
একবিংশ শতাব্দীর ভূ-রাজনৈতিক দৃশ্যপট দ্রুত বদলাচ্ছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে দীর্ঘদিনের 'একমেরু' বিশ্বব্যবস্থা এখন চ্যালেঞ্জের মুখে। চীন ও রাশিয়ার ক্রমবর্ধমান প্রভাব এক নতুন 'বহুমেরু' বিশ্বব্যবস্থার জন্ম দিচ্ছে। কিন্তু এই পরিবর্তন মানবতা, নারীর অধিকার এবং গণতন্ত্রের জন্য কেমন হবে? সত্যিই কি চীন-রাশিয়া জোটের নতুন বিশ্বব্যবস্থা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন ব্যবস্থার চেয়ে খারাপ হবে ?
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে যে বিশ্বব্যবস্থা গড়ে উঠেছে, তার ভিত্তি ছিল গণতন্ত্র, মুক্তবাজার অর্থনীতি এবং মানবাধিকারের প্রচার। এই ব্যবস্থার বেশ কিছু ইতিবাচক দিক রয়েছে। বহু দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ভূমিকা রেখেছে, যার ফলে অনেক মানুষ স্বৈরাচারী শাসন থেকে মুক্তি পেয়েছেন। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন ও প্রতিষ্ঠানের প্রসারে যুক্তরাষ্ট্রের অবদান অনস্বীকার্য। তাদের নিজেদের মানবাধিকার রেকর্ড সবসময় নিখুঁত না হলেও, তারা বিশ্বজুড়ে মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে সোচ্চার থেকেছে। নারীর অধিকারের অগ্রগতিতেও পশ্চিমা দেশগুলোর ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ।
তবে, এই ব্যবস্থার কিছু অন্ধকার দিকও আছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রায়শই তাদের কৌশলগত স্বার্থের ভিত্তিতে মানবাধিকার বা গণতন্ত্রের মানদণ্ডে ভিন্ন আচরণ করেছে, যা তাদের বিশ্বাসযোগ্যতা ক্ষুণ্ন করেছে। বিভিন্ন দেশে তাদের সামরিক হস্তক্ষেপের কারণে অনেক সময় অস্থিতিশীলতা বেড়েছে এবং মানবিক সংকট তৈরি হয়েছে। মুক্তবাজার অর্থনীতির অনিয়ন্ত্রিত প্রসারের ফলে অনেক সময় ধনী-গরিবের বৈষম্যও বেড়েছে। তা সত্ত্বেও, এই ব্যবস্থায় অন্তত ব্যক্তিগত স্বাধীনতা, মানবাধিকার এবং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধগুলো একটি আন্তর্জাতিক আলোচনার কেন্দ্রে ছিল।
চীন ও রাশিয়া উভয়েই দৃঢ়ভাবে মনে করে যে মার্কিন নেতৃত্বাধীন বিশ্বব্যবস্থা তাদের সার্বভৌমত্ব এবং স্বার্থের জন্য হুমকি। তারা একটি বহুমেরু বিশ্ব চায়, যেখানে কোনো একক দেশের আধিপত্য থাকবে না। কিন্তু তাদের এই দর্শনের মূল ভিত্তিগুলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের থেকে অনেকটাই ভিন্ন এবং এখানেই উদ্বেগের জন্ম।
এই দুই দেশ অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করার নীতিতে বিশ্বাসী, যা এক অর্থে অন্য দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে প্রকাশ্যে খুব কমই প্রশ্ন তোলার নীতি। তাদের নিজেদের দেশেও মানবাধিকার পরিস্থিতি অত্যন্ত উদ্বেগজনক। চীন একটি কমিউনিস্ট পার্টি-শাসিত একদলীয় রাষ্ট্র, যেখানে জনগণের রাজনৈতিক অধিকার অত্যন্ত সীমিত। রাশিয়াতে আনুষ্ঠানিক গণতন্ত্র থাকলেও, তা ক্রমশ কর্তৃত্ববাদী শাসনের দিকে ঝুঁকছে, যেখানে বিরোধী মত দমন করা হয় এবং গণমাধ্যমের স্বাধীনতা খর্ব করা হয়। উভয় দেশের কাছে রাষ্ট্রের ক্ষমতা ও অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতা ব্যক্তিগত স্বাধীনতা এবং অধিকারের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ।
চীনের উইঘুর মুসলিমদের প্রতি আচরণ, হংকংয়ের গণতন্ত্রপন্থীদের দমন এবং ভিন্নমতাবলম্বীদের ওপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ বিশ্বজুড়ে সমালোচিত। একটি চীন-নেতৃত্বাধীন বিশ্বে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাগুলো সম্ভবত আরও কম প্রশ্নবিদ্ধ হবে, কারণ হস্তক্ষেপ হীনতার নীতিকে অগ্রাধিকার দেওয়া হবে। রাশিয়ার ক্ষেত্রেও বিরোধী নেতা দমন, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা খর্ব করা এবং ইউক্রেনে আগ্রাসন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের চরম লঙ্ঘন। তাদের উত্থান মানবাধিকারের সার্বজনীন ধারণাকে দুর্বল করতে পারে। যেখানে মার্কিন নেতৃত্বাধীন ব্যবস্থায় ত্রুটি থাকলেও, মানবাধিকারের সার্বজনীন ঘোষণাপত্রের মতো আন্তর্জাতিক চুক্তিতে তাদের সমর্থন এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে তাদের সমালোচনা বিশ্বব্যাপী একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।
চীন ও রাশিয়া উভয় দেশেই রাষ্ট্রীয়ভাবে নারীর অধিকারের প্রচার থাকলেও, নারীদের রাজনৈতিক অংশগ্রহণ এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়ায় তাদের ভূমিকা পশ্চিমা দেশগুলোর তুলনায় সীমিত। সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কারণেও অনেক ক্ষেত্রে নারীরা পিছিয়ে আছেন। পশ্চিমা বিশ্বের নারীর অধিকার আন্দোলন বিশ্বজুড়ে নারীদের অবস্থার উন্নতিতে বড় ভূমিকা রেখেছে এবং নারীর ক্ষমতায়ন ও লিঙ্গ সমতার ধারণাগুলো আন্তর্জাতিক ফোরামে তাদের দ্বারা জোরেশোরে উত্থাপিত হয়েছে।
এই দেশগুলো গণতন্ত্রের পশ্চিমা ধারণাকে প্রায়শই "পশ্চিমা হস্তক্ষেপ" হিসাবে দেখে। তারা মনে করে, প্রতিটি দেশের নিজস্ব রাজনৈতিক ব্যবস্থা বেছে নেওয়ার অধিকার আছে, এমনকি যদি তা স্বৈরাচারীও হয়। একটি চীন-রাশিয়া প্রভাবিত বিশ্বে, গণতন্ত্রের পরিবর্তে কর্তৃত্ববাদী শাসনের মডেলগুলো আরও গ্রহণযোগ্যতা পেতে পারে। এটি বিশ্বজুড়ে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর দুর্বলতার কারণ হতে পারে, যা দীর্ঘমেয়াদে স্থিতিশীলতার পরিবর্তে অস্থিরতাই বয়ে আনবে।
প্রশ্নটি সরল নয় যে চীন-রাশিয়া জোটের বিশ্বব্যবস্থা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন ব্যবস্থার চেয়ে খারাপ হবে কি না ? তবে, যদি আমরা ব্যক্তিগত স্বাধীনতা, মানবাধিকার, নারীর অধিকার এবং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে অগ্রাধিকার দিই, তাহলে চীন-রাশিয়া জোটের বিশ্বব্যবস্থা স্পষ্টতই উদ্বেগের কারণ। মার্কিন নেতৃত্বাধীন বিশ্বব্যবস্থায় অনেক ত্রুটি এবং দ্বৈত নীতি থাকলেও, এটি অন্তত এই মৌলিক মানবাধিকার এবং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধগুলির একটি বৈশ্বিক আলোচনা এবং সমালোচনার সুযোগ দিয়েছে।
চীন-রাশিয়া জোটের উত্থান সেই সুযোগকে সংকুচিত করতে পারে এবং একটি এমন বিশ্বে নিয়ে যেতে পারে যেখানে ক্ষমতা এবং রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ মানবাধিকারের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হবে। এটি এমন একটি বিশ্ব যেখানে অভ্যন্তরীণ দমন-পীড়নকে আন্তর্জাতিকভাবে প্রশ্ন ছাড়াই সুযোগ দেওয়া হবে, যা অগণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলোকে আরও উৎসাহিত করবে। একটি বহুমেরু বিশ্বের প্রয়োজন থাকলেও, এর নেতৃত্ব যদি এমন শক্তিগুলোর হাতে চলে যায় যারা মৌলিক মানবিক মূল্যবোধকে অবজ্ঞা করে, তবে তা মানব সভ্যতার জন্য একটি অন্ধকারাচ্ছন্ন ভবিষ্যতের ইঙ্গিত দেয়।
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে জুন, ২০২৫ রাত ১২:৫১

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।






