল ভবন আর প্রাইভেট হাসপাতালেই অবৈধ গভীর নলকূপ আছে। এত এত গভীর নলকূপ এর কারনে ঢাকা শহরে এখন আর আগের মতো পানি সমস্যা হয়না কিন্তু মাটির গভীরে যে সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে তাতো আমরা দেখতে পাচ্ছি না! Study on groundwater depletion and land subsidence in Dhaka city শিরোনামে বুয়েটের এক পেপারে বলা হয়েছে, 'ঢাকার কোন কোন এলাকায় subsidence ৪.৯ সে. মি. পর্যন্ত।
এর ফলে ধস নামলে তাতে জানমালের ব্যাপক ক্ষতি পারে। তাই প্রয়োজন জরুরি ভিত্তিতে নীতিমালা প্রণয়নের যেন ভূ-উপরিস্থ পানির ব্যবহার বাড়িয়ে ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার কমানো হয় এবং বৃষ্টির পানি যাতে ভূমিতে ফিরে যেতে পারে সেই মতো ব্যবস্থাদি নেওয়া।' Click This Link
মাটির অধোগমনের হার ভূমিকম্পে ক্ষয়ক্ষতির মাত্রা অনেক বাড়িয়ে দেবে বলে আশঙ্কা করা হয়। এই বিপদ এড়াতে ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবহার করা কমাতে হবে। তার জন্য দরকার:
১)ঢাকা ঘিরে রাখা চার নদীর পানির দূষণ কমানোর ব্যবস্থা করা, যেন সহজে শোধন করে এই পানি ব্যবহারযোগ্য করা যায়।
২)নদী ও খাল দখলমুক্ত করা এবং ভালোভাবে খনন করা।
৩)জলাধার ভরাট করার অনুমতি আর না দেয়া, (২৩ এপ্রিল,২০১৮র প্রথম আলোয় দেখা যায়, কয়েকদিন আগে ৩৪টি জলাধার ভরাটের অনুমতি দেয়া হয়েছে) এবং ভরাট হয়ে যাওয়া জলাধার কে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে দেয়া।
৪)বৃষ্টির পানি যাবার নালাগুলো নিয়মিত পরিষ্কার করা, যাতে এই নালা দিয়ে পানি জলাশয়ে পৌঁছাতে পারে।
৫)বাড়ির ডিজাইনে বাধ্যতামূলকভাবে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ ব্যবস্থা (rainwater harvesting) রাখা।
কাজগুলো করা কঠিন নয়, কঠিন হচ্ছে অর্থের লোভ দমন করে ভালো কাজ করা!
ভূমিধস ছাড়াও আরেক বিপদ ঘাপটি মেরে আছে- একে বলে ভূগর্ভস্থ পানিতে লবণাক্ততার অনুপ্রবেশ। ভূগর্ভস্থ পানির স্তর কমতে কমতে যদি গড় সমুদ্রতলের নিচে চলে যায়, তবে সমুদ্রের পানি মিলিত হবে ভূগর্ভস্থ পানির সাথে, তখন ভূগর্ভস্থ পানি লবনাক্ত হতে থাকবে। সারাদেশেই ভূগর্ভস্থ পানির স্তর কমে যাচ্ছে- কারণ অব্যাহতভাবে গভীর নলকূপ বসানো চলছে সারাদেশে। পদ্মা, তিস্তাসহ চুয়ান্নটি অভিন্ন নদীর উজানে ভারত বাঁধ নির্মাণ করায় এদেশের অনেক নদীর পানি প্রবাহ কমে গেছে আর নদী দখলের ফলে অনেক নদী মরে গেছে। সুতরাং পানীয় আর কৃষিকাজের জন্য প্রয়োজনীয় পানি পেতে এখন গভীর নলকূপই ভরসা, সারা দেশে এখন প্রায় ৫০ লাখ গভীর নলকূপ পানি তুলে চলেছে। Click This Link তাই ঢাকার মত এত দ্রুত না হলেও সারা দেশেরই পানি স্তর নামছে, আমাদের খাদ্য-উৎপাদন,পরিবেশ,জনস্বাস্থ্য সমস্ত কিছুই বিপদের মুখে আছে, আমরা জানতে পারছি না।
অপরিণামদর্শিভাবে ভূগর্ভের পানি তোলা যদি বন্ধ না হয় তবে বিপদ একদিন আসবেই, যেমন এসেছিল মেক্সিকোর মেক্সিকো সিটি, আমেরিকার ক্যালিফোর্নিয়া, টেক্সাস, ফ্লোরিডার অনেক অঞ্চল আর আফ্রিকার অনেক দেশে। ভূগর্ভস্থ পানি তোলার ফলে এসব অঞ্চল দেবে গিয়েছিল।

এই ছবিতে ক্যালিফোর্নিয়ার একটি কৃষিজমি দেখানো হচ্ছে। কৃষিকাজের জন্য এখানে বিপুল পরিমাণ ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলন করার ফলে ভূমি ক্রমশ দেবে গেছে। খুঁটিতে তিনটি বছর লেখা সাইনবোর্ড আছে। এই সাইনবোর্ড গুলি ওই বছরগুলিতে ওই জায়গায় ভূমির উচ্চতা নির্দেশ করছে।
আশাকরি ঢাকায় এমন বিপদ আসতেই দেবেন না আমাদের সুদক্ষ কর্তৃপক্ষ!!
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই ফেব্রুয়ারি, ২০২০ রাত ৯:৪২

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।


