somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

চীন সফরের রাজনীতি ও বাংলাদেশের দ্বিধাদ্বন্দ্ব: বিএনপি-জামায়াত কী খুঁজছে চীনে?

০৯ ই জুলাই, ২০২৫ রাত ৯:০৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


বাংলাদেশের রাজনীতি যখন নির্বাচনী অস্থিরতা এবং আন্তর্জাতিক চাপের নিচে পিষ্ট, তখন একের পর এক বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর চীন সফর এক ধরনের কৌশলগত স্পর্ধার ইঙ্গিত দেয়। বিএনপি ইতোমধ্যে চারবার বেইজিং সফর শেষ করেছে; শেষবার গেল জুন মাসে। আর সামনে যাচ্ছে জামায়াতে ইসলামি। বর্তমান প্রেক্ষাপটে এটি নিছক এক প্রোটোকল ভিজিট নয় বরং একটানা ঘনঘন সফরের মাধ্যমে একটি বিপরীতধর্মী ভূ-রাজনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের প্রচেষ্টা।

বাংলাদেশে বর্তমানে কোনো নির্বাচিত সরকার নেই। রয়েছে একটি অনির্বাচিত ও আপাতদৃষ্টিতে 'নিরপেক্ষ' অন্তর্বর্তী সরকার, যার নেতৃত্বে রয়েছেন আন্তর্জাতিকভাবে উচ্চারিত চরিত্র ড. মুহাম্মদ ইউনূস। দেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো পরবর্তী নির্বাচনে বিজয়ের জন্য আন্তর্জাতিক মহলের মনোযোগ ও সমর্থন পেতে মরিয়া। এই পরিস্থিতিতে চীনের সঙ্গে বাড়তি ঘনিষ্ঠতা কি কেবল রাজনৈতিক ব্যাকআপের আশ্বাস? নাকি কোনো এক ‘অজানা গ্যারান্টির খোঁজ’?

চীন আজ আর শুধুই একটি রাষ্ট্র নয়, বরং বহু দেশের জন্য একটি “ব্যাকআপ রেজিম পার্টনার।” যখন রাষ্ট্রীয় বৈধতার আলো নিভে যায়, তখন চীন তার লাল লণ্ঠন জ্বেলে দেয়। ২০১৮ সালের রাতের ভোটে শেখ হাসিনাকে খোলাখুলি স্বর্ণের নৌকা উপহার দিয়ে চীন যে বার্তা দিয়েছিল, তা ছিল: “নো ম্যানডেট, নো প্রবলেম।” এই সহযোগিতা কেবল একটি সরকারের সঙ্গে নয়, বরং এক ধরনের অগণতান্ত্রিক শাসন কাঠামোর সাথেই। সুতরাং, যখন দেখা যায় বর্তমান ক্ষমতার বাইরে থাকা বিএনপি ও জামায়াতও সেই একই চীনের দ্বারে যাচ্ছে, তখন প্রশ্ন জাগে: চীন কি আবার এক ‘নতুন স্বৈরতান্ত্রিক ব্যবস্থার’ সূচনা করতে যাচ্ছে?

তবে, ভূ-রাজনীতির মঞ্চে কেউ চিরকাল ‘বন্ধু’ থাকে না। শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর চীন এক রকম ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে এখন বিএনপি-জামায়াতের সাথে আলোচনায় ব্যস্ত। আবারো সেই পুরোনো চীনীয় নীতি “রাষ্ট্র নয়, শাসকই গুরুত্বপূর্ণ।” ফলে প্রশ্ন আসে, চীনের এই বিপরীতমুখী অবস্থান কেবল কূটনৈতিক বাস্তবতা, নাকি কৌশলগত 'পাওয়ার শিফট'-এর সূচনা ?

অন্যদিকে, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে চায় ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজির একটি ‘রেজিলিয়েন্ট পার্টনার’ হিসেবে। চায় বাংলাদেশ GSOMIA এবং ACSA-তে স্বাক্ষর করুক, চায় বঙ্গোপসাগরে চীনের প্রভাব রুখে দিক। চায় চট্টগ্রাম বা পায়রা বন্দর হোক QUAD-এর বিকল্প সামুদ্রিক হাব। এই যুক্তরাষ্ট্র-চীন দ্বন্দ্বের মাঝে বাংলাদেশ পড়ে গেছে এক রাজনৈতিক টানাপোড়েনে, যেটি নিছক পলিসি ডিলেমা নয় বরং অস্তিত্ব সংকট।

চীন গত ১০ বছরে বাংলাদেশে ৩২ বিলিয়ন ডলারের উন্নয়ন সহযোগিতা দিয়েছে, বিপরীতে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় রপ্তানি বাজার, প্রধান মানবিক সহায়তাকারী এবং ইন্দো-প্যাসিফিক নিরাপত্তা কাঠামোর কেন্দ্রবিন্দু। প্রশ্ন হলো—বাংলাদেশ কাকে বেছে নেবে? আর নির্বাচনের আগে বিএনপি-জামায়াত এই প্রশ্নের জবাব কীভাবে দেবে?

রোহিঙ্গা ইস্যুতে চীনের ভূমিকা স্পষ্টভাবে বাংলাদেশবিরোধী। ১০ লাখের বেশি মানুষ এদেশে এসে আশ্রয় নিয়েছে, অথচ চীন তাদের ফেরত পাঠানোর কোনো কার্যকর চাপই মিয়ানমার সরকারের উপর দেয়নি। বরং চীন তাদের পুরোনো প্রকল্প মাইওয়াদ্দি থেকে চাউংপিউ পর্যন্ত অর্থনৈতিক করিডোর তৈরিতে ব্যস্ত। চীনের অবস্থান "রোহিঙ্গারা থাকুক বাংলাদেশেই, বিনিময়ে আমরা বঙ্গোপসাগরে বন্দর পাই।" বিএনপি-জামায়াত যদি সত্যিই রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব নিতে চায়, তবে চীনের সঙ্গে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে সুস্পষ্ট অবস্থান না নিলে তারা একদিন একই চক্রে পড়ে যাবে।

জামায়াতের অতীতের ইতিহাস আরাকানকে স্বাধীন রাষ্ট্র বানানোর স্বপ্ন দেখার। চীন সেই ইতিহাস ভোলে না। ফলে জামায়াতের সঙ্গে চীনের সম্পর্ক “দূরত্বের ঘনিষ্ঠতা” খোলাখুলি নয়, কিন্তু দরজা পুরোপুরি বন্ধও নয়। চীন জানে, বাংলাদেশে রাজনীতির গতি-প্রকৃতি রাতে বদলায়, আর জামায়াতের রাজনৈতিক কার্ড আজও ব্যালেন্স টিপে দিতে পারে।

এদিকে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে ইন্দো-প্যাসিফিকের একটি “নেট সিকিউরিটি প্রোভাইডার” হিসেবে দেখতে চায়। মানে নৌ নিরাপত্তা, মানবপাচার রোধ, জলদস্যু প্রতিহত এবং দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় নেতৃত্বে থাকা। আবার চায় বাংলাদেশের 5G ও ডেটা নিরাপত্তা নীতিমালা যেন চীনা প্রযুক্তি থেকে সরে গিয়ে মার্কিন মানের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়।

বাংলাদেশ এখন সেই মোহনায় দাঁড়িয়ে, যেখানে একদিকে চীনের উন্নয়ন-নির্ভর কূটনীতি, অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তা ও নীতিগত অংশীদারত্বের প্রস্তাব। সমস্যা হলো এটা কোনো টানাটানি নয়, বরং কৌশলগত প্যাঁচে জড়িয়ে পড়ার সম্ভাব্যতা। চীনের সঙ্গে অতিরিক্ত ঘনিষ্ঠতা পশ্চিমা বিশ্বে বিনিয়োগ কমিয়ে দেয়; আবার যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সামরিক চুক্তি চীনকে তির্যক করে তোলে। এই দুই অক্ষে ভারসাম্য রক্ষা করা যতটা সহজ বলে মনে হয়, বাস্তবে তা ততটাই কঠিন।

বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর উচিত এখনই প্রকাশ্যে জনগণের কাছে বলতে শুরু করা যে, তারা ক্ষমতায় গেলে ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজি, রোহিঙ্গা ইস্যু, চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক কেমন করবে। শুধু চীনের দরজায় গিয়ে হাসিমুখে ছবি তুলে এনে ঘরে ফিরে আসা এখন আর যথেষ্ট নয়। জনগণ জানতে চায়: “কী চাই চীনের কাছে? আর কাকে না করতে পারবে?”


সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই জুলাই, ২০২৫ রাত ৯:০৮
১১টি মন্তব্য ১১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

হাদিকে shoot করে লাভবান হলো কে?

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৩:২৪


শরিফ ওসমান হাদি যিনি সাধারণত ওসমান হাদি নামে পরিচিত একজন বাংলাদেশি রাজনৈতিক কর্মী ও বক্তা, যিনি জুলাই গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে গঠিত রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র হিসেবে পরিচিত। তিনি ত্রয়োদশ... ...বাকিটুকু পড়ুন

আধা রাজাকারি পোষ্ট ......

লিখেছেন কলিমুদ্দি দফাদার, ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৩:৫৬


আমি স্বাধীন বাংলাদেশে জন্মগ্রহণ করেছি। আমার কাছে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা, বা পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্গে আজকের বাংলাদেশের তুলনা—এসব নিয়ে কোনো আবেগ বা নস্টালজিয়া নেই। আমি জন্মগতভাবেই স্বাধীন দেশের নাগরিক, কিন্তু... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইন্দিরা কেন ভারতীয় বাহিনীকে বাংলাদেশে দীর্ঘদিন রাখেনি?

লিখেছেন জেন একাত্তর, ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৫:২০



কারণ, কোল্ডওয়ারের সেই যুগে (১৯৭১সাল ), আমেরিকা ও চীন পাকিস্তানের পক্ষে ছিলো; ইন্দিরা বাংলাদেশে সৈন্য রেখে বিশ্বের বড় শক্তিগুলোর সাথে বিতন্ডায় জড়াতে চাহেনি।

ব্লগে নতুন পাগলের উদ্ভব ঘটেছে;... ...বাকিটুকু পড়ুন

বন্ডাইর মত হত্যাকাণ্ড বন্ধে নেতানিয়াহুদের থামানো জরুরি...

লিখেছেন নতুন নকিব, ১৬ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১১:২৫

বন্ডাইর মত হত্যাকাণ্ড বন্ধে নেতানিয়াহুদের থামানো জরুরি...

বন্ডাই সৈকতের হামলাস্থল। ছবি: রয়টার্স

অস্ট্রেলিয়ার সিডনির বন্ডাই সৈকত এলাকায় ইহুদিদের একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠানে সমবেত মানুষের ওপর দুই অস্ত্রধারী সন্ত্রাসী অতর্কিতে গুলি চালিয়েছে। এতে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আল্লাহ সর্বত্র বিরাজমাণ নন বলা কুফুরী

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ১৬ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:১৪



সূরাঃ ২ বাকারা, ২৫৫ নং আয়াতের অনুবাদ-
২৫৫। আল্লাহ, তিনি ব্যতীত কোন ইলাহ নেই।তিনি চিরঞ্জীব চির বিদ্যমাণ।তাঁকে তন্দ্রা অথবা নিদ্রা স্পর্শ করে না।আকাশ ও পৃথিবীতে যা কিছু আছে সমস্তই... ...বাকিটুকু পড়ুন

×