
বাংলাদেশের রাজনীতি যখন নির্বাচনী অস্থিরতা এবং আন্তর্জাতিক চাপের নিচে পিষ্ট, তখন একের পর এক বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর চীন সফর এক ধরনের কৌশলগত স্পর্ধার ইঙ্গিত দেয়। বিএনপি ইতোমধ্যে চারবার বেইজিং সফর শেষ করেছে; শেষবার গেল জুন মাসে। আর সামনে যাচ্ছে জামায়াতে ইসলামি। বর্তমান প্রেক্ষাপটে এটি নিছক এক প্রোটোকল ভিজিট নয় বরং একটানা ঘনঘন সফরের মাধ্যমে একটি বিপরীতধর্মী ভূ-রাজনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের প্রচেষ্টা।
বাংলাদেশে বর্তমানে কোনো নির্বাচিত সরকার নেই। রয়েছে একটি অনির্বাচিত ও আপাতদৃষ্টিতে 'নিরপেক্ষ' অন্তর্বর্তী সরকার, যার নেতৃত্বে রয়েছেন আন্তর্জাতিকভাবে উচ্চারিত চরিত্র ড. মুহাম্মদ ইউনূস। দেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো পরবর্তী নির্বাচনে বিজয়ের জন্য আন্তর্জাতিক মহলের মনোযোগ ও সমর্থন পেতে মরিয়া। এই পরিস্থিতিতে চীনের সঙ্গে বাড়তি ঘনিষ্ঠতা কি কেবল রাজনৈতিক ব্যাকআপের আশ্বাস? নাকি কোনো এক ‘অজানা গ্যারান্টির খোঁজ’?
চীন আজ আর শুধুই একটি রাষ্ট্র নয়, বরং বহু দেশের জন্য একটি “ব্যাকআপ রেজিম পার্টনার।” যখন রাষ্ট্রীয় বৈধতার আলো নিভে যায়, তখন চীন তার লাল লণ্ঠন জ্বেলে দেয়। ২০১৮ সালের রাতের ভোটে শেখ হাসিনাকে খোলাখুলি স্বর্ণের নৌকা উপহার দিয়ে চীন যে বার্তা দিয়েছিল, তা ছিল: “নো ম্যানডেট, নো প্রবলেম।” এই সহযোগিতা কেবল একটি সরকারের সঙ্গে নয়, বরং এক ধরনের অগণতান্ত্রিক শাসন কাঠামোর সাথেই। সুতরাং, যখন দেখা যায় বর্তমান ক্ষমতার বাইরে থাকা বিএনপি ও জামায়াতও সেই একই চীনের দ্বারে যাচ্ছে, তখন প্রশ্ন জাগে: চীন কি আবার এক ‘নতুন স্বৈরতান্ত্রিক ব্যবস্থার’ সূচনা করতে যাচ্ছে?
তবে, ভূ-রাজনীতির মঞ্চে কেউ চিরকাল ‘বন্ধু’ থাকে না। শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর চীন এক রকম ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে এখন বিএনপি-জামায়াতের সাথে আলোচনায় ব্যস্ত। আবারো সেই পুরোনো চীনীয় নীতি “রাষ্ট্র নয়, শাসকই গুরুত্বপূর্ণ।” ফলে প্রশ্ন আসে, চীনের এই বিপরীতমুখী অবস্থান কেবল কূটনৈতিক বাস্তবতা, নাকি কৌশলগত 'পাওয়ার শিফট'-এর সূচনা ?
অন্যদিকে, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে চায় ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজির একটি ‘রেজিলিয়েন্ট পার্টনার’ হিসেবে। চায় বাংলাদেশ GSOMIA এবং ACSA-তে স্বাক্ষর করুক, চায় বঙ্গোপসাগরে চীনের প্রভাব রুখে দিক। চায় চট্টগ্রাম বা পায়রা বন্দর হোক QUAD-এর বিকল্প সামুদ্রিক হাব। এই যুক্তরাষ্ট্র-চীন দ্বন্দ্বের মাঝে বাংলাদেশ পড়ে গেছে এক রাজনৈতিক টানাপোড়েনে, যেটি নিছক পলিসি ডিলেমা নয় বরং অস্তিত্ব সংকট।
চীন গত ১০ বছরে বাংলাদেশে ৩২ বিলিয়ন ডলারের উন্নয়ন সহযোগিতা দিয়েছে, বিপরীতে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় রপ্তানি বাজার, প্রধান মানবিক সহায়তাকারী এবং ইন্দো-প্যাসিফিক নিরাপত্তা কাঠামোর কেন্দ্রবিন্দু। প্রশ্ন হলো—বাংলাদেশ কাকে বেছে নেবে? আর নির্বাচনের আগে বিএনপি-জামায়াত এই প্রশ্নের জবাব কীভাবে দেবে?
রোহিঙ্গা ইস্যুতে চীনের ভূমিকা স্পষ্টভাবে বাংলাদেশবিরোধী। ১০ লাখের বেশি মানুষ এদেশে এসে আশ্রয় নিয়েছে, অথচ চীন তাদের ফেরত পাঠানোর কোনো কার্যকর চাপই মিয়ানমার সরকারের উপর দেয়নি। বরং চীন তাদের পুরোনো প্রকল্প মাইওয়াদ্দি থেকে চাউংপিউ পর্যন্ত অর্থনৈতিক করিডোর তৈরিতে ব্যস্ত। চীনের অবস্থান "রোহিঙ্গারা থাকুক বাংলাদেশেই, বিনিময়ে আমরা বঙ্গোপসাগরে বন্দর পাই।" বিএনপি-জামায়াত যদি সত্যিই রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব নিতে চায়, তবে চীনের সঙ্গে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে সুস্পষ্ট অবস্থান না নিলে তারা একদিন একই চক্রে পড়ে যাবে।
জামায়াতের অতীতের ইতিহাস আরাকানকে স্বাধীন রাষ্ট্র বানানোর স্বপ্ন দেখার। চীন সেই ইতিহাস ভোলে না। ফলে জামায়াতের সঙ্গে চীনের সম্পর্ক “দূরত্বের ঘনিষ্ঠতা” খোলাখুলি নয়, কিন্তু দরজা পুরোপুরি বন্ধও নয়। চীন জানে, বাংলাদেশে রাজনীতির গতি-প্রকৃতি রাতে বদলায়, আর জামায়াতের রাজনৈতিক কার্ড আজও ব্যালেন্স টিপে দিতে পারে।
এদিকে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে ইন্দো-প্যাসিফিকের একটি “নেট সিকিউরিটি প্রোভাইডার” হিসেবে দেখতে চায়। মানে নৌ নিরাপত্তা, মানবপাচার রোধ, জলদস্যু প্রতিহত এবং দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় নেতৃত্বে থাকা। আবার চায় বাংলাদেশের 5G ও ডেটা নিরাপত্তা নীতিমালা যেন চীনা প্রযুক্তি থেকে সরে গিয়ে মার্কিন মানের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়।
বাংলাদেশ এখন সেই মোহনায় দাঁড়িয়ে, যেখানে একদিকে চীনের উন্নয়ন-নির্ভর কূটনীতি, অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তা ও নীতিগত অংশীদারত্বের প্রস্তাব। সমস্যা হলো এটা কোনো টানাটানি নয়, বরং কৌশলগত প্যাঁচে জড়িয়ে পড়ার সম্ভাব্যতা। চীনের সঙ্গে অতিরিক্ত ঘনিষ্ঠতা পশ্চিমা বিশ্বে বিনিয়োগ কমিয়ে দেয়; আবার যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সামরিক চুক্তি চীনকে তির্যক করে তোলে। এই দুই অক্ষে ভারসাম্য রক্ষা করা যতটা সহজ বলে মনে হয়, বাস্তবে তা ততটাই কঠিন।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর উচিত এখনই প্রকাশ্যে জনগণের কাছে বলতে শুরু করা যে, তারা ক্ষমতায় গেলে ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজি, রোহিঙ্গা ইস্যু, চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক কেমন করবে। শুধু চীনের দরজায় গিয়ে হাসিমুখে ছবি তুলে এনে ঘরে ফিরে আসা এখন আর যথেষ্ট নয়। জনগণ জানতে চায়: “কী চাই চীনের কাছে? আর কাকে না করতে পারবে?”
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই জুলাই, ২০২৫ রাত ৯:০৮

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




