আগের পর্ব: নতুন জীবন- দুই
শুধু প্রাণী না, মাঝে মাঝে ফল- ফসলেও বিকৃতি দেখা যেত। সেগুলোও বাবা ধ্বংস করতেন; কখনো কখনো এজন্য পুরো মাঠ ধরে ফসল জ্বালিয়ে দিতেন।
আমার বাবা খুব ধার্মিক ছিলেন; শষ্য বা গবাদি পশুর বিকৃতি, তা যত ছোটই হোক, তিনি সেটার কোন চিহ্ন রাখতেন না, নিজ হাতে ধ্বংস করে দিতেন। অথচ আমাদের প্রতিবেশীদের অনেকেই এমন ছোটখাট বিকৃতি ধ্বংস করতেন না, একান্তই ইন্সপেক্টর বাধ্য না করলে! বাবার হাতে নিয়মিতভাবে বিকৃতি ধ্বংস দেখতে দেখতে খুব অল্প বয়সেই আমি বুঝে গেছিলাম, বিকৃতি কাকে বলে। কোনো প্রাণী বা ফল- ফসল যদি হুবহু তার জন্মদাতার মত না হয়ে সামান্য পরিমাণও অন্যরকম হয়, তবে সেটাই বিকৃতি। আবার বিকৃতি যদি হয় মানুষের মধ্যে, তবে সেটা মানুষ নয়, তাকে বলা হয় "পাপাত্মা"...স্বাভাবিকতা থেকে যে কোন বিচ্যুতিই উদ্ভিদ বা প্রাণীকে বিকৃত বা পাপাত্মায় পরিনত করে।
ছোটখাটো বিকৃতি নিয়ে জন্মানো উদ্ভিদ আর প্রাণী এভাবে ধ্বংস করার ফলে আমাদের ওয়াকনুকে উদ্ভিদ ও প্রাণীর বিচ্যুতি ধীরে ধীরে কমে আসছিল। সেজন্য সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ক্রমশই দক্ষিণের অনাবদী ভূমি আবাদ করে এলাকার সীমানা বাড়ানো হচ্ছে। এর ফলে কিছুটা বিপদের মুখে পড়তে হচ্ছে, কারণ সীমানা বাড়ানোর সাথে সাথে প্রান্তভূমি কাছে চলে আসছে। বিপদটা কি, তা বলার আগে আমি আমাদের এলাকাটার বর্ণনা দিয়ে নেই!
আমাদের এই এলাকা এক প্রান্তবর্তী এলাকা। পূবের এলাকাগুলোর তুলনায় আমাদের এলাকায় জনসংখ্যা অনেক কম। মাত্র তিন/ চার প্রজন্ম আগে এখানে প্রথম বসতি স্থাপনের পর থেকে দ্রুত এলাকা বাড়ছে। দক্ষিণ বা দক্ষিণ-পশ্চিমে প্রায় ত্রিশ মাইল ভালো ভূমি, এরপর থেকেই পতিত ভূমি শুরু হয়, সেখানে শতকরা ৫০ ভাগ উদ্ভিদ আর প্রাণীই বিকৃত। তারপর প্রায় দশ মাইল বিস্তৃত জঙ্গল, এখানেও বিকৃতির আধিক্য। এরপরই আছে প্রান্তভূমি, আমার বাবা এই ভূমি সম্পর্কে বলেন, "যেখানে ঈশ্বরের সমস্ত নিয়মকে উল্টে দিয়ে শয়তান রাজত্ব করছে।" এই এলাকার পর শুরু পোড়া ভূমির এলাকা; পোড়া ভূমি সম্পর্কে কেউ তেমন কিছু জানেনা!! কারণ এই এলাকায় যে একবার পা রেখেছে সে আর জীবিত ফেরেনি, যে দুয়েকজন ফিরে আসতে পেরেছিল তারা কয়েকদিনের মধ্যেই মারা গেছেন...
এই প্রান্তভূমি এলাকায় থাকা মানুষেরা, যাদের দেখতে মানুষের মতো দেখতে হলেও আসলে পাপাত্মা, তারা আমাদের মাঝেমাঝেই বিপদে ফেলছে... তারা যেখানে থাকে সেখানে খাবারদাবার, গরু ঘোড়া, কাপড়চোপড়, হাঁড়ি পাতিল, কোন কিছুই পাওয়া যায় না। তাই মাঝে মাঝেই তারা এসব ছিনিয়ে নেবার জন্য অতর্কিতে কোন এলাকায় হামলা করে। আগে বছরে ৩/৪ বার এমন ছোটখাটো হামলা হত, কিন্তু আমাদের এলাকার সীমানা বেড়ে প্রান্তভূমির কাছাকাছি হওয়ার সাথে সাথে হামলা বাড়ছে, এখন এরা অনেকজন মিলে সংগঠিত ভাবে হামলা করায় অনেক ক্ষয়ক্ষতি হয়। রিগোর সরকারি দপ্তরে এ ব্যাপারে জানান হয়েছে। তারা বলেছে এতদূর থেকে তাদের পক্ষে কিছু করা সম্ভব নয় বরং আমরা যেন নিজেদের জন্য রক্ষীবাহিনী তৈরি করি! আমাদের জনসংখ্যা কম বলে আলাদা করে রক্ষীবাহিনী তৈরি করা হয়নি, কিন্তু কোন হামলার ঘটনা ঘটলেই আমাদের পুরুষেরা ক্ষেতের কাজ ফেলে রেখে হামলা ঠেকাতে ছুটে যান। এতে অনেক ক্ষতি হয়ে যায়। আমাদের ওয়াকনুকে এখন পর্যন্ত হামলা হয়নি, কিন্তু কে জানে হয়তো কোনদিন তারা এখানেও পৌঁছে যাবে...
এমনিতে আমাদের দিনগুলো কর্মব্যস্ততা আর পরিশ্রমের মধ্যে দিয়ে কাটে; দিনের শেষে আমাদের পরিবারের মানুষের সাথে আমাদের ঘরে আর ক্ষেতে কাজ করা মানুষেরা একত্রিত হই রাতের খাবারের জন্য, সবমিলে প্রায় ২০ জন মানুষ!
আমাদের পরিবার বলতে মা-বাবা, আমি, দুই বোন আর এক্সেল খালু। এই খালু আর এলিজাবেথ খালা থাকতেন বহুদূরে, রিগোতে। একবার খালু যখন জাহাজ নিয়ে সমুদ্রে ছিলেন সেসময় খালা মারা যান। কিছুদিন পর এক দুর্ঘটনায় খালু খোঁড়া হয়ে যান; তারপর থেকেই খালু আমাদের সাথেই আছেন, উনি অনেক ধরনের কাজ জানেন। মায়ের আরেক বোন হ্যারিয়েট থাকেন কেনটাক্ এলাকায়; তার স্বামীও বড় খামারী। মায়ের সৎভাই এনগাস মর্টনের খামার আমাদেরটার পাশেই, এক মাইলের বেশি আমাদের দুই খামারের সীমানা পাশাপাশি রয়েছে। বাবা এনগাস মর্টনকে দুচোখে দেখতে পারেন না, সারাক্ষণ পিছে লেগে থাকেন। রোজালিন হল এনগাস মর্টনের মেয়ে, আমার মামাতো বোন।
যদিও আমার বাবা এলাকার সবচেয়ে স্বচ্ছল এবং সমৃদ্ধ খামারি, কিন্তু আমাদের যত দরকার তত কাজের লোক ছিল না। তাই আমাকে যে যখনই ঘোরাঘুরি করতে দেখত, তখনই কোন কাজে লাগিয়ে দিত। তাই আমিও সুযোগ পেলেই লুকিয়ে থাকতাম, যেন কাজ করা না লাগে! সোফির বাসা থেকে ফিরে সেই সন্ধ্যায় আমি লুকিয়েই থাকলাম। যখন বুঝলাম উঠানে কাজের লোকজন সব একে একে ফিরে আসছে তখন বুঝলাম রাতের খাবার সময় হয়ে গেছে। আমিও লুকিয়ে বের হয়ে উঠোনে তাদের সাথে মিশে গেলাম। এরপর খাবার ঘন্টা বাজতেই আমি সবার সাথে খাবার ঘরে ঢুকলাম। দরজা থেকেই চোখে পড়ল বড় বড় করে লেখা সতর্কবাণী:
"যে কোনো রকম বিকৃতি সম্পর্কে সতর্ক থাকতে হবে, বিকৃতি দেখামাত্র তা জানাতে হবে।"
দেখলাম, কিন্তু এই সতর্কবাণী দেখে একবারও সোফির ব্যাপারে আমার মনে কোনো ভাবনা জাগল না!
৩)
সোফির সাথে আমার বেশ বন্ধুত্ব হল। আমি প্রায়ই স্কুল পালিয়ে বা দুপুরের খাবার পর মাঠের কাজে ফাঁকি দিয়ে সোফিদের বাসায় যেতাম। (স্কুল তেমন কঠোর কিছু না, আমার মত ১০/১২জন শিশুকে একজায়গায় বসিয়ে একজন মহিলা কিছু শেখাতেন) কিছুদিন পর সোফির পা যখন পুরোপুরি সেরে গেল তখন একদিন ও আমাকে ওর বাড়ির আশেপাশের এলাকা দেখাল, তারপর আমরা বসে প্রাচীন মানুষদের নিয়ে কথা বলতে।
- আমার বাবা বলেন, প্রাচীন মানুষদের সম্পর্কে যা শোনা যায় তার চার ভাগের এক ভাগ সত্যি হলেও তাদের মানুষ বলা যায় না, তারা ছিলেন জাদুকর।
- তাদের সত্যিই আশ্চর্যজনক ক্ষমতা ছিল, আমি বললাম।
- এতই আশ্চর্যজনক মানুষ হতে পারে, আমার বিশ্বাস হয়না, সোফি বলল।
- তোমার বাবা কি বিশ্বাস করেন না যে, প্রাচীন মানুষেরা উড়তে পারতো?
- না, এটাতো অবিশ্বাস্য! তারা উড়তে পারলে আমরা পারি না কেন?
আমার একবার মনে হল যে, আমার স্বপ্নে দেখা শহরের উড়ন্ত জিনিসের কথা সোফিকে বলি, কিন্তু তারপর মনে হলো বলে কি হবে! স্বপ্ন তো স্বপ্নই...
সোফির বাড়িতে ফিরে দেখি ওর বাবা জন ওয়েন্ডার চামড়া দিয়ে কিছু একটা তৈরি করছেন। সোফিকে দেখে হেসে আদর করলেন, আমার দিকে ফিরতেই উনার মুখ গম্ভীর হয়ে গেল... প্রথম যেদিন উনাকে দেখি, সেদিন উনি আমার দিকে এমন ভাবে চেয়েছিলেন যে, আমি ভয়ে কুঁকড়ে গিয়েছিলাম... অবশ্য বেশ কয়েকবছর পর আমি উনার সেই চাহনির অর্থ বুঝতে পেরেছিলাম; বুঝতে পেরেছিলাম, সোফির পায়ে ছয় আঙ্গুল আছে এটা জোসেফ স্ট্রর্মের ছেলে ডেভিড স্ট্রর্ম দেখেছে জানার পর তার মনে কি ঝড় উঠেছিল... নিশ্চয়ই সহজ সমাধান, 'মৃত বালক কোন কথা বলতে পারেনা', অনেকবার তাঁর মনে এসেছিল, .. সম্ভবত সোফির মা তাকে এটা করা থেকে নিবৃত করেছিলেন! অবশ্য কিছুদিন পর উনার সাথে আমার বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক হয়ে যায়।
সোফির সাথে প্রথম দেখার কিছুদিন পরেই এক্সেল খালু আমার আর রোজালিনের সম্পর্কে জেনে গেলেন! আমি বা রোজালিন কেউই এ নিয়ে কোন বিপদের কথা ভাবিনি, কিন্তু সহজাত প্রবৃত্তিই আমাদের সাবধানতা অবলম্বন করা শিখিয়েছিল, তাই আমাদের সম্পর্কে এর আগে কেউ জানতে পারেনি...
সেদিন আমি বড় একটা পাথরে বসে রোজালিনের সাথে কথা বলছিলাম। হঠাৎ চোখের কোণে কিছু নড়ছে টের পেয়ে তাড়াতাড়ি ফিরে তাকালাম, এক্সেল খালু লাঠিতে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন! খালু হেসে জিজ্ঞেস করলেন,
- ডেভি বাবা, কার সাথে এত গল্প করছো? পরী, নাকি খরগোশ?
আমি মাথা নাড়লাম; খালু আমার পাশে বসে ঘাসের ডাটি চিবাতে চিবাতে বললেন,
- একা লাগছে?
- না।
উনি একটু ভেবে নিয়ে বললেন,
-একা বসে নিজের সাথে কথা না বলে বন্ধুদের সাথে কথা বললে বেশি ভালো লাগতো না?
- আমিতো তাই বলছিলাম।
- কি বললে? কিছুটা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন তিনি।
- আমি রোজালিন এর সাথে কথা বলছিলাম।
উনি আমার দিকে কিছুক্ষন চুপ করে তাকিয়ে থেকে বললেন,
-কিন্তু রোজালিনকে তো দেখছি না!
- রোজালিন তো এখানে নেই! ও তো ওর বাসায়!
উনি প্রথমে বুঝতে পারলেন না আমি কি বলতে চাচ্ছি। তাই আমি তাকে ব্যাপারটা বুঝিয়ে বললাম। যখন আমি তাকে বোঝাচ্ছিলাম তখন তার মুখ গম্ভীর হয়ে যাচ্ছিল। আমার কথা শেষ হবার পর উনি জিজ্ঞেস করলেন,
- এটা কোনো ঠাট্টা না তো? তুমি কি সত্যি কথা বলছো ডেভি বাবা?
- হ্যাঁ এক্সেল খালু, সত্যি।
- একথা তুমি আগে কাউকে বলেছ?
- না, কাউকে বলিনি।
এবার তাকে বেশ নিশ্চিন্ত মনে হল। তিনি আরেকটা ঘাস নিয়ে চিবাতে চিবাতে বললেন,
-তোমাকে একটা শপথ করতে হবে!
- কি শপথ?
-তুমি আমাকে এইমাত্র যে কথা বললে, একথা তুমি আর কখনোই কাউকে বলবেনা! কেউ যেন এ নিয়ে তোমাকে কোনো সন্দেহ না করে সেটাও তোমাকে খেয়াল করতে হবে। তুমি বুঝতে পারছ না, ব্যাপারটা কতটা গুরুত্বপূর্ণ!
আমি কখনো এক্সেল খালুকে এতটা উদ্বিগ্ন ভাবে কথা বলতে দেখি নি। তাই উনি যেভাবে বললেন আমি সেভাবেই শপথ করলাম। এরপর উনি আমাকে বললেন, "ভালো হয় যদি তুমি পুরো ব্যাপারটা ভুলে যাও"!
আমি কিছুক্ষণ চিন্তা করে বললাম,
"সেটা সম্ভব না, যেমনভাবে সম্ভব নয় কথা বলা অথবা কানে শোনা ভুলে যাওয়া, তেমনি।"
উনি বললেন,"তুমি কথাগুলো তোমার মাথার ভিতরে শুনতে পাও, তাই না?"
আমি বললাম, "না ঠিক কথা শুনিনা, মাথায় কিছু আকার আসে, সেটা দেখেই আমি বুঝতে পারি।"
"কিন্তু কথার দরকার যদি নাই থাকে, তুমি কথা বলছিলে কেন?"
"কারণ তাতে আকারটা আরো স্পষ্ট হয়!"
" কিন্তু এটা তোমাদের দুজনের জন্যই খুব বিপজ্জনক হতে পারে; তোমাকে আরেকটা প্রতিজ্ঞা করতে হবে, আর কখনোই তুমি জোরে জোরে এভাবে কথা বলবে না"
এরপর উনি বললেন, রোজালিনকেও যেন আমি একই প্রতিজ্ঞা করাই।
("The Chrysalids" এর ভাবানুবাদ।)
চলবে...
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে জানুয়ারি, ২০২০ রাত ৯:২৩