
জুলাই অভ্যুত্থানের পর দেশে নতুন সরকার গঠিত হয়েছে। এই সরকার তথাকথিত রাজনৈতিক দলগুলোর মতো আচরণ করবে না বলে সবাই আশা করেছিলো। কিন্তু ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকে সরকার আজ পর্যন্ত আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তথা পুলিশের উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পারে নাই। ইন্টেরিম সরকার মনে করে দেশের সংস্কার করা জরুরি। পতিত স্বৈরাচার দেশের সকল প্রতিষ্ঠানের মেরুদণ্ড ভেঙে দিয়েছে। সেগুলোর পুন:প্রতিস্থাপন না হলে ফ্যাসিবাদের পথ বন্ধ হবে না। কিন্তু একই সাথে মাথায় রাখতে হবে দেশের আইনশৃংখলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে না পারলে শুধু সংস্কার দিয়ে মন ভরবে না জনগণের। ইন্টেরিম সরকার এই কাজটুকু ঠিক ভাবে করতে পারছে না। এমন সময়ে মোহাম্মদপুরে ঘটে গেলো এক ন্যাক্কারজনক ঘটনা। চাঁদউদ্যান নামক স্থানে পুলিশের সাথে গোলাগুলিতে একজন মারা যায়।
পুলিশের বয়ান অনুসারে, মৃত ব্যক্তি একজন সন্ত্রাসী । এরকম ঘটনা পড়লে, দেখলে বা শুনলে অতীতের স্বৈরাচারী সরকারের সময়কার কথা মনে উঠে। র্যাব ও অন্যান্য বাহিনী ক্রসফায়ারে মিথ্যা ঘটনা সাজিয়ে তথাকথিত বন্ধুক যুদ্ধে কত মানুষ হত্যা করেছে তার প্রকৃত হিসাব পাওয়া যাবে না কখনো । কিন্তু ইন্টেরিম সরকার কেন এমন বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ডের দিকে ঝুকছে ? সরকার আসলে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পুরোপুরি ব্যর্থ। এখন সে ব্যর্থতা ঢাকতে বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ড শুরু হয়েছে । একটি দেশে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও বিচার ব্যবস্থা থাকতে কেন এমন বিচার বহির্ভূত হত্যাকান্ড ঘটে ? কিছুদিন পূর্বে 'ডেভিল হান্ট' নামক অপারেশন শুরু করে সরকার যাতে তাদের হাতে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে না থাকার বিষয়টি আরো সুস্পষ্ট হয়ে উঠে।
বিগত ফ্যাসিস্ট সরকারের সময়ে ' চল যাই যুদ্ধে, মাদকের বিরুদ্ধে ' নামক অপারেশন পরিচালনা করে মাত্র ছয় মাসে দুইশত মানুষ হত্যা করা হয়েছিলো বিচার বহির্ভূতভাবে। আরো পূর্বের সময়ে ফিরে গেলে আমরা দেখতে পাবো বিএনপি-জামায়াতের (২০০১-২০০৬) সালের শাসনামলে 'অপারেশন ক্লিনহার্ট ' পরিচালনা করার সময় থানা হেফাজতে তথাকথিত হার্ট এট্যাকে ৩৫/৪০ জন মানুষ মারা গিয়েছিল। তাই অপারেশন 'ডেভিল হ্যান্টের' উদ্দেশ্য যাই থাকুক তা সরকারের একপ্রকার রাষ্ট্র পরিচালনার দূর্বলতা হিসাবে মনে করা হচ্ছে।
ইন্টেরিম সরকারের সময়ে থানা হেফাজতে আজ পর্যন্ত পাওয়া তথ্য অনুসারে বিশ জনের মতো মারা গিয়েছে। ডয়েচে ভেলে আইন ও সালিশ কেন্দ্রের থেকে প্রাপ্ত তথ্য হতে একটি প্রতিবেদন তৈরি করেছে । Click This Link । সেনাবাহিনীর হাতে যুবদল নেতার মৃত্যুর পর আবার কারা হেফাজতে নির্যাতনে মৃত্যু নিয়ে নতুন করে আলোচনা শুরু হয়েছে। ইন্টেরিম সরকার মাত্র ছয়/সাত মাস ক্ষমতায় আছে এরই মধ্যে ১৭-২০ জন মানুষ পুলিশ হেফাজতে মারা গিয়েছেন। থানা হেফাজতে মূলত বেশিরভাগই নির্যাতনের মাত্রা সহ্য করতে না পারায় ও পূর্বের শারীরিক জটিলতা থাকার কারণে মারা যান। এগুলো অত্যন্ত বর্বর ঘটনা। আসামী হেফাজতের ২০১৩ সালের আইনে স্পষ্ট বলা আছে কারা হেফাজতে থাকাকালীন সময়ে কাউকে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করা যাবে না। কিন্তু এসব আইনের সুষ্ঠু প্রয়োগ খুবই কম দেখা যায় । রাজনৈতিক দলগুলোর সরকার প্রতিহিংসার রাজনীতি করে বিধায় এমন ঘটনা বন্ধ করা কঠিন কিন্তু ইন্টেরিম সরকার কেন তা বন্ধ করতে পারছে না ? সরকারের পক্ষ থেকে কোনো যৌক্তিক ব্যাখ্যা না পেলে সরকারের মদদে এমন ঘটনা ঘটছে বলে যে কেউ সন্দেহ করবে ।
আমাদের সমাজে অপরাধীকে বিচার বহির্ভূতভাবে হত্যা করা হলে সাধারণ জনগণ খুব একটা প্রতিবাদ করতে দেখা যায় না । সাধারণ মানুষের যুক্তি হচ্ছে সে যেহেতু অপরাধী তাকে নগদে শেষ করে দেয়া হোক। এসব ক্ষেত্রে অপরাধীরা আত্নপক্ষ সমর্থনের সুযোগ পায় না। কিন্তু আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে প্রতিটি নাগরিকের সাথে রাষ্ট্রের চুক্তি রয়েছে। ন্যায় বিচার পাওয়ার অধিকার সংবিধানে উল্লেখ রয়েছে। সকল প্রমাণাদি, ভিডিও ফুটেজ থাকলেও একজন অপরাধীকে বিচারের পূর্বে হত্যা সভ্য সমাজে চলতে পারে না। এতে একটি রাষ্ট্র কখনো সবার জন্য ভরসাস্থল হয়ে উঠতে পারে না।
বেশ কিছু বছর পূর্বে বগুড়ায় রিফাত হত্যাকান্ডের প্রধান আসামী নয়ন বন্ডকে আটকের দুইদিন পর ক্রসফায়ারে হত্যা করা হয়। নয়ন বন্ডের অপরাধের সকল ভিডিও ফুটেজ যথেষ্ট ছিলো তাকে দোষী সাব্যস্ত করতে। কিন্তু নয়ন বন্ড যত বড়ো ক্রিমিনাল হোক তার বিচার কেবল মাত্র আদালতের বিচারিক প্রক্রিয়ায় হতে হবে। রিফাত হত্যায় নয়নের সাথে যারা ছিলো তাদের ক্রসে দেওয়া হয়নি। নয়নের পরিবার বিত্তবান ছিলো না। তাই হয়তো টাকা পয়সা দিয়ে ক্রসথেকে মুক্ত হতে পারেনি। যদি আসলেই দেশের সংস্কার করার সদিচ্ছা এই সরকারের থেকে থাকে তবে বিচার বহির্ভূত হত্যাকান্ডের বিরুদ্ধে তদন্ত করা উচিত। অন্যথায় বর্তমান সরকার বিগত সরকার গুলোর মতো সুশাসন, সাম্য ও ন্যায্যতা সমাজে প্রতিষ্ঠা করতে ব্যর্থ হবে।
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ রাত ১০:৪৪

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



