somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

কালো জাদু, নাকি সিজোফ্রেনিয়া: তানিন সুবহার মৃত্যু এবং এক কুসংস্কারচ্ছন্ন সমাজের আয়নাবাজি !

১১ ই জুন, ২০২৫ রাত ৯:৪৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


যদি প্রশ্ন করি, "আপনি কি কখনো এমনটা অনুভব করেছেন—কেউ যেন আপনাকে অনুসরণ করছে, অথচ পেছনে ফিরে তাকালে কেউ নেই ? কখনো কি শুনেছেন কোনো অদ্ভুত কণ্ঠস্বর, অথচ চারপাশে নেমে এসেছে নিস্তব্ধতা? কিংবা এমন কিছু দেখেছেন বা অনুভব করেছেন যা কোনো যুক্তি দিয়ে ব্যাখ্যা করা অসম্ভব?" যদি উত্তর হয় 'হ্যাঁ', তাহলে আপনি হয়তো এমন এক রহস্যময় শক্তির প্রভাবে রয়েছেন, যাকে আমরা চিনি “কালো জাদু” নামে—হাজার বছর ধরে মানবজাতিকে ভীত ও বিভ্রান্ত করে আসা এক অদৃশ্য শক্তি। অথচ, এর বৈজ্ঞানিক নামটাও আমরা মুখে আনতে কুণ্ঠাবোধ করি।

দীর্ঘ আট দিন হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) থাকার পর গত ১০ই জুন সন্ধ্যায় না ফেরার দেশে পাড়ি জমান চিত্রনায়িকা তানিন সুবহা। মাত্র ৩০ বছর বয়সে তার এই আকস্মিক প্রয়াণ গোটা সংস্কৃতি অঙ্গনে শোকের ছায়া ফেলেছে। কিন্তু এই মৃত্যুর পেছনে কি শুধু শারীরিক অসুস্থতা ছিল, নাকি আরও গভীরে লুকিয়ে ছিল এক নিদারুণ সামাজিক ও মানসিক ট্র্যাজেডি? তানিনের মৃত্যুর পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নতুন করে আলোচনায় এসেছে তার একটি ফেসবুক পোস্ট। ১৯শে মে, অর্থাৎ অসুস্থ হওয়ার কিছুদিন আগে, তানিন লিখেছিলেন:

"কোনোদিন আমি তাবিজ বা কুফরিতে বিশ্বাস করতাম না। এখন করি। সুস্থ একটা মানুষকে এভাবে মেরে ফেলার চেষ্টা করে কি লাভ? ঘরের আনাচে কানাচে কত কি যে পেলাম। কেন এমন করছেন! আমি তো কারো ক্ষতি করিনি। লাস্ট ৪ মাস ধরে শুধু অসুস্থ আর অসুস্থ আমি। এসব এর ফল পাবেন চিন্তা কইরেন না। আল্লাহ ছাড় দেয় কিন্তু ছেড়ে দেয় না।" এই পোস্টের কয়েকটি বাক্যই আমাদের চোখ খুলে দিতে পারে, যদি আমরা একটু গভীরে দেখার চেষ্টা করি। "ঘরের আনাচে কানাচে কত কি যে পেলাম," "সুস্থ একটা মানুষকে এভাবে মেরে ফেলার চেষ্টা," "লাস্ট ৪ মাস ধরে শুধু অসুস্থ"—এগুলো কি নিছকই মনের ভুল ছিল? নাকি এক তীব্র মানসিক যন্ত্রণার বহিঃপ্রকাশ?

তানিনের কাছের মানুষদের ভাষ্যমতে, তিনি প্রায়শই বলতেন, "আমার মাথার ভেতর কথা বলা হয়," বা "কেউ আমাকে অনুসরণ করছে, আমার ক্ষতি করতে চাইছে।" এই কথাগুলো শুনলে আমাদের সমাজ দ্রুত দুটি সিদ্ধান্তে আসে: ক. তাকে জিন ধরেছে, বা খ. তার ওপর কালো জাদু করা হয়েছে। এরপর শুরু হয় ঝাঁড়ফুঁক, তাবিজ-কবজ, এবং ধর্মীয় নিরাময়ের নামে এক ভয়াবহ প্রহসন।

কিন্তু বিজ্ঞান কী বলে? মনোবিজ্ঞানীরা এই ধরনের লক্ষণকে হ্যালুসিনেশন (Hallucination) এবং ডেলুশন (Delusion) হিসেবে চিহ্নিত করেন। যখন একজন ব্যক্তি এমন কিছু শোনে বা দেখে যা বাস্তবে নেই (যেমন মাথার ভেতর কণ্ঠস্বর শোনা), তাকে বলা হয় হ্যালুসিনেশন। আর যখন কেউ এমন কিছু বিশ্বাস করে যার কোনো বাস্তব ভিত্তি নেই (যেমন কেউ তার ক্ষতি করতে চাইছে, বা তার ওপর জাদু করা হয়েছে), তাকে বলা হয় ডেলুশন। এই দুটি উপসর্গই সিজোফ্রেনিয়া (Schizophrenia) নামক একটি জটিল মানসিক রোগের মূল লক্ষণ।

সিজোফ্রেনিয়া ব্রেনের একটি রোগ, যেখানে মস্তিষ্কের নিউরোকেমিক্যালস, বিশেষ করে ডোপামিন এবং সেরোটোনিনের ভারসাম্যহীনতা দেখা দেয়। এটি সাধারণত কৈশোর বা তরুণ বয়সে (২০-৩০ বছর) শুরু হয় এবং মানসিক চাপ বা ট্রমা এর উপসর্গগুলোকে ট্রিগার করতে পারে। তানিনের কথাগুলো পর্যালোচনা করলে মনে হয়, তিনি হয়তো সিজোফেক্টিভ ডিসঅর্ডার বা সিজোফ্রেনিয়া-র মতো কোনো গুরুতর মানসিক রোগে ভুগছিলেন। তার "ব্রেইনে বান দেওয়া হয়েছে" বা "মাথার ভেতর কথা বলা হয়"—এগুলো পার্সিকিউটরি ডেলুশন এবং অডিটরি হ্যালুসিনেশনের স্পষ্ট ইঙ্গিত।

যখন ২রা জুন তানিন হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন, তখন তাকে আফতাবনগরের একটি ক্লিনিকে নেওয়া হয়। প্রাথমিক ভুল চিকিৎসায় তাকে গ্যাস্ট্রিকের ওষুধ দেওয়া হয়। কিন্তু সন্ধ্যার মধ্যে তার অবস্থার চরম অবনতি ঘটে, যা ইঙ্গিত দেয় যে এটি নিছক গ্যাস্ট্রিক ছিল না, বরং আরও গুরুতর কোনো শারীরিক জটিলতা ছিল, যা হয়তো মস্তিষ্কের চলমান চাপ ও রোগের ফলাফল। জানা যায়, তানিনের দুটি কিডনি প্রায় অকেজো ছিল এবং শারীরিক অবস্থার অবনতি থেকে তার স্ট্রোক হয়, যার ফলে ব্রেইনের কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। অথচ এই কিডনি সমস্যা বা ব্রেইন স্ট্রোকের পেছনে দীর্ঘদিনের মানসিক চাপ, অযত্ন, এবং ভুল চিকিৎসা কতটা দায়ী ছিল, তা প্রশ্নসাপেক্ষ। এখানেই আমাদের সমাজের নিস্পৃহতা প্রকট হয়ে ওঠে। যখন একজন মানুষ "মানসিক যন্ত্রণায়" ভোগে, তখন তাকে চিকিৎসার বদলে কুসংস্কার আর অন্ধবিশ্বাসের কূপে ঠেলে দেওয়া হয়।

পরিবারগুলো মানসিক রোগের চিকিৎসা নিতে ভয় পায়, কারণ "পাগল" উপাধি পাওয়ার ভয় থাকে। সমাজ মানসিক স্বাস্থ্যকে একটি ট্যাবু হিসেবে দেখে, যেখানে বিষণ্ণতা, উদ্বেগ বা সাইকোসিসকে দুর্বল ঈমান বা 'জিন-ভূতের আছর' বলে ব্যাখ্যা করা হয়। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কে কোনো প্রাথমিক ধারণা দেয় না। আর আমরা, যারা এই সবকিছু দেখি কিন্তু কিছু করি না, তারাও এই ব্যর্থতার সমান অংশীদার।

মাত্র ১৪ বছর বয়সে বিয়ে, সন্তানের দায়িত্ব, দ্বিতীয় সংসার, এবং এর মধ্যে শোবিজ অঙ্গনে কাজ—এ সবকিছুই তানিনকে মানসিকভাবে প্রচণ্ড চাপ দিচ্ছিল। গ্ল্যামার আর আলোর ঝলকানির আড়ালে যে মানসিক চাপ এবং একাকীত্ব লুকিয়ে থাকে, তা আমরা ক'জনই বা উপলব্ধি করি? একজন সেলিব্রিটি যখন মানসিক রোগে ভোগেন, তখন তার পাশে সঠিক চিকিৎসকের চেয়ে কুসংস্কারাচ্ছন্ন মানুষের ভিড় বেশি হয়। তানিন সুবহার মৃত্যুর পেছনে হয়তো এই নীরব পতনও দায়ী।

তানিন সুবহার মৃত্যু কেবল একটি ব্যক্তিগত ট্র্যাজেডি নয়, এটি আমাদের সমাজের সম্মিলিত ব্যর্থতার এক জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত। যখন একজন মানুষ "আমার মাথার মধ্যে শব্দ হয়" বলে চিৎকার করে, তখন তাকে ওঝার কাছে না পাঠিয়ে একজন মনোরোগ বিশেষজ্ঞের কাছে নিয়ে যাওয়া উচিত ছিল। যখন সে মানসিক যন্ত্রণায় ভোগে, তখন তাকে সহানুভূতির হাত বাড়িয়ে বলা উচিত ছিল, "তুমি একা নও, এটা চিকিৎসাযোগ্য।"

তানিনের এই অকাল প্রয়াণ আমাদের মনে করিয়ে দেয়: মানসিক স্বাস্থ্য কোনো বিলাসিতা নয়, এটি জীবনের একটি অপরিহার্য অংশ। আসুন, এই ট্র্যাজেডি থেকে শিক্ষা নিই। চারপাশে যারা মানসিক যন্ত্রণায় ভুগছেন, তাদের প্রতি সংবেদনশীল হই। কুসংস্কারের অন্ধকার থেকে বেরিয়ে এসে বিজ্ঞানের আলোয় আলোকিত হই। তানিনের মতো আর কারো পরিণতি না হোক । তার মৃত্যু হোক মানসিক স্বাস্থ্য সচেতনতার এক নতুন পথের সূচনা।

সর্বশেষ এডিট : ১১ ই জুন, ২০২৫ রাত ৯:৫৬
৪৫টি মন্তব্য ২৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

Grameen Phone স্পষ্ট ভাবেই ভারত প্রেমী হয়ে উঠেছে

লিখেছেন অপলক , ১৮ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ২:৪৯



গত কয়েক মাসে GP বহু বাংলাদেশী অভিজ্ঞ কর্মীদের ছাটায় করেছে। GP র মেইন ব্রাঞ্চে প্রায় ১১৮০জন কর্মচারী আছেন যার ভেতরে ৭১৯ জন ভারতীয়। বলা যায়, GP এখন পুরোদস্তুর ভারতীয়।

কারনে... ...বাকিটুকু পড়ুন

কম্বলটা যেনো উষ্ণ হায়

লিখেছেন আলমগীর সরকার লিটন, ১৮ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৩:৫৭


এখন কবিতার সময় কঠিন মুহূর্ত-
এতো কবিতা এসে ছুঁয়ে যায় যায় ভাব
তবু কবির অনুরাগ বড়- কঠিন চোখ;
কলম খাতাতে আলিঙ্গন শোকাহত-
জল শূন্য উঠন বরাবর স্মৃতির রাস্তায়
বাঁধ ভেঙ্গে হেসে ওঠে, আলোকিত সূর্য;
অথচ শীতের... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইউনুস সাহেবকে আরো পা্ঁচ বছর ক্ষমতায় দেখতে চাই।

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ১৯ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১:৪৪


আইনশৃংখলা পরিস্থিতির অবনতি পুরো ১৫ মাস ধরেই ছিলো। মব করে মানুষ হত্যা, গুলি করে হত্যা, পিটিয়ে মারা, লুট হওয়া অস্ত্র উদ্ধার করতে না পারা, পুলিশকে দূর্বল করে রাখা এবং... ...বাকিটুকু পড়ুন

হাদির যাত্রা কবরে, খুনি হাসছে ভারতে...

লিখেছেন নতুন নকিব, ১৯ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৬

হাদির যাত্রা কবরে, খুনি হাসছে ভারতে...

শহীদ ওসমান বিন হাদি, ছবি অন্তর্জাল থেকে নেওয়া।

হ্যাঁ, সত্যিই, হাদির চিরবিদায় নিয়ে চলে যাওয়ার এই মুহূর্তটিতেই তার খুনি কিন্তু হেসে যাচ্ছে ভারতে। ক্রমাগত হাসি।... ...বাকিটুকু পড়ুন

হাদিকে মারল কারা এবং ক্রোধের আক্রশের শিকার কারা ?

লিখেছেন এ আর ১৫, ১৯ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১০:০৩

হাদিকে মারল কারা এবং ক্রোধের আক্রশের শিকার কারা ?


হাদিকে মারল জামাত/শিবির, খুনি নাকি ছাত্রলীগের লুংগির নীচে থাকা শিবির ক্যাডার, ডাকাতি করছিল ছেড়ে আনলো জামাতি আইনজীবি , কয়েকদিন হাদির সাথে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×