somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

উন্নয়নশীল দেশের রাজনীতি: একটি চিরন্তন প্রহসন

২৬ শে জুলাই, ২০২৫ রাত ১১:১২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


উন্নয়নশীল রাষ্ট্রসমূহের রাজনীতি এক অদ্ভুত ধরণের প্রহসন যেখানে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের বই আর বাস্তবতার মধ্যে সম্পর্ক ঠিক ততটাই যতটা আয়ুর্বেদ পুস্তক আর হোটেলের মেন্যুকার্ডের মধ্যে। রাজনীতিবিদগণ এখানে নির্বাচনকে বিবেচনা করেন একটি পর্বতসম নাটকের উদ্বোধনী দৃশ্য হিসেবে, যার প্রত্যেকটি দৃশ্যে তিনি চরিত্র বদলান, কিন্তু কাহিনি একই থাকে "আমি এসেছি দেশ গড়তে, কিন্তু প্রথমে গড়বো নিজস্ব অ্যাকাউন্ট।"

এইসব দেশে রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য কেবল একটি জিনিসই প্রয়োজন : সাহসিক নির্লজ্জতা। দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত হয়ে যে মন্ত্রী পদত্যাগ করেন, তিনিই পরদিন জাতিকে নৈতিকতার ভাষণ দেন। দায়বদ্ধতা শব্দটি এখানে রাজনীতির অভিধানে আছে ঠিকই, তবে তার মানে হয়েছে “কাউকে দায়ী করো, দায় নিও না।” পূর্ববর্তী সরকারের অপকর্ম গুনে গুনে বলার মধ্যে একধরনের পরিশীলিত পেশাদারিত্ব রয়েছে; এমনকি মনে হয় যেন বিরোধী দলের সকল নেতা অর্থ মন্ত্রণালয়ের অডিট অফিসার ছিলেন।

জনগণের প্রতি এই ব্যবস্থার সবচাইতে নির্মম ব্যঙ্গ হলো এই রাষ্ট্রের সব নেতারই কণ্ঠে থাকে ‘গণতন্ত্র’ শব্দটি, কিন্তু আচরণে থাকে ‘বংশতন্ত্র’, মননে থাকে ‘অজ্ঞতন্ত্র’ এবং ব্যবস্থায় থাকে ‘লোভতন্ত্র’। ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য এইসব দেশগুলোতে রাজনীতিবিদদের যে যত বেশি প্রতিশ্রুতি দিতে পারে, সে তত বেশি জনপ্রিয়। বাস্তবায়নের হিসাব কেউ চায় না কারণ সবাই জানে, এই প্রতিশ্রুতি আসলে বছরে একবারের মতন ঈদের সেমাই : মিষ্টি, অস্থায়ী, আর অদৃশ্য।

উন্নয়নশীল রাষ্ট্রে সরকারের কাঠামো আসলে উদ্বোধন-কেন্দ্রিক। একটি রাস্তাকে তিনজন মন্ত্রী, দুইজন এমপি এবং একজন ওয়ার্ড কমিশনার আলাদাভাবে উদ্বোধন করেন কাজ কিন্তু একটাও হয় না। ফিতা কাটা আর ছবি তোলা যেন প্রকল্পের সারসংক্ষেপ। যদি কেউ প্রশ্ন তোলে “এত উদ্বোধন কেন?”,তখন বলা হয়: “গণতন্ত্রে অংশগ্রহণের অধিকার সবার আছে!”

এইসব রাষ্ট্রে তথাকথিত উন্নয়ন এক প্রকার রাষ্ট্রীয় বাজি: আজকের মেগা প্রজেক্ট আগামীকালের মেগা দুর্নীতি। এখানে পরিসংখ্যান দিয়ে সত্যকে ঢেকে ফেলা হয়, অর্থনীতির সংকটকে সাফল্য বলা হয়, এবং দরিদ্রের আর্তনাদকে নেতিবাচক পলিটিক্স বলে প্রত্যাখ্যান করা হয়। একবার একজন নেতা বলেছিলেন, "আমরা দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হতে দেব না।” অথচ দেশের অর্থনীতি তখন ICU-তে ছিল। ভাবমূর্তিই যদি মুখ্য হয়, তাহলে রাষ্ট্র কেন হাসপাতাল না হয়ে বিলবোর্ড হয়ে উঠছে ?

এই ব্যবস্থার একটি অদ্ভুত দিক হলো, সব রাজনীতিবিদই নিজেকে জনগণের সন্তান দাবি করেন, কিন্তু ক্ষমতায় যাওয়ার পর ঈশ্বর হয়ে ওঠেন। সমালোচনা করলে বলে “আপনিও তো ভোট দিয়েছেন”; যেন ভোটার একটা আজীবন চুক্তিপত্রে সই করে ফেলেছেন: “তুমি চুরি করো, আমি গালি খাবো!”

এমনকি ধর্মও এখানে রাজনীতির খেলার মোহর হয়ে গেছে। নির্বাচনের সময় ঈমান-আকিদা নিয়ে বক্তৃতা চলে, তারপর শপথ শেষে টাকার বান্ডিলে ওজু করা হয়। শিক্ষা ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে দিয়ে বলা হয়, “আমরা প্রযুক্তিনির্ভর প্রজন্ম গড়ছি”; অথচ সেই প্রজন্ম শুধু কোচিং সেন্টারের শিকার আর ভবিষ্যতের মন্ত্রী হওয়ার স্বপ্নে মিথ্যার জগতে বন্দি।

সবশেষে এই ব্যবস্থার সারাংশ যদি এক বাক্যে বলতে হয়, তা হবে: এই রাষ্ট্রে রাজনীতির ধর্ম হলো চুরি, নীতির উৎস হলো বিভ্রান্তি, আর গণতন্ত্রের প্রতীক হলো চেয়ারে থাকা মানুষের অদলবদল। এটা সেই ব্যবস্থার চূড়ান্ত রূপক যেখানে রাষ্ট্র চলে নীতিহীনতা আর স্মারক বক্তৃতার উপর। যেখানে জনগণ নিজের জীবনের চেয়ে নেতার ভাষণ বেশি মুখস্থ রাখে, আর ভোটের দিন নিজেরই প্রতারণা উৎসব করে।

উন্নয়নশীল দেশের রাজনীতিকে একটি কৌতুকের সাথে তুলনা করলে ভুল হবে না। এখানে সবাই অভিনয় করে। একজন অভিনেতা যায়, আরেকজন আসে। কিন্তু স্ক্রিপ্টটা একই থাকে। পার্থক্য কেবল অভিনেতাদের চেহারায়। এরকম পরিস্থিতি দেখে যখন কোনো পর্যটক জিজ্ঞেস করেন, "এই দেশটা কে চালাচ্ছে ?" তখন ধর্মচর্চা ছাড়া আর কোনো উপায় থাকে না। কারণ ঈশ্বরই আমাদের দেশের একমাত্র ভরসা।

সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে জুলাই, ২০২৫ রাত ১১:৫৬
৯টি মন্তব্য ৯টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

জামাত কি দেশটাকে আবার পূর্ব পাকিস্তান বানাতে চায়? পারবে?

লিখেছেন ঋণাত্মক শূণ্য, ১৭ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৭:২৮

অন্য যে কোন সময়ে জামাতকে নিয়ে মানুষ যতটা চিন্তিত ছিলো, বর্তমানে তার থেকে অনেক বেশী চিন্তিত বলেই মনে করি।



১৯৭১ এ জামাতের যে অবস্থান, তা নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের অস্তিত্বের বিরুদ্ধে... ...বাকিটুকু পড়ুন

১৯৭১ সালে পাক ভারত যুদ্ধে ভারত বিজয়ী!

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ১৭ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৯


দীর্ঘ ২৫ বছরের নানা লাঞ্ছনা গঞ্জনা বঞ্চনা সহ্য করে যখন পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বীর বাঙালী অস্ত্র হাতে তুলে নিয়ে বীরবিক্রমে যুদ্ধ করে দেশ প্রায় স্বাধীন করে ফেলবে এমন সময় বাংলাদেশী ভারতীয়... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইন্দিরা গান্ধীর চোখে মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশ-ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক: ওরিয়ানা ফলাচির সাক্ষাৎকার

লিখেছেন শ্রাবণধারা, ১৭ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১১:৫৫


১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ইতালীয় সাংবাদিক ওরিয়ানা ফলাচি ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সাক্ষাৎকার নেন। এই সাক্ষাৎকারে মুক্তিযুদ্ধ, শরনার্থী সমস্যা, ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক, আমেরিকার সাম্রাজ্যবাদী পররাষ্ট্রনীতি এবং পাকিস্তানে তাদের সামরিক... ...বাকিটুকু পড়ুন

=যাচ্ছি হেঁটে, সঙ্গে যাবি?=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ১৭ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সন্ধ্যা ৭:০৬


যাচ্ছি হেঁটে দূরের বনে
তুই কি আমার সঙ্গি হবি?
পাশাপাশি হেঁটে কি তুই
দুঃখ সুখের কথা ক'বি?

যাচ্ছি একা অন্য কোথাও,
যেখানটাতে সবুজ আলো
এই শহরে পেরেশানি
আর লাগে না আমার ভালো!

যাবি কি তুই সঙ্গে আমার
যেথায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

আগামী নির্বাচন কি জাতিকে সাহায্য করবে, নাকি আরো বিপদের দিকে ঠেলে দিবে?

লিখেছেন জেন একাত্তর, ১৭ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৮:১২



আগামী নির্বচন জাতিকে আরো কমপ্লেক্স সমস্যার মাঝে ঠেলে দিবে; জাতির সমস্যাগুলো কঠিন থেকে কঠিনতর হবে। এই নির্বাচনটা মুলত করা হচ্ছে আমেরিকান দুতাবাসের প্রয়োজনে, আমাদের দেশের কি হবে, সেটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

×