somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

জাতিসংঘের মানবাধিকার অফিস: কারো পৌষ মাস, কারো সর্বনাশ ।

২০ শে জুলাই, ২০২৫ রাত ১০:১০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনারের অফিস (OHCHR) সম্প্রতি বাংলাদেশে একটি স্থায়ী মিশন স্থাপনের জন্য সরকারের সঙ্গে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করেছে। এই ঘোষণার পরপরই দেশের রাজনৈতিক ও ধর্মীয় অঙ্গনে নানা প্রতিক্রিয়া দেখা যায়। বিশেষ করে বিষবৃক্ষ মহলে একধরনের অস্বস্তি ও আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে, যেখানে তারা এই মিশনকে দেশের সার্বভৌমত্বে হস্তক্ষেপ, সামাজিক অবক্ষয় বা পশ্চিমা আধিপত্যের অংশ বলে বিবেচনা করছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো : এই প্রতিক্রিয়াগুলো বাস্তবভিত্তিক, নাকি এগুলো ক্ষমতা হারানোর আশঙ্কা থেকে জন্ম নেওয়া প্রতিরোধমূলক চিৎকার?

বিষবৃক্ষ মহলের প্রধান যুক্তি হচ্ছে : OHCHR কেবলমাত্র যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশগুলোতেই মিশন স্থাপন করে। অথচ বাস্তবতা হলো, বর্তমান বিশ্বের ১৮টি OHCHR মিশনের মধ্যে মাত্র চারটি যুদ্ধ পরিস্থিতিতে রয়েছে যেমন: সিরিয়া, ইয়েমেন, সুদান ও ফিলিস্তিন। বাকি ১৪টি দেশ যেমন: মেক্সিকো, গুয়াতেমালা, কলম্বিয়া, নাইজার, তিউনিশিয়া ইত্যাদি দেশে কোনো যুদ্ধ নেই, বরং সেখানে দমননীতি, বিচারহীনতা এবং প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অধিকার হরণের মতো সমস্যা নিয়েই মিশন কাজ করছে। সুতরাং বাংলাদেশে যুদ্ধ নেই বলে এখানে মিশনের দরকার নেই এই যুক্তি একটি সরলীকরণ, যা বাস্তবতার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়।

আরেকটি জোরালো ভীতি ছড়ানো হচ্ছে যে, এই মিশন বাংলাদেশে LGBTQ+ অধিকারের প্রসার ঘটাবে। বাস্তবতা বলছে ভিন্ন কথা। তিউনিশিয়াতে ২০১১ সালে OHCHR মিশন স্থাপিত হওয়ার ১৫ বছর পরেও সেখানে সমকামিতা এখনো দণ্ডনীয় অপরাধ হিসেবে গণ্য হয়। বুরকিনা ফাসোতেও ক্ষমতায় আসার পর রাষ্ট্রপ্রধান সমকামিতাকে অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন, সেখানে OHCHR মিশন থাকা সত্ত্বেও। এমনকি বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় থেকেও পরিষ্কারভাবে জানানো হয়েছে যে, এই মিশন দেশের প্রচলিত আইন ও সামাজিক কাঠামোর বাইরে কোনো সামাজিক এজেন্ডা বাস্তবায়নের চেষ্টা করবে না। তাহলে ভয়টা আসলে কীসের ?

আরও একটি হাস্যকর অভিযোগ হলো, এই মিশনের মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রামকে স্বাধীন করে ফেলা হবে। এমন ধারণা কেবল রাজনৈতিক চাতুরী নয়, বরং একটি দুর্বল জাতীয়তাবাদী গুজব যা বিভ্রান্তি সৃষ্টির জন্য ছড়ানো হচ্ছে। তিনটি পার্বত্য জেলা নিয়ে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের ভাবনাই কতটা অবাস্তব, তা আর বিশ্লেষণের প্রয়োজন পড়ে না।

বিভ্রান্তি ছড়ানো হচ্ছে এমনও যে, OHCHR ফিলিস্তিন নিয়ে নাকি কোনো প্রতিবাদ করে না, তাই বাংলাদেশের জন্য তাদের দরদ প্রশ্নবিদ্ধ। বাস্তবে, OHCHR নিয়মিত ফিলিস্তিন নিয়ে রিপোর্ট প্রকাশ করে থাকে এবং ফ্রাঞ্চেসকা আলবানেসের মতো প্রতিনিধি সরাসরি ইসরায়েলের গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের নিন্দা করেছেন। তিনি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ফিলিস্তিনিদের পক্ষে এক শক্তিশালী কণ্ঠস্বর হিসেবে পরিচিত। তাই এটিও একটি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মিথ্যাচার।

তাহলে আসল অস্বস্তির জায়গাটা কোথায় ? কেন বিষবৃক্ষ মহলে এতটা প্যানিক করছে? কারণ, এই মিশনের মাধ্যমে বাংলাদেশে মানবাধিকার সংস্থাগুলোর ক্ষমতায়ন ঘটবে। তারা জানে, এতদিন তাদের সফট পাওয়ার বা low-intensity cultural jihad জাতীয় কার্যকলাপ যেমন: মাজার ভাঙা, নারী খেলাধুলায় বাধা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ঠেকানো, সংখ্যালঘুদের ওপর সহিংসতা বা ঐতিহাসিক স্থাপনা ধ্বংস এগুলো আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষণের আওতায় চলে আসবে। রিপোর্ট হবে, তদন্ত হবে, নাম প্রকাশিত হবে। এতদিন যা ছিল দেশের ভেতরের ব্যাপার, এখন তা হয়ে যাবে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার লঙ্ঘন।

এই মিশনের একটি বড় উদ্দেশ্য হলো ভবিষ্যতের সম্ভাব্য রাজনৈতিক পালাবদলের পর যাতে গণহত্যা, প্রতিশোধমূলক সহিংসতা বা শুদ্ধি অভিযান না ঘটে, সেই ব্যবস্থা আগে থেকেই গড়ে তোলা। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বহুবার বলেছেন: “ক্ষমতা হারালে রক্তের বন্যা বইবে।” তার এই বক্তব্যের মধ্যেই রয়েছে সেই আতঙ্কের ইঙ্গিত যে, তারা জানেন কতটা নির্যাতন তারা চালিয়েছেন। ২০২৪ সালের নির্বাচনের আগে বিদেশি দূতাবাসগুলোও একাধিকবার প্রশ্ন তুলেছে : সরকার বদল হলে কি বাংলাদেশে গণহত্যা ঘটবে ? আজ তা না ঘটলেও আগামীতে যে ঘটবে না, সে নিশ্চয়তা কে দেবে ?

তাই পশ্চিমা বিশ্ব এই মিশন বসিয়ে চাচ্ছে যেন পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে থাকে। যে কেউ ক্ষমতায় থাকুক, যেন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার কাঠামোর ভয়কে উপেক্ষা করে হিটলারি প্রতিশোধ চালাতে না পারে। এটা কেবল মানবিক কৌশল নয়, বরং রাজনৈতিক কৌশলও যাকে বলে ড্যামেজ কন্ট্রোল ফ্রম আফটারশক। যারা দমননীতি চালাতে সুযোগ খুজতেসে বা বিষবৃক্ষ সামাজিক প্রকল্প বাস্তবায়নে লিপ্ত ছিল, তাদের জন্য এটি একটি শক্ত বার্তা: সব কিছু বদলে গেলেও, তুমি নজরদারির বাইরে নয়। এই OHCHR মিশন আসলে কারো জন্য আশ্রয়, নিরাপত্তা, সুবিচার আবার কারো জন্য মুখোশ খুলে যাওয়ার আতঙ্ক। এটিই বাস্তবতা।

বাংলাদেশের জনগণের উচিত এই মিশনের রাজনৈতিক ও মানবিক মাত্রা দুই-ই গভীরভাবে বোঝা। অযৌক্তিক গুজব বা ভ্রান্ত আতঙ্কের জালে না পড়ে তথ্য ও বিশ্লেষণের আলোয় নিজের অবস্থান নির্ধারণ করা। এই মিশনের সফলতা নির্ভর করবে দেশের ভেতরকার জবাবদিহিতা, নাগরিক সচেতনতা এবং আন্তর্জাতিক চাপের ভারসাম্যের উপর।


সর্বশেষ এডিট : ২০ শে জুলাই, ২০২৫ রাত ১০:১৫
৪টি মন্তব্য ৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

বন্ডাইর মত হত্যাকাণ্ড বন্ধে নেতানিয়াহুদের থামানো জরুরি...

লিখেছেন নতুন নকিব, ১৬ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১১:২৫

বন্ডাইর মত হত্যাকাণ্ড বন্ধে নেতানিয়াহুদের থামানো জরুরি...

বন্ডাই সৈকতের হামলাস্থল। ছবি: রয়টার্স

অস্ট্রেলিয়ার সিডনির বন্ডাই সৈকত এলাকায় ইহুদিদের একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠানে সমবেত মানুষের ওপর দুই অস্ত্রধারী সন্ত্রাসী অতর্কিতে গুলি চালিয়েছে। এতে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আল্লাহ সর্বত্র বিরাজমাণ নন বলা কুফুরী

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ১৬ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:১৪



সূরাঃ ২ বাকারা, ২৫৫ নং আয়াতের অনুবাদ-
২৫৫। আল্লাহ, তিনি ব্যতীত কোন ইলাহ নেই।তিনি চিরঞ্জীব চির বিদ্যমাণ।তাঁকে তন্দ্রা অথবা নিদ্রা স্পর্শ করে না।আকাশ ও পৃথিবীতে যা কিছু আছে সমস্তই... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিজয়ের আগে রাজাকারের গুলিতে নিহত আফজাল

লিখেছেন প্রামানিক, ১৬ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৫:১৩


ঘটনা স্থল গাইবান্ধা জেলার ফুলছড়ি থানার উড়িয়া ইউনিয়নের গুণভরি ওয়াপদা বাঁধ।

১৯৭১সালের ১৬ই ডিসেম্বরের কয়েক দিন আগের ঘটনা। আফজাল নামের ভদ্রলোক এসেছিলেন শ্বশুর বাড়ি বেড়াতে। আমাদের পাশের গ্রামেই তার... ...বাকিটুকু পড়ুন

৫৫ বছর আগে কি ঘটেছে, উহা কি ইডিয়টদের মনে থাকে?

লিখেছেন জেন একাত্তর, ১৬ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৫:৫৮




ব্লগের অনেক প্রশ্নফাঁস ( Gen-F ) ১ দিন আগে পড়া নিউটনের ২য় সুত্রের প্রমাণ মনে করতে পারে না বলেই ফাঁসকরা প্রশ্নপত্র কিনে, বইয়ের পাতা কেটে পরীক্ষার হলে নিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

১৯৭১ সালে পাক ভারত যুদ্ধে ভারত বিজয়ী!

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ১৭ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৯


দীর্ঘ ২৫ বছরের নানা লাঞ্ছনা গঞ্জনা বঞ্চনা সহ্য করে যখন পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বীর বাঙালী অস্ত্র হাতে তুলে নিয়ে বীরবিক্রমে যুদ্ধ করে দেশ প্রায় স্বাধীন করে ফেলবে এমন সময় বাংলাদেশী ভারতীয়... ...বাকিটুকু পড়ুন

×