
"ভারতে নিরাপদে পৌঁছে দেওয়া হবে"—এই মিথ্যা আশ্বাসে ভরসা দিয়ে ৪৩৭ জন নিরীহ মানুষ সেদিন ট্রেনে উঠেছিলেন। কিন্তু গন্তব্য হয়েছিল মৃত্যু। ১৯৭১ সালের ১৩ জুন, নীলফামারীর গোলাহাটে রেললাইন আর কালভার্ট লাল হয়ে গিয়েছিল রক্তে।
নীলফামারীর সৈয়দপুরে দশকের পর দশক ধরে বাস করতেন মাড়োয়ারিরা—ভারতের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা হিন্দু ব্যবসায়ী পরিবার। ১৯৪৭-এর দেশভাগের আগেই তারা এখানে পাকাপোক্তভাবে বসবাস শুরু করেছিলেন। কিন্তু ’৭১-এর মার্চে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও তাদের দোসর বিহারিদের তাণ্ডব শুরু হলে আতঙ্কে কাটে তাদের দিন।
২৩ মার্চ রাত থেকেই সৈয়দপুরে বাঙালি নিধন শুরু হয়। নেতৃস্থানীয় বাঙালিদের টার্গেট করে হত্যা করা হয়। এদিকে, মাড়োয়ারিপট্টির বাসিন্দারা ঘরবন্দি। ১২ এপ্রিল, পাকিস্তানি সেনারা মাড়োয়ারি নেতা তুলসীরাম আগরওয়ালা,যমুনাপ্রসাদ কেডিয়া ও রামেশ্বর লাল আগরওয়ালাকে নিসবেতগঞ্জ বধ্যভূমিতে নিয়ে হত্যা করে। বিহারিরা তখন মাড়োয়ারিদের বাড়িতে চালায় লুটপাট।
জুনের ৫ তারিখ ,পাকিস্তানি বাহিনী মাইকে ঘোষণা দেয় "হিন্দু মাড়োয়ারিদের জন্য বিশেষ ট্রেনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। ১৩ জুন তারা নিরাপদে ভারতে পৌঁছে দেওয়া হবে।" আশায় বুক বেঁধে সেদিন সকালে ৪৩৭ জন মাড়োয়ারি সৈয়দপুর স্টেশনে জড়ো হন। ট্রেনের চারটি বগি ঠাসাঠাসি করে ভরে যায় মানুষে।
সকাল ১০টায় ট্রেন ছাড়ে। কিন্তু মাত্র দুই মাইল দূরে গোলাহাটে এসে তা থামে। ট্রেন ঘিরে ফেলে পাকিস্তানি সেনা ও বিহারিরা। রাইফেল আর রামদা হাতে তারা বগিতে ঢুকে পড়ে। শুরু হয় নৃশংস হত্যাকাণ্ড। শিশু, নারী, বৃদ্ধ—কাউকেই রেহাই দেওয়া হয়নি। লাশের পর লাশ রেললাইনে ছড়িয়ে পড়ে। রক্তে রঞ্জিত হয় গোলাহাটের কালভার্ট।
যারা বেঁচে গিয়েছিলেন তাদের জবানি: তপন কুমার দাস (প্রত্যক্ষদর্শী):"বিহারিরা রামদা দিয়ে কুপিয়ে মারছিল। অনেকে গুলি চেয়েও পায়নি—বলেছিল,'একটা গুলির দাম বেশি ! 'আমি ১৫ ফুট নিচে লাফ দিয়ে পালিয়েছিলাম।" গোবিন্দ চন্দ্র দাস:"পাকিস্তানি সেনারা চিৎকার করে বলছিল, 'একজন করে নেমে আসো। আমরা মারতে এসেছি !'
এই হত্যাকাণ্ড পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর "অপারেশন খরচাখাতা" নামক অভিযানের অংশ ছিল। তাদের লক্ষ্য ছিল সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে নির্মূল করা। গোলাহাটের সেই দিনটি বাংলাদেশের ইতিহাসে এক কলঙ্কিত অধ্যায়।
আজ ১৩ জুন, গোলাহাট গণহত্যা দিবস। শহীদদের স্মৃতির প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা। তাদের রক্তে লেখা এই ইতিহাস মানুষ ভুলবে না।
সংগ্রহীত
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই জুন, ২০২৫ রাত ৮:৪১

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




