
বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে আজ পালিত হলো ‘জুলাই শহীদ দিবস’। শ্রদ্ধা, স্মরণ, দোয়া, মোমবাতি প্রজ্বালন, আর কবরের পাশে হাজারো অশ্রুসজল চোখ। শহীদ আবু সাঈদের প্রথম শাহাদাত বার্ষিকীতে ক্যাম্পাস যেন হয়ে উঠেছিল এক জীবন্ত স্মৃতিস্তম্ভ। কিন্তু এই শোকসভা, শপথ, সংবেদনশীল আয়োজনের ভিড়ে ছড়িয়ে আছে একটিই বিক্ষুব্ধ প্রশ্ন বিচার হবে তো?’
৩০ জুন, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গ্রহণ করলেও এখনো মূলহোতারা পলাতক। মাত্র চারজন গ্রেপ্তার। পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দিয়ে ২৪ জনকে আত্মসমর্পণের নির্দেশ দেয়া হলেও ক’জন আসবে সে নিয়ে সংশয় প্রবল। তদন্তে উঠে এসেছে, এটি শুধু একজন ছাত্রের হত্যাকাণ্ড নয় এটি ছিল রাষ্ট্রীয় বাহিনী ও প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষমতার এক যৌথ হত্যাযজ্ঞ। হত্যাকে ‘মানবতাবিরোধী অপরাধ’ বলে অভিহিত করা হয়েছে, কিন্তু ‘মানবতার’ তরফ থেকে এখনো নেই সাড়া। বিচারের অগ্রগতি যেন রেললাইনের উপর শুয়ে থাকা বিশাল পাথর সরছে না, সরানোও যাচ্ছে না।
আন্তর্বর্তী সরকারের চার উপদেষ্টার উপস্থিতি বার্তা দেয় নতুন করে আশার। আবু সাঈদের বাবা প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন, কিন্তু তার চোখের ভাষায় লেখা ছিল একটি অনুচ্চারিত অবিশ্বাস 'আরেকটা প্রহসনের মঞ্চায়ন নয় তো?' ২৪ জুন পিবিআই প্রতিবেদন জমা দেয়ার পর বিচারকাজে গতি আসবে বলে ধারণা করা হয়েছিল, কিন্তু বরাবরের মতোই মামলাটি ‘চলমান’ শব্দে আটকে আছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা আজও ছড়িয়ে রেখেছেন স্মৃতির প্রদীপ। সাঈদ ভাই ইতিহাস হয়ে আছেন” জান্নাতুলের মতো অসংখ্য মুখে উচ্চারিত এই বাক্য আবেগের থেকেও বেশি এক সামাজিক দায়বদ্ধতা হয়ে উঠেছে। বেরোবির প্রতিটি দেয়ালে আজ আবু সাঈদের ছবি—দুই হাত প্রসারিত, বুক চিতিয়ে থাকা এক অবিস্মরণীয় দৃশ্য । পরিবারের কাছে প্রশ্নটা এখনও আগের মতোই কাঁটার মতো বিঁধে ‘হামার বেটাক মারলু কেনে ?’ বাবা মকবুল হোসেন, ভাই রমজান আলী, বোন সুমি সবাই বিচারের আশায় আজও গনগনে আগুনের মতো জ্বলছেন। ৩০ জনের মধ্যে মাত্র কয়েকজন গ্রেপ্তার, বাকিরা অদৃশ্য। এ কি বিচারের নাট্যশালায় আরেকটা শোক-দৃশ্য মাত্র?
১৬ জুলাই ২০২৪—যেদিন আবু সাঈদ গুলিবিদ্ধ হয়ে রাজপথে লুটিয়ে পড়েন। সেই মুহূর্তের ভিডিও রাতারাতি দেশের প্রতিটি মোবাইল স্ক্রিনে। সেই মুহূর্তেই যেন সচেতন ছাত্র-জনতা বুঝে নেয় আর নয়, এবার রুখে দাঁড়ানোর পালা। ৫ আগস্ট, সেই প্রতিরোধই স্বৈরাচারী সরকারের পতনে রূপ নেয়। একটানা ১৬ বছরের শাসনের অবসান হয়। দেশ ছাড়তে হয় শেখ হাসিনাকে । কোটা সংস্কারের দাবিতে শুরু হওয়া আন্দোলন রূপ নেয় বৈষম্যবিরোধী জাতীয় গণআন্দোলনে। তার সূতিকাগার ছিল বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, নেতৃত্বে ছিলেন আবু সাঈদ একজন মেধাবী, প্রতিবাদী, সাহসী তরুণ। আবু সাঈদ শুধু এক ছাত্রনেতার নাম নয়, হয়ে উঠেন সাহস, প্রতিবাদ, এবং আত্মত্যাগের প্রতীক।
১৬ জুলাইয়ের সকালে যখন মিছিল পৌঁছে রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে, তখন অস্ত্রধারী ছাত্রলীগ ক্যাডার ও পুলিশের যৌথ হামলা শুরু হয়। রাবার বুলেট, গুলি, সাউন্ড গ্রেনেড সব ঝরে পড়ে নিরস্ত্র শিক্ষার্থীর ওপর। ঠিক তখনই আবু সাঈদ বলেন, "গুলি করলে কর, আমি বুক পেতে দিয়েছি।" সেই বুকেই ঠাঁই পায় রাষ্ট্রের নিষ্ঠুর গুলি । হাসপাতালে নেওয়ার পর চিকিৎসকরা বলেন “মুখ দিয়ে রক্ত বের হচ্ছিল, শরীর ঝাঁঝরা হয়ে গিয়েছিল।” শহীদ পরিবারের ভাষায়, এটি ছিল ‘কোল্ড ব্লাডেড মার্ডার’। মিছিল থেকে লাশ ছিনিয়ে নেওয়া হয়, পুলিশ প্রশাসন, স্থানীয় আওয়ামী লীগ মিলে দাফনে বাধা সৃষ্টি করে। কোনো বিচার হয়নি তখনও, হয়নি এখনো।
বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন প্রথমে নির্লিপ্ত, পরে চাপে পড়ে দুই শিক্ষক ও সাত কর্মচারীকে সাময়িক বরখাস্ত করে। রাজনৈতিক সংগঠন নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়, কিন্তু মূলহোতারা থাকে ধরাছোঁয়ার বাইরে। প্রশাসন এমনকি আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে পাল্টা মামলা করে। দরিদ্র কৃষক পরিবারের সন্তান আবু সাঈদ পঞ্চম শ্রেণিতে ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পেয়েছিলেন। গোল্ডেন জিপিএ-৫, এইচএসসি, অনার্স প্রথম শ্রেণি, ১৮তম শিক্ষক নিবন্ধনে উত্তীর্ণ সবই ছিল বিসিএসের পথে প্রস্তুতি। কিন্তু তিনি বেছে নেন বৃহত্তর ন্যায়ের সংগ্রাম। জীবনের বিনিময়ে রেখে যান একটি প্রশ্ন: “কেন মেধাবীরা বঞ্চিত হবে ?”
এক বছর পেরিয়ে গেছে। বিচারের প্রতিশ্রুতি অসংখ্য, কিন্তু ফলাফল হাতেগোনা। আইনের অধীন এক বিচারব্যবস্থা, যে প্রতিটি প্রান্তে গিয়ে থেমে যায় ক্ষমতার প্রাচীরে। জাতি কি এই ঋণ শোধ করবে শহীদ পরিবারগুলোর কাছে? আবু সাঈদের আত্মত্যাগ কি শুধু রক্তাক্ত প্রতিকৃতির মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে, নাকি বিচার নামক সেই পবিত্র প্রক্রিয়ায় ফিরবে তার সম্মান ? আবু সাঈদকে নিয়ে লেখা যাবে হাজার কবিতা, হাজার গান। কিন্তু সবচেয়ে জরুরি এখন একটাই কাজ বিচার নিশ্চিত করা।
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই জুলাই, ২০২৫ বিকাল ৩:২৭

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




