somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

গুলি করলে কর, আমি বুক পেতে দিয়েছি

১৬ ই জুলাই, ২০২৫ বিকাল ৩:২৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে আজ পালিত হলো ‘জুলাই শহীদ দিবস’। শ্রদ্ধা, স্মরণ, দোয়া, মোমবাতি প্রজ্বালন, আর কবরের পাশে হাজারো অশ্রুসজল চোখ। শহীদ আবু সাঈদের প্রথম শাহাদাত বার্ষিকীতে ক্যাম্পাস যেন হয়ে উঠেছিল এক জীবন্ত স্মৃতিস্তম্ভ। কিন্তু এই শোকসভা, শপথ, সংবেদনশীল আয়োজনের ভিড়ে ছড়িয়ে আছে একটিই বিক্ষুব্ধ প্রশ্ন বিচার হবে তো?’

৩০ জুন, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গ্রহণ করলেও এখনো মূলহোতারা পলাতক। মাত্র চারজন গ্রেপ্তার। পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দিয়ে ২৪ জনকে আত্মসমর্পণের নির্দেশ দেয়া হলেও ক’জন আসবে সে নিয়ে সংশয় প্রবল। তদন্তে উঠে এসেছে, এটি শুধু একজন ছাত্রের হত্যাকাণ্ড নয় এটি ছিল রাষ্ট্রীয় বাহিনী ও প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষমতার এক যৌথ হত্যাযজ্ঞ। হত্যাকে ‘মানবতাবিরোধী অপরাধ’ বলে অভিহিত করা হয়েছে, কিন্তু ‘মানবতার’ তরফ থেকে এখনো নেই সাড়া। বিচারের অগ্রগতি যেন রেললাইনের উপর শুয়ে থাকা বিশাল পাথর সরছে না, সরানোও যাচ্ছে না।

আন্তর্বর্তী সরকারের চার উপদেষ্টার উপস্থিতি বার্তা দেয় নতুন করে আশার। আবু সাঈদের বাবা প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন, কিন্তু তার চোখের ভাষায় লেখা ছিল একটি অনুচ্চারিত অবিশ্বাস 'আরেকটা প্রহসনের মঞ্চায়ন নয় তো?' ২৪ জুন পিবিআই প্রতিবেদন জমা দেয়ার পর বিচারকাজে গতি আসবে বলে ধারণা করা হয়েছিল, কিন্তু বরাবরের মতোই মামলাটি ‘চলমান’ শব্দে আটকে আছে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা আজও ছড়িয়ে রেখেছেন স্মৃতির প্রদীপ। সাঈদ ভাই ইতিহাস হয়ে আছেন” জান্নাতুলের মতো অসংখ্য মুখে উচ্চারিত এই বাক্য আবেগের থেকেও বেশি এক সামাজিক দায়বদ্ধতা হয়ে উঠেছে। বেরোবির প্রতিটি দেয়ালে আজ আবু সাঈদের ছবি—দুই হাত প্রসারিত, বুক চিতিয়ে থাকা এক অবিস্মরণীয় দৃশ্য । পরিবারের কাছে প্রশ্নটা এখনও আগের মতোই কাঁটার মতো বিঁধে ‘হামার বেটাক মারলু কেনে ?’ বাবা মকবুল হোসেন, ভাই রমজান আলী, বোন সুমি সবাই বিচারের আশায় আজও গনগনে আগুনের মতো জ্বলছেন। ৩০ জনের মধ্যে মাত্র কয়েকজন গ্রেপ্তার, বাকিরা অদৃশ্য। এ কি বিচারের নাট্যশালায় আরেকটা শোক-দৃশ্য মাত্র?

১৬ জুলাই ২০২৪—যেদিন আবু সাঈদ গুলিবিদ্ধ হয়ে রাজপথে লুটিয়ে পড়েন। সেই মুহূর্তের ভিডিও রাতারাতি দেশের প্রতিটি মোবাইল স্ক্রিনে। সেই মুহূর্তেই যেন সচেতন ছাত্র-জনতা বুঝে নেয় আর নয়, এবার রুখে দাঁড়ানোর পালা। ৫ আগস্ট, সেই প্রতিরোধই স্বৈরাচারী সরকারের পতনে রূপ নেয়। একটানা ১৬ বছরের শাসনের অবসান হয়। দেশ ছাড়তে হয় শেখ হাসিনাকে । কোটা সংস্কারের দাবিতে শুরু হওয়া আন্দোলন রূপ নেয় বৈষম্যবিরোধী জাতীয় গণআন্দোলনে। তার সূতিকাগার ছিল বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, নেতৃত্বে ছিলেন আবু সাঈদ একজন মেধাবী, প্রতিবাদী, সাহসী তরুণ। আবু সাঈদ শুধু এক ছাত্রনেতার নাম নয়, হয়ে উঠেন সাহস, প্রতিবাদ, এবং আত্মত্যাগের প্রতীক।

১৬ জুলাইয়ের সকালে যখন মিছিল পৌঁছে রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে, তখন অস্ত্রধারী ছাত্রলীগ ক্যাডার ও পুলিশের যৌথ হামলা শুরু হয়। রাবার বুলেট, গুলি, সাউন্ড গ্রেনেড সব ঝরে পড়ে নিরস্ত্র শিক্ষার্থীর ওপর। ঠিক তখনই আবু সাঈদ বলেন, "গুলি করলে কর, আমি বুক পেতে দিয়েছি।" সেই বুকেই ঠাঁই পায় রাষ্ট্রের নিষ্ঠুর গুলি । হাসপাতালে নেওয়ার পর চিকিৎসকরা বলেন “মুখ দিয়ে রক্ত বের হচ্ছিল, শরীর ঝাঁঝরা হয়ে গিয়েছিল।” শহীদ পরিবারের ভাষায়, এটি ছিল ‘কোল্ড ব্লাডেড মার্ডার’। মিছিল থেকে লাশ ছিনিয়ে নেওয়া হয়, পুলিশ প্রশাসন, স্থানীয় আওয়ামী লীগ মিলে দাফনে বাধা সৃষ্টি করে। কোনো বিচার হয়নি তখনও, হয়নি এখনো।

বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন প্রথমে নির্লিপ্ত, পরে চাপে পড়ে দুই শিক্ষক ও সাত কর্মচারীকে সাময়িক বরখাস্ত করে। রাজনৈতিক সংগঠন নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়, কিন্তু মূলহোতারা থাকে ধরাছোঁয়ার বাইরে। প্রশাসন এমনকি আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে পাল্টা মামলা করে। দরিদ্র কৃষক পরিবারের সন্তান আবু সাঈদ পঞ্চম শ্রেণিতে ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পেয়েছিলেন। গোল্ডেন জিপিএ-৫, এইচএসসি, অনার্স প্রথম শ্রেণি, ১৮তম শিক্ষক নিবন্ধনে উত্তীর্ণ সবই ছিল বিসিএসের পথে প্রস্তুতি। কিন্তু তিনি বেছে নেন বৃহত্তর ন্যায়ের সংগ্রাম। জীবনের বিনিময়ে রেখে যান একটি প্রশ্ন: “কেন মেধাবীরা বঞ্চিত হবে ?”

এক বছর পেরিয়ে গেছে। বিচারের প্রতিশ্রুতি অসংখ্য, কিন্তু ফলাফল হাতেগোনা। আইনের অধীন এক বিচারব্যবস্থা, যে প্রতিটি প্রান্তে গিয়ে থেমে যায় ক্ষমতার প্রাচীরে। জাতি কি এই ঋণ শোধ করবে শহীদ পরিবারগুলোর কাছে? আবু সাঈদের আত্মত্যাগ কি শুধু রক্তাক্ত প্রতিকৃতির মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে, নাকি বিচার নামক সেই পবিত্র প্রক্রিয়ায় ফিরবে তার সম্মান ? আবু সাঈদকে নিয়ে লেখা যাবে হাজার কবিতা, হাজার গান। কিন্তু সবচেয়ে জরুরি এখন একটাই কাজ বিচার নিশ্চিত করা।

সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই জুলাই, ২০২৫ বিকাল ৩:২৭
৬টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

বন্ডাইর মত হত্যাকাণ্ড বন্ধে নেতানিয়াহুদের থামানো জরুরি...

লিখেছেন নতুন নকিব, ১৬ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১১:২৫

বন্ডাইর মত হত্যাকাণ্ড বন্ধে নেতানিয়াহুদের থামানো জরুরি...

বন্ডাই সৈকতের হামলাস্থল। ছবি: রয়টার্স

অস্ট্রেলিয়ার সিডনির বন্ডাই সৈকত এলাকায় ইহুদিদের একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠানে সমবেত মানুষের ওপর দুই অস্ত্রধারী সন্ত্রাসী অতর্কিতে গুলি চালিয়েছে। এতে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আল্লাহ সর্বত্র বিরাজমাণ নন বলা কুফুরী

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ১৬ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:১৪



সূরাঃ ২ বাকারা, ২৫৫ নং আয়াতের অনুবাদ-
২৫৫। আল্লাহ, তিনি ব্যতীত কোন ইলাহ নেই।তিনি চিরঞ্জীব চির বিদ্যমাণ।তাঁকে তন্দ্রা অথবা নিদ্রা স্পর্শ করে না।আকাশ ও পৃথিবীতে যা কিছু আছে সমস্তই... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিজয়ের আগে রাজাকারের গুলিতে নিহত আফজাল

লিখেছেন প্রামানিক, ১৬ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৫:১৩


ঘটনা স্থল গাইবান্ধা জেলার ফুলছড়ি থানার উড়িয়া ইউনিয়নের গুণভরি ওয়াপদা বাঁধ।

১৯৭১সালের ১৬ই ডিসেম্বরের কয়েক দিন আগের ঘটনা। আফজাল নামের ভদ্রলোক এসেছিলেন শ্বশুর বাড়ি বেড়াতে। আমাদের পাশের গ্রামেই তার... ...বাকিটুকু পড়ুন

৫৫ বছর আগে কি ঘটেছে, উহা কি ইডিয়টদের মনে থাকে?

লিখেছেন জেন একাত্তর, ১৬ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৫:৫৮




ব্লগের অনেক প্রশ্নফাঁস ( Gen-F ) ১ দিন আগে পড়া নিউটনের ২য় সুত্রের প্রমাণ মনে করতে পারে না বলেই ফাঁসকরা প্রশ্নপত্র কিনে, বইয়ের পাতা কেটে পরীক্ষার হলে নিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

১৯৭১ সালে পাক ভারত যুদ্ধে ভারত বিজয়ী!

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ১৭ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৯


দীর্ঘ ২৫ বছরের নানা লাঞ্ছনা গঞ্জনা বঞ্চনা সহ্য করে যখন পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বীর বাঙালী অস্ত্র হাতে তুলে নিয়ে বীরবিক্রমে যুদ্ধ করে দেশ প্রায় স্বাধীন করে ফেলবে এমন সময় বাংলাদেশী ভারতীয়... ...বাকিটুকু পড়ুন

×