আগের পর্ব: নতুন জীবন- এক
আমি আবার বললাম,
"জুতা না খুলে কোনভাবেই পা বের করতে পারবেনা!"
সোফি আবারো আতঙ্কিত গলায় বলল,
" না না, কিছুতেই না! আমি কিছুতেই জুতা খুলব না!"
আমি বুঝতে পারলাম না কি করব! সোফি তার দুই হাত দিয়ে আমার হাত ধরে নিঃশব্দে কাঁদতে লাগল; বোঝাই যাচ্ছিল তার পায়ের ব্যথা বেড়ে যাচ্ছে! এবার আমি ওকে আবার বোঝালাম:
"আর কোন উপায় নেই! এভাবে পা বের না করলে তোমাকে এখানেই বসে থাকতে হবে সারাজীবন।"
আরো কিছুক্ষণ পা বের করার চেষ্টা করার পর সোফি হাল ছেড়ে দিল... আমি যখন ওর জুতার ফিতা কাটছি তখন সে খুব উদ্বিগ্ন হয়ে তাকিয়ে ছিল; কাটা শেষ হতেই বলল, "তুমি দূরে যাও, এদিকে তাকাবে না।" আমি ওর দিকে পিঠ দিয়ে সরে দাঁড়ালাম। একটু পরেই কান্না শুনে তাড়াতাড়ি কাছে গিয়ে দেখি, সোফির পা আটকে গেছে!
আমি ওকে সাহায্য করার জন্য হাঁটু মুড়ে বসতেই ও কাঁদতে কাঁদতে বলল, "তুমি একথা কখনো কাউকে বলবেনা, প্রমিস?" কিসের প্রমিস তা না বুঝেই বললাম, "প্রমিস"।
দুজনে মিলে অনেক টানাটানির পর যখন পা বের হলো, তখন সেটা ফুলে এমন বিকৃত হয়ে গেছে যে, ছয় নাম্বার আঙ্গুলটা আমি প্রথমে দেখতেই পাইনি! পা বের করার পর দেখা গেল, সোফি মাটিতে পা রাখতেই পারছে না!
" কাউকে ডেকে আনি সাহায্য করার জন্য।" আমি এ কথা বলা মাত্র সোফি আঁতকে উঠল, "না না, আমি হামাগুড়ি দিয়ে যেতে পারবো"
হামাগুড়ি দিয়ে বাঁধ পেরিয়ে সোফি অনেকদূর এগুলো, পাশে পাশে জুতা হাতে আমি; কিন্তূ একসময় থামতেই হল, সোফির হাঁটু রক্তাক্ত হয়ে গেছিল। এবার অনেক কষ্টে আমার কাঁধে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে সোফি দেখালো ওর বাড়ি কোথায়; দূরে যেখানে ক্ষীণ একটা ধোঁয়ার রেখা দেখা যাচ্ছিল, সেখানে। আমি ভালো করে ধোঁয়াটা দেখতে দেখতেই দেখি সোফি হামাগুড়ি দিয়ে একটা ঝোপের পিছনে লুকিয়েছে!
ধোঁয়া দেখে দেখে সেই বাড়িতে পৌঁছে গেলাম। দরজায় নক করতে লম্বা একজন মহিলা দরজা খুলে দিলেন।
" আপনি কি সোফির মা?
মহিলা কপাল কুঁচকে উদ্বিগ্ন ভাবে প্রশ্ন করলেন, "কি হয়েছে?" আমি সব বলার পর তিনি চমকে গিয়ে বললেন, " হায়! ওর পা!" এরপর জানতে চাইলেন সোফি কোথায়। আমি যখন ওনাকে নিয়ে গেলাম, ওনার গলা শুনতে পেয়ে সোফি হামাগুড়ি দিয়ে বেরিয়ে এলো। সোফির রক্তাক্ত, ফোলা, কিম্ভূতকিমাকার পা দেখে ওর মা ওকে আদর করে জড়িয়ে ধরলেন।
"মা, আমি অনেক চেষ্টা করেও পা বের করতে পারিনি, তাই ওর সাহায্য নিতে হয়েছে। ও আমার পা দেখে ফেলেছে মা!"
দীর্ঘশ্বাস ফেলে ওর মা বললেন "ঠিক আছে, এখন কিছু করার নেই। বাসায় চলো।" সোফিকের পিঠে চাপিয়ে উনি বাসায় নিয়ে এলেন।
সোফির বাসা আমাদের বাসার চাইতে ছোট, কিন্তু পরিপাটি করে গোছানো। সোফির মা যখন ওর পা ধুয়েমুছে গরম সেঁক দিচ্ছিলেন, তারপর পায়ে ব্যান্ডেজ করছিলেন, আমি তখন চুপচাপ বসে দেখছিলাম। সোফির পায়ে ৬ টি আঙ্গুল দেখেও আমার কিছুই অস্বাভাবিক মনে হলো না। অথচ একজন স্বাভাবিক মানুষ কেমন হবে তার বর্ণনা আমার মাথায় গেঁথে আছে; আমার জীবনের প্রায় প্রতিটি রোববারে এই বর্ণনা আমি বারেবারে শুনেছি,- " ঈশ্বর মানুষকে নিজের আকৃতিতে সৃষ্টি করলেন। তার সৃষ্ট প্রতি মানুষের থাকবে একটি ধড়, একটি মাথা, দুটো হাত আর দুটো পা; প্রত্যেক হাতে দুটো জোড়া থাকবে, হাতের পাতায় পাঁচ আঙুল, আঙুলের মাথায় চ্যাপটা নখ...
এই বর্ণনার পর থাকে উপদেশ। বলা হয়, অংগে বিকৃতি থাকা মানুষ আসলে মানুষ নয়; সে পাপাত্মা, তার ব্যাপারে ব্যবস্থা নিতে হবে...
আমাকে অপেক্ষা করতে বলে সোফির মা সোফিকে তার ঘরে শোয়াতে গেলেন। একটু পর ফিরে এসে আমার হাত ধরে কিছুক্ষণ বসে রইলেন। তিনি কথা না বললেও সোফির জন্য তার গভীর উদ্বেগ আমি শুনতে পাচ্ছিলাম। আমি তাকে একইভাবে ভরসা শোনাতে চাইলাম, কিন্তু তিনি সেটা বুঝতে পারলেন না!
অবশেষে উনি কথা বললেন, "ডেভিড, তুমি খুব ভালো ছেলে! তোমাকে অনেক ধন্যবাদ"
আমি কী উত্তর দেবো বুঝতে না পেরে মাথা নিচু করে বসে রইলাম; কিন্তু তিনি তখনো কথা বলছিলেন,
"সোফি ভালো মেয়ে, তাই না?"
আমি বললাম, "হ্যাঁ, সোফি খুব সাহসী মেয়ে।" উনি বললেন "সোফির জন্য তুমি কি কথাটা গোপন রাখবে ডেভিড? না হলে মহা সর্বনাশ হয়ে যাবে"
" নিশ্চয়ই", বললাম আমি; গোপন কথাটি কি তা না বুঝেই।
"তুমি... তুমি কি ওর পায়ের আঙ্গুল দেখেছো?" উদ্বিগ্ন চোখে তাকিয়ে সোফির মা জিজ্ঞেস করলেন।
"হ্যাঁ", আমি একটু দ্বিধান্বিত স্বরে বললাম।
" এটাই গোপন কথা ডেভিড! এই কথাটা কেউ যেন না জানে। আমি আর সোফির বাবা ছাড়া একমাত্র তুমি এখন এ কথা জানো।" উনি চুপ করলেন। কিন্তু আমি স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছিলাম, ভয় আর উদ্বেগ নিয়ে উনি মনে মনে বলছেন, "কেউ না... কখনো না..."! চিন্তার মাধ্যমে তাকে উত্তর পাঠালে তিনি ধরতে পারছেন না, তাই এবার আমি যতদূর সম্ভব জোর দিয়ে বললাম, "কখনোই না, কেউ কখনো জানবে না"
" এটা কেউ জানতে পারলে তারা সোফিকে প্রচন্ড নিষ্ঠুরভাবে শাস্তি দেবেন... সেটা যেন কখনো না হয়... কি করে যে কথাটা তোমাকে বোঝাই!"
বোঝাবার কোন দরকার ছিল না। তিনি মুখে না বললেও তার মনের সমস্ত কথাই আমি বুঝতে পারছিলাম।
"আমি এই কথা কাউকে বলব না, আপনি চাইলে কসম কাটতে পারি"
"না ডেভিড, তোমার মুখের কথাই যথেষ্ট!"
আমি ঠিক করলাম একথা গোপন রাখবো, এমনকি রোজালিনের থেকেও। যদিও মনের ধন্দ যাচ্ছিল না, একটা বাড়তি ছোট আংগুলে অসুবিধা কোথায়! সোফির মায়ের দুঃখিত চাহনি দেখে আমার অস্বস্তি হচ্ছিল। তিনি আমার অস্বস্তি বুঝতে পেরে সহৃদয় হাসি হাসলেন।
"আমরা কথাটা গোপন রাখবো, ঠিক আছে? কখনোই কাউকে বলবো না!"
চলে আসার সময় আমি জিজ্ঞেস করলাম,
" আমি কি আবার আসতে পারি?"
" এ্যা... হ্যাঁ...আসতে পারো, যদি কাউকে একেবারেই না জানিয়ে আসতে পারে", অল্প চিন্তা করে উত্তর দিলেন তিনি।
(২)
যখন আমি বাঁধের উপর দিয়ে বাড়ি ফিরছিলাম, তখন হঠাৎ করে রবিবারের উপদেশগুলোর তাৎপর্য বুঝতে পারলাম। মনে পড়ল মানুষের বর্ণনা শেষ হয়েছে এভাবে, "... প্রতিটি পায়ে থাকবে একটি করে পায়ের পাতা, প্রতিটি পায়ের পাতায় পাঁচটি করে আঙ্গুল..." বর্ণনা শেষে বলা হয়, "যে কোন সৃষ্টি, যাকে মানুষের মতো দেখায় অথচ অথচ যে এই বর্ণনার সাথে মিলে না, সে আসলে মানুষ নয় সে এক পাপাত্মা, ঈশ্বরের দৃষ্টিতে চরম ঘৃন্য।"
আমার সব কিছু গোলমেলে লাগছিল; পাপাত্মা মানে ভয়ঙ্কর কিছু একটা; কিন্তু সোফি কেন ভয়ঙ্কর হবে? সে ছোট একটা মেয়ে, সাহসী আর ভদ্র! শুধু পায়ে একটা বাড়তি আঙ্গুলের জন্য সে ঈশ্বরের দৃষ্টিতে ঘৃন্য কেন হবে!! কোথাও নিশ্চয়ই কোন ভুল হচ্ছে!
বাড়ি ফিরলাম খুব সাবধানে, সবার অগোচরে। বাঁধ থেকে নেমে প্রথমে জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে পায়ে চলা পথে মাইলখানেক হাঁটার পর জঙ্গল হালকা হয়ে এল, তিন চারটা আবাদি জমির পর আমাদের বাড়ি দেখা যাচ্ছিল। আমি জঙ্গলের গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে প্রথমে দেখে নিলাম মাঠে কাউকে দেখা যাচ্ছে কিনা। যখন দেখলাম কাউকে দেখা যাচ্ছে না তখন ঝোপঝাড়ের আড়ালে তিনটা জমি পার হলাম। বাড়ির উঠোনে বুড়ো জেকব কাঠ ফাঁড়ছিল, ও পেছন ফিরতেই আমি দৌড়ে উঠোন পেরিয়ে বাড়ির পেছনের জানালার কাছে গেলাম, তারপর জানলা বেয়ে সোজা নিজের ঘরে!
আমাদের বাড়িটা এ এলাকার সবচেয়ে পুরনো বাড়ি। আমার দাদা এলিয়াস স্ট্রর্ম পঞ্চাশ বছর আগে এ বাড়ি তৈরি করেছিলেন; তারপর এত বছরে বাড়িতে অনেক ঘর যোগ হয়েছে। দাদা বাড়িটি তৈরি করেছিলেন বিশাল গাছের কান্ডের খুঁটির উপর, দেয়াল তৈরি করেছিলেন প্রাচীন যুগের মানুষের ঘরবাড়ির ধ্বংসাবশেষ থেকে ইট-পাথরে এনে। এখন বাড়ির চারপাশে আস্তাবল, শস্য রাখার ঘর, গরুর ঘর, কামলাদের ঘর এমন অনেক ঘর তৈরি করা হয়েছে। দাদা ছিলেন একজন শক্তিশালী মানুষ, প্রচন্ড ঈশ্বর ভক্ত আর সব রকম অপশক্তি বা শয়তানের বিরুদ্ধে সদা সতর্ক। তার এই ভক্তি তিনি তার ছেলে, আমার বাবা জোসেফ স্ট্রর্মের মধ্যে সঞ্চারিত করেছিলেন।
আমাদের এই এলাকার নাম ওয়াকনুক, এলাকার প্রথম বাড়ি হিসেবে আমাদের বাড়ির নামও ওয়াকনুক। শোনা যায়, অনেক অনেককাল আগে, প্রাচীন মানুষের সময়, এই জায়গার নাম ছিল ওয়াকনুক। যদিও প্রাচীন কালের সবই ধ্বংস হয়ে গেছে, কিন্তু প্রাচীন ঐতিহ্য হিসেবে আজও কিছু ঘরবাড়ির ভিত রয়ে গেছে; আর আছে বিশাল লম্বা বাঁধ, যা একেবারে পাহাড় পর্যন্ত পৌঁছেছে। কে জানে কেন, প্রাচীনকালের অমানুষিক শক্তিশালী মানুষেরা পাহাড়টাকে পর্যন্ত কেটেছিল!! প্রাচীন ওয়াকনুকের সেই শক্তিশালী মানুষদের সম্পর্কে তেমন কিছু জানা যায় না, তবে ওয়াকনুকে এখনও তাদের যেটুকু চিহ্ন আছে তা দেখে বোঝা যায় তারা আমাদের মত ছিল না।
এখনকার ওয়াকনুকে শ'খানেক পরিবার আছে, তাদের ছোট-বড় ঘরবাড়ি, জমি জমা নিয়ে।আমার বাবা এই এলাকার মানী মানুষ। ১৬ বছর বয়স থেকেই ধর্ম সম্পর্কে তার অগাধ জ্ঞান তিনি মানুষের মধ্যে প্রচার শুরু করেন। ঈশ্বরের দৃষ্টিতে কোন জিনিসটি পছন্দনীয়, পাপ থেকে বাঁচতে কি করতে হবে, এসব তিনি খুব ভালো জানতেন। কোন সৃষ্টিতে অস্বাভাবিকতা বা বিচ্যুতি আছে কিনা, এ সম্পর্কে প্রায়ই তিনি সিদ্ধান্ত দিতেন।
আমাদের বাড়িতে একটা বড় ঘর ছিল। এখানে খাওয়া-দাওয়া আর প্রার্থনা সভা হত। এই ঘরের দেয়ালে কাঠের তক্তায় নানারকম নীতিকথা লেখা থাকত। নীতিকথাগুলো এরকম:
- ঈশ্বরের প্রতিমূর্তি মানুষ।
- আমাদের প্রভুর বংশধারার বিশুদ্ধতা রক্ষা করতে হবে।
- সর্বদা উত্তম মান বজায় রাখতে হবে, বিশুদ্ধতাই আনবে মুক্তি।
- যে কোনো রকম বিকৃতি সম্পর্কে সতর্ক থাকতে হবে, বিকৃতি দেখামাত্র তা জানাতে হবে।
- বিকৃত সৃষ্টি শয়তানের সৃষ্ট।
এই কথাগুলোর সবটা আমি বুঝতে পারিনি, কিন্তু বিকৃতি কাকে বলে সেটা বুঝতাম। কারণ বিকৃতি থাকার পরিনাম প্রায়ই চাক্ষুষ দেখতে হতো। কোন কিছুর বিকৃতি ঘটলে বাবা খুবই খারাপ মেজাজে ঘরে ফিরতেন। তারপর সন্ধ্যাবেলা বাড়ির সবাইকে, এমনকি কাজের লোকদের পর্যন্ত নিয়ে প্রার্থনায় বসতেন। প্রার্থনায় আমরা অনুতাপ প্রকাশ করে ঈশ্বরের কাছে ক্ষমা চাইতাম। পরদিন ভোরে সবাই উঠোনে জমা হতাম, আর বাবা দুই মাথাওয়ালা খাসির বাচ্চা অথবা চার পাওয়ালা মুরগির বাচ্চা অথবা যাই হোক, সেটাকে জবাই করে ধ্বংস করতেন!
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে জানুয়ারি, ২০২০ দুপুর ২:৪১