somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

খামেনিকে হত্যা করা হলে ইরানে গৃহযুদ্ধ লেগে যাবে ।

১৯ শে জুন, ২০২৫ সন্ধ্যা ৬:৩৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


খামেনেইকে হত্যা করা ইজরায়েলের অভিযানের অন্যতম লক্ষ্য : স্পষ্ট করলেন নেতানিয়াহুর প্রতিরক্ষামন্ত্রী ।

ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনির মৃত্যু দেশটির জন্য কেবলমাত্র একটি নেতৃত্ব পরিবর্তনের প্রশ্ন নয়—বরং এটি হতে পারে এমন এক ভূমিকম্প, যার কম্পন কেবল তেহরান নয়, গোটা মধ্যপ্রাচ্য ও বিশ্ব রাজনীতিকে নাড়িয়ে দিতে পারে। ইরান নামক রাষ্ট্রের মেরুদণ্ড হিসেবে যে নামটি গত তিন দশক ধরে শাসনযন্ত্রের প্রতিটি শিরা-উপশিরায় রাজত্ব করেছে, তার নাম আয়াতুল্লাহ আলি খামেনি। ১৯৮৯ সালে খোমেইনির মৃত্যুর পর থেকে এই শীর্ষস্থানীয় ধর্মীয় নেতা রাষ্ট্রক্ষমতার সব কক্ষপথে রাজত্ব করেছেন। বিচার বিভাগ থেকে শুরু করে সেনাবাহিনী, গোয়েন্দা সংস্থা, জাতীয় সম্প্রচারমাধ্যম, এমনকি ইরানের অর্থনৈতিক কাঠামোর গভীরতম স্তর পর্যন্ত তাঁর নজরদারির বাইরে কিছুই ছিল না।

তাঁর মৃত্যু মানে কেবল নেতৃত্বের অনুপস্থিতি নয়—এটি ইরানের শাসনতান্ত্রিক দর্শনের প্রাণভোমরা “ওয়েলায়াতে ফকিহ” (আধ্যাত্মিক নেতৃত্বের আধিপত্য) ব্যবস্থার অস্তিত্বকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে তোলে। বর্তমান তরুণ প্রজন্ম, যারা প্রায়ই পরস্পরবিরোধী ও রাজনৈতিকভাবে অস্থির শিয়াপন্থী আদর্শে বিতৃষ্ণ, তাদের চোখে এই দর্শন এখন শুধুই চাপিয়ে দেওয়া একটি নিপীড়ন কাঠামো। অথচ, এই নেতৃত্বহীন মুহূর্তে খামেনির উত্তরসূরি নির্বাচনের দায়িত্ব যাদের হাতে—তারা 'খবরগান-ই-রাহবারি' নামক ৮৮ জন আলেম, যারা সরাসরি জনগণের দ্বারা নির্বাচিত নন, বরং রাজনৈতিকভাবে ছাঁকনিপদ্ধতিতে বাছাই করা। ফলে এই নির্বাচন ধর্মীয় আড়ালে একটি রাজনৈতিক খেলা মাত্র।

অন্যদিকে, ইরানের সবচেয়ে ভয়ংকর শক্তি সম্ভবত সে দেশের সশস্ত্র বাহিনী নয়, বরং Islamic Revolutionary Guard Corps বা IRGC—যাদের জন্ম ১৯৭৯ সালের ইসলামি বিপ্লব রক্ষার জন্য হলেও এখন তারাই এক সমান্তরাল রাষ্ট্রের রূপ নিয়েছে। ক্ষেপণাস্ত্র, পারমাণবিক প্রযুক্তি, বিদেশে প্রক্সি মিলিশিয়া, কালোবাজার, মুদ্রা পাচার, এমনকি সংস্কৃতি নিয়ন্ত্রণ পর্যন্ত তাদের হাতে। IRGC নিজেই এখন একটি "Deep State"—এমন এক বলয়, যা রাষ্ট্রের চেয়েও বেশি ক্ষমতাবান।

যদি এই IRGC-র মধ্যে ফাটল ধরে—জাতীয়তাবাদী অংশ ও ধর্মীয় আনুগত্যবাদীদের মধ্যে বিভাজন হয়—তবে গোটা ইরানি নিরাপত্তা কাঠামো ভেঙে পড়তে পারে। নিয়মিত সেনাবাহিনী আর্টেশ এবং IRGC মুখোমুখি হতে পারে, যার ফলে দেশে ছড়িয়ে পড়বে গৃহযুদ্ধ। আর এটি ১৯৭৯ সালের বিপ্লবের মতো হলেও, এবারে রক্তপাত ও ধ্বংস অনেকগুণ ভয়ঙ্কর হতে পারে।

এই সম্ভাব্য শূন্যতার প্রেক্ষাপটে সামনে চলে আসছে নানা গোষ্ঠী, যাদের প্রত্যেকেরই ক্ষমতা দখলের খিদে রয়েছে। একদিকে রয়েছে রক্ষণশীল ধর্মীয় আলেমগণ, যারা কোম ও মাশহাদের মাদ্রাসা-ভিত্তিক ক্ষমতাকাঠামো ধরে রাখতে চান। অন্যদিকে রয়েছে সংস্কারপন্থী ও উদারপন্থী রাজনীতিকেরা, যারা শহরভিত্তিক মধ্যবিত্ত ও শিক্ষিত তরুণদের প্রতিনিধিত্ব করে এবং পশ্চিমা দুনিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নকে প্রাধান্য দেয়। আর IRGC-এর ভেতরেই রয়েছে জাতীয়তাবাদী টেকনোক্র্যাটদের একটি অংশ, যারা সামরিক নেতৃত্ব ধরে রেখে বাস্তববাদী অর্থনীতি ও কৌশলগত বোঝাপড়ায় আগ্রহী।

এসবের বাইরে রয়েছে বিস্ফোরণযোগ্য একটি শক্তি—ইরানের জাতিগত বিচ্ছিন্নতাবাদীরা। কুর্দি, বালুচ ও আরব সম্প্রদায় যারা বহুদিন ধরে ইরানি পার্সিয়ান আধিপত্যে নিপীড়িত বোধ করে। তাদের চাহিদা—ভাষাগত অধিকার, সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য এবং স্বশাসন। আর এদেরই আশেপাশে গড়ে উঠেছে শক্তিশালী প্রতিবাদী সিভিল সোসাইটি ও সাধারণ নাগরিক সমাজ, যারা ২০২২ সালের “মহসা আমিনি” আন্দোলনের মধ্য দিয়ে প্রমাণ করেছে—তারা কেবল জীবনধারার স্বাধীনতা নয়, বরং নেতৃত্ব পরিবর্তনের পক্ষেও প্রস্তুত।

এই অভ্যন্তরীণ অস্থিরতার সুযোগ নেবে একাধিক বাহ্যিক শক্তি। ইসরায়েল সুযোগ খুঁজবে ইরানের পরমাণু সক্ষমতা ধ্বংস করতে। যুক্তরাষ্ট্র চাইবে “রেজিম চেঞ্জ” এবং নিজেদের ভেঙে পড়া প্রভাব পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে। সৌদি আরব চাপে রাখবে শিয়া আধিপত্যকে প্রতিহত করতে। তুরস্ক কুর্দি আগুন থেকে নিজ সীমান্ত রক্ষায় আগ্রহী। পাকিস্তান একদিকে বালুচদের বিদ্রোহ দমাতে চাইলেও, অপরদিকে সীমান্ত সংকটে সুযোগ খুঁজবে।

এই বহিরাগত আগ্রাসনের মুখে ইরানের ভিতরেই জ্বলে উঠতে পারে সুপ্ত বিদ্রোহের আগ্নেয়গিরি। কুর্দিস্তানে PJAK, কোমালার মতো গ্রুপ, বালুচিস্তানে জাইশুল আদল, আর খুজেস্তানে ASMLA বা আহওয়াজিয়া বিদ্রোহীরা একযোগে কার্যকর হলে, রাজধানী তেহরানের নিয়ন্ত্রণ শুধু কঠিন নয়—অসম্ভব হয়ে উঠবে।

আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে অর্থনীতি। IRGC ভেঙে পড়লে ইরানের সবচেয়ে বড় কালোবাজার, তেল পাচার নেটওয়ার্ক, বন্দর-ভিত্তিক দুর্নীতি—সব কিছু উন্মোচিত হবে। রিয়ালের মান ধসবে। ব্যাংকিং সিস্টেম হবে অচল। বাজারে খাদ্য ও ওষুধের ঘাটতি দেখা দেবে। মধ্যবিত্ত শ্রেণির ওপর বাড়বে চরম চাপ—এবং ইতিহাস বলে, বিপ্লবের পেছনে মধ্যবিত্তদের অসন্তোষই সবচেয়ে বড় চালিকা শক্তি।

এই সমস্ত সম্ভাবনার শেষ পরিণতি কী হতে পারে? বিশ্লেষকরা সম্ভাব্য তিনটি পথ দেখছেন। প্রথমত, একটি গণ-বিদ্রোহ যেটি আরব বসন্তের অনুকরণে শুরু হয়ে সামরিক বা ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকেই গুঁড়িয়ে দিতে পারে। দ্বিতীয়ত, IRGC বা তাদের জাতীয়তাবাদী অংশ সেনা অভ্যুত্থানের মাধ্যমে শক্তি দখল করতে পারে, যার ফলাফল হতে পারে অস্থায়ী শৃঙ্খলা এবং দীর্ঘমেয়াদী স্বৈরতন্ত্র। আর তৃতীয়ত, একটি ধর্মীয় আপস—নতুন সর্বোচ্চ নেতা ও মৃদু সংস্কারের মাধ্যমে রক্ষণশীল ব্যবস্থা রক্ষার প্রচেষ্টা।

খামেনির মৃত্যুর পরে ইরান কেবল একটি পরবর্তী নেতা নয়, বরং নিজের রাজনৈতিক অস্তিত্ব ও রাষ্ট্রীয় পরিচয়ের নতুন সংজ্ঞা খুঁজবে। এটি শুধু ইরানের আভ্যন্তরীণ বিষয় নয়—বরং মধ্যপ্রাচ্য, এশিয়া এবং বৈশ্বিক রাজনীতির ভবিষ্যৎ ভারসাম্যের নির্ণায়ক হতে চলেছে।সত্যিকার প্রশ্ন হলো, একটি শিয়া-প্রধান, পার্সিয়ান-জাতীয়তাবাদী এবং বিপ্লবপন্থী রাষ্ট্র—যার অভ্যন্তরে রয়েছে হাজারো বিতর্ক ও বিদ্রোহ—সে কি নিজের অভ্যন্তরীণ জ্বালায় পুড়ে ছারখার হবে, নাকি একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা করবে ?





সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে জুন, ২০২৫ সন্ধ্যা ৬:৪৩
১৮টি মন্তব্য ১৯টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

৩৬ জুলাই আন্দোলনে সাবেক আর্মি অফিসারদের অবদান

লিখেছেন সত্যপথিক শাইয়্যান, ০৯ ই জুলাই, ২০২৫ সন্ধ্যা ৬:২৩

ফাছিহ তখন সিলেটে মুভ করছে, হাসপাতাল থেকে হাসপাতালে। আহত আন্দোলনকারীদের খাবার পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করছে। ঠিক তখন, তার মুঠোফোনে কল আসে আর্মির একজন ব্রিগেডিয়ার জেনারেলের মোবাইলফোন থেকে। তিনি বললেন... ...বাকিটুকু পড়ুন

চীন সফরের রাজনীতি ও বাংলাদেশের দ্বিধাদ্বন্দ্ব: বিএনপি-জামায়াত কী খুঁজছে চীনে?

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৯ ই জুলাই, ২০২৫ রাত ৯:০৫


বাংলাদেশের রাজনীতি যখন নির্বাচনী অস্থিরতা এবং আন্তর্জাতিক চাপের নিচে পিষ্ট, তখন একের পর এক বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর চীন সফর এক ধরনের কৌশলগত স্পর্ধার ইঙ্গিত দেয়। বিএনপি ইতোমধ্যে চারবার... ...বাকিটুকু পড়ুন

আঠারো শতকে বাংলায় ইহুদি বণিক: এক বিস্মৃত অধ্যায়

লিখেছেন কিরকুট, ০৯ ই জুলাই, ২০২৫ রাত ১০:২৪





বাংলার ইতিহাসে মুসলিম, হিন্দু, ইংরেজ এবং আর্মেনীয় ব্যবসায়ীদের উপস্থিতি নিয়ে বহু আলোচনা হলেও, একটি স্বল্পপরিচিত গোষ্ঠী — ইহুদি বণিকরা — প্রায় নজরের বাইরে থেকে গেছে। ১৮শ শতকে যখন... ...বাকিটুকু পড়ুন

জরিপঃ আপনি কি চান ব্লগার ওমর খাইয়াম আপনার পোস্টে কমেন্ট করুন?

লিখেছেন সত্যপথিক শাইয়্যান, ১০ ই জুলাই, ২০২৫ রাত ১২:২৪



ব্লগার ওমর খাইয়াম একটু কঠিন মন্তব্য করেন। অনেকের পক্ষেই তা সহ্য করা সম্ভব হয় না। কেউ তাকে ব্যান করেন, আবার কেউবা রিপোর্ট করেন। আপনি যদি তাকে কখনো বলেন... ...বাকিটুকু পড়ুন

দেশ পরিচালনায় জামায়াত কতটা দক্ষতা দেখাতে পারে?

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ১০ ই জুলাই, ২০২৫ সকাল ১১:০৭



জামায়াত শিবির একটি সুসংগঠিত সংগঠন। সেই তুলনায় বিএনপি, জাতীয়পার্টি এবং নিষিদ্ধ ঘোষিত আম্লিগ সুসংগঠিত নয়। জামায়তের সংগে বিএনপি, জাতীয়পার্টি এবং নিষিদ্ধ ঘোষিত আম্লিগের বিশাল ফারাক লক্ষ করা যায়।... ...বাকিটুকু পড়ুন

×