somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ড. ইউনুসের লন্ডন সফরকে কি সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ বলা যায় ?

১৬ ই জুন, ২০২৫ রাত ১২:৪৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


বিগত দশ মাসে ইন্টেরিম সরকারের প্রধান উপদেষ্টা একাধিক আন্তর্জাতিক সফর সম্পন্ন করলেও, এর মধ্যে লন্ডন সফরটি ছিলো সবচেয়ে আলোচিত, সবচেয়ে রহস্যাবৃত এবং একইসাথে কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ। অথচ এই সফরের প্রকৃত উদ্দেশ্য সম্পর্কে ইন্টেরিম সরকারের পক্ষ থেকে কোনো স্পষ্ট ব্যাখ্যা প্রদান না করায়, একটি পলাতক রাজনৈতিক দলের প্রোপাগাণ্ডা আরও প্রবল হয়ে ওঠে। পরিস্থিতি জটিলতর হয় যখন যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ না হওয়ার গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়ে।

আরও বিতর্ক জন্ম নেয় প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিবের অসংলগ্ন ও দ্ব্যর্থপূর্ণ বক্তব্যে। জনমনে প্রশ্ন দেখা দেয়—এই সফর কি ছিলো ব্যক্তিগত? নাকি এটি ছিলো রাষ্ট্রীয় প্রতিনিধিত্বের অংশ? তবে বিতর্ক যখন চূড়ান্তে, তখনই উঠে আসে তারেক রহমানের সাথে প্রধান উপদেষ্টার একটি ‘ বৈঠক’-এর খবর। অদ্ভুতভাবে, সেই বৈঠকের পর রাজনৈতিক উত্তেজনার পারদ কিছুটা নিম্নগামী হয়। ফলে অনেকেই ধরে নেন, ইন্টেরিম সরকার ও বিএনপির মধ্যে একটি প্রাথমিক সমঝোতায় পৌঁছানো গেছে—যা অন্তত নির্বাচনের পরিবেশ তৈরিতে একটি ছায়াতলে আশ্বাস তৈরি করে।

২০২৩ সালের সেপ্টেম্বর মাস। বিশ্ব রাজনীতির টানাপোড়েনে বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থান ও ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্ব এক নতুন মোড়ে এসে দাঁড়ায়। ঠিক সেই সময়েই বাংলাদেশ সফরে আসেন ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ। একদিকে শেখ হাসিনার সরকারের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কে ভাঙন, অন্যদিকে ইউরোপের সঙ্গে সম্পর্ক পুনঃনির্মাণের চেষ্টা। এই প্রেক্ষাপটে ম্যাক্রোঁর সফর হয়ে ওঠে এক কূটনৈতিক ইঙ্গিতবাহী ঘটনাক্রম। ফ্রান্স ও বাংলাদেশ মধ্যে দুটি গুরুত্বপূর্ণ সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়। একটি ছিলো দশটি Airbus A350 কেনা সংক্রান্ত এবং অন্যটি বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-২ প্রকল্পে ফরাসি সহায়তা। বিমান কেনা—এই শব্দটি শুনতে যতই নিরীহ মনে হোক, এর পেছনে জড়িয়ে থাকে কর্পোরেট লবিং, কূটনৈতিক কড়চা, এবং বহুজাতিক স্বার্থের জটিল ছক।

Airbus—বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম বাণিজ্যিক বিমান নির্মাতা। তাদের নাম যেমন উদ্ভাবনের প্রতীক, তেমনি দুর্নীতির ইতিহাসেও বারবার উচ্চারিত হয়েছে। ২০১৭ সালে ব্রিটেন ও ফ্রান্স একযোগে Airbus-এর বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করে। প্রকাশ্যে আসে ২৫ বছর ধরে ২০টিরও বেশি দেশে মিডলম্যান ও ছদ্মপরিচয়ধারী কনসালট্যান্টদের মাধ্যমে কোটি কোটি ইউরোর ঘুষ বিতরণের কাহিনি। ২০২০ সালে Airbus-কে যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স ও ব্রিটেন সম্মিলিতভাবে প্রায় ৪ বিলিয়ন ডলার জরিমানা করে—যা বাণিজ্যিক ইতিহাসে অন্যতম বৃহৎ দুর্নীতির নিষ্পত্তি। এই প্রতিষ্ঠান যখন ফরাসি প্রেসিডেন্টের সফরসঙ্গী হয়ে ঢাকায় আসে, তখনই রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মনে প্রশ্ন জাগে—এটি কি কেবল একটি সফর, না কি এক সুপরিকল্পিত করপোরেট কূটনীতি?

বিমান বাংলাদেশ প্রথমবারের মতো Boeing-এর পরিবর্তে Airbus-এর দিকে ঝুঁকছে—এমন ঘোষণা আসে ২০২৩ সালে। যুক্তরাজ্যের Export Finance এর মাধ্যমে ৮৫% ঋণ সহায়তায় প্রস্তুত হয় চুক্তির খসড়া। তবে ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে বিমান বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষের টেকনিক্যাল ও ফিনান্সিয়াল কমিটি জানায়—এই চুক্তি দেশের জন্য আর্থিক ও কারিগরি দিক থেকে আত্মঘাতী। Airbus-এর A350 ফ্লিটের জন্য নতুন ক্রু, মেইনটেন্যান্স সুবিধা, ট্রেনিং, এমনকি যন্ত্রাংশের জন্য আলাদা অবকাঠামো গড়ে তুলতে হবে। ‘Mixed Fleet Penalty’-এর কারণে ২৫ বছরে ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়াবে ৪৪৩০ কোটি টাকা।

এই প্রতিবেদন ছড়িয়ে পড়লে একাধিক সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়, “বিমান কিনতে গিয়ে কেলেঙ্কারি”, “প্রশাসনের দ্বিমত” ইত্যাদি। কিন্তু তিন মাসের মধ্যেই গঠিত হয় একটি নতুন কমিটি, যারা দাবি করে, A350 দিয়ে যদি নির্দিষ্ট কিছু আন্তর্জাতিক রুটে ৯২% আসন পূর্ণ থাকে, তবে ১৩৫ মিলিয়ন ডলার লাভ হতে পারে। কিন্তু এই দাবির পেছনে কোনো বাস্তবভিত্তিক ট্র্যাক রেকর্ড নেই। বিমান বাংলাদেশের গড় ক্যাবিন ফ্যাক্টর কখনোই ৬০–৭০% এর বেশি যায় না। ফলে দ্বিতীয় কমিটির হিসাব ছিলো আদতে একটি লিপ্সাসিক্ত অনুমাননির্ভর চিত্র।

ফ্রান্সের রাষ্ট্রপতি ম্যাক্রোঁর সফরের নেপথ্যে থাকা এয়ারবাস কূটনীতি এবং সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রী আরাফাতের সক্রিয় ভূমিকা অনেকের দৃষ্টিগোচর হয়। অভিযোগ উঠে—ফ্রান্সের রাষ্ট্রদূত মাসদুপুয়েই'র সঙ্গে শেখ হাসিনা সরকারের সম্পর্ক এতটাই সৌহার্দ্যপূর্ণ ছিলো যে, ফ্রান্স একপ্রকার ‘নিওকোলোনিয়াল’ মডেলে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে ঢুকে পড়েছিলো। বিশেষজ্ঞদের মতে, শেখ হাসিনা ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতি ‘নরম মনোভাব’ দেখিয়ে পশ্চিমা অনুমোদন অর্জনের কৌশল নিয়েছিলেন। ফ্রান্সও চায় ইউরোপীয় নেতৃত্বে নিজেদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে। তাই এশিয়ায় নিজেদের স্বতন্ত্র বলয় গড়তে বাংলাদেশ ছিলো তাদের এক কৌশলগত ‘ফুটপ্রিন্ট’।

ফ্রান্স সফরের আগেই শেখ হাসিনা সরকার ক্ষমতা হারায়। কিন্তু ফরাসি দূতাবাস যে এই চুক্তির ধারা ধরে রাখতে ইন্টেরিম সরকারের সাথেও যোগাযোগ রাখছে, তা বলাই যায়। এই প্রেক্ষাপটেই সামনে আসে ইন্টেরিম প্রধানের লন্ডন সফর। রাষ্ট্রীয় সফরের রূপ না থাকলেও সফরের গুরুত্ব ছিলো স্পষ্ট। প্রধান উপদেষ্টা ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা না করলেও এয়ারবাসের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার সঙ্গে তার বৈঠক হয়। এই বৈঠকেই তিনি বাংলাদেশের অর্থনৈতিক বাস্তবতা ও চুক্তি পুনর্মূল্যায়নের প্রস্তাব দেন । এই বৈঠক কি কেবলমাত্র একটি করপোরেট বিষয় ছিলো? নাকি বোয়িং-এর স্বার্থও সেখানে পরোক্ষভাবে প্রতিনিধিত্ব পেয়েছিলো? এই প্রশ্ন এখনো উন্মুক্ত।

ব্রিটেনের পক্ষ থেকে সদ্য ঘোষিত সহায়তা কমানোর ঘোষণা—লন্ডন সফরের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া কি না, তা নিয়ে বিতর্ক চলছেই। অনেকে মনে করছেন, Airbus চুক্তি নিয়ে অনিশ্চয়তা, ইন্টেরিম সরকারের মনোভাব ও রাজনৈতিক অবস্থান—সব মিলিয়ে পশ্চিমা বিশ্ব নতুন করে তাদের হিসাব-নিকাশ করছে। তবে যা স্পষ্ট, তা হলো—এই সফর আর পাঁচটি অনুদান-সহায়তা চাও্য়ার সফর ছিলো না। এটি ছিলো এক অন্তরালের কূটনৈতিক সফর, যেখানে এয়ারবাস চুক্তি, ক্ষমতার ভবিষ্যৎ হিসাব, এবং আন্তর্জাতিক ভারসাম্যের একটি সূক্ষ্ম সমীকরণ একসাথে হাজির হয়েছিলো।

সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই জুন, ২০২৫ সকাল ৯:৪৪
৪টি মন্তব্য ৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

হাদির হত্যাকান্ড ও সরকারের পরবর্তি করণীয়!

লিখেছেন আহলান, ১৯ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৪:৫১

হাদির প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা। সে দেশকে ভালোবেসে, দেশের মানুষকে ইনসাফের জীবন এনে দিতে সংগ্রাম করেছে। তাকে বাঁচতে দিলো না খুনিরা। অনেক দিন ধরেই তাকে ফোনে জীবন নাশের হুমকি দিয়ে এসেছে... ...বাকিটুকু পড়ুন

মব রাজ্যে উত্তেজনা: হাদির মৃত্যুতে রাজনৈতিক পরিস্থিতি অগ্নিগর্ভ

লিখেছেন কলিমুদ্দি দফাদার, ১৯ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ সন্ধ্যা ৬:৪২

রোম যখন পুড়ছিল নিরো নাকি তখন বাঁশি বাজাচ্ছিল; গতরাতের ঘটনায় ইউনুস কে কি বাংলার নিরো বলা যায়?



বাংলাদেশ প্রেক্ষাপটে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পদটি সবসময় ছিল চ্যালেঞ্জিং।‌ "আল্লাহর... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইন্টেরিম সরকারের শেষদিন : গঠিত হতে যাচ্ছে বিপ্লবী সরকার ?

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ২০ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১২:২২


ইরাক, লিবিয়া ও সিরিয়াকে ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত করার আন্তঃদেশীয় প্রকল্পটা সফল হতে অনেক দিন লেগে গিয়েছিল। বাংলাদেশে সে তুলনায় সংশ্লিষ্ট শক্তিসমূহের সফলতা স্বল্প সময়ে অনেক ভালো। এটা বিস্ময়কর ব্যাপার, ‘রাষ্ট্র’... ...বাকিটুকু পড়ুন

মব সন্ত্রাস, আগুন ও ব্লাসফেমি: হেরে যাচ্ছে বাংলাদেশ?

লিখেছেন শ্রাবণধারা, ২০ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৩:৫২


ময়মনসিংহে হিন্দু সম্প্রদায়ের একজন মানুষকে ধর্মীয় কটূক্তির অভিযোগে পুড়িয়ে মারা হয়েছে। মধ্যযুগীয় এই ঘটনা এই বার্তা দেয় যে, জঙ্গিরা মবতন্ত্রের মাধ্যমে ব্লাসফেমি ও শরিয়া কার্যকর করে ফেলেছে। এখন তারই... ...বাকিটুকু পড়ুন

তৌহিদি জনতার নামে মব সন্ত্রাস

লিখেছেন কিরকুট, ২০ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১১:৫৪




ছবিঃ অনলাইন থেকে সংগৃহীত।


দেশের বিভিন্ন স্থানে সাম্প্রতিক সময়ে ধর্মের নাম ব্যবহার করে সংঘটিত দলবদ্ধ সহিংসতার ঘটনা নতুন করে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। বিশেষ করে তৌহিদি জনতা পরিচয়ে সংঘবদ্ধ হয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×