
বাংলাদেশের মানুষ গুজবপ্রিয় - এ কথা সর্বপ্রথম আনুষ্ঠানিকভাবে কবিতায় প্রকাশ করেছিলেন কবি শামসুর রহমান তার 'পণ্ডশ্রম' কবিতায়। গতকালের ঘটনায় আমরা শামসুর রহমানের সেই পণ্ডশ্রমের আরেকটি বাস্তব উদাহরণ দেখতে পেলাম। নতুন একটি রাজনৈতিক দলের নেতাদের অবকাশ যাপনকে কেন্দ্র করে প্রতিপক্ষ দলগুলো যে হুইসপার ক্যাম্পেইন চালিয়েছে, সেটা অবিশ্বাস্য।
এই ক্যাম্পেইনে যোগ দিয়েছে বাংলাদেশের হলুদ মিডিয়া। এসব মিডিয়া তিলকে তাল করার ব্যাপারে বহু বছর ধরে ট্রেনিংপ্রাপ্ত। বাংলাদেশের মিডিয়াগুলোর সাংবাদিকদের মধ্যে কম পরিশ্রমে খবর সংগ্রহের প্রবণতা রয়েছে। এরই প্রেক্ষিতে তারা অনেক সময় ইউটিউবারদের বিভিন্ন বক্তব্য ও অসমর্থিত সূত্রের উপর ভিত্তি করে নিউজ করে থাকে। নিজেদের সোর্স থেকে কোনো নিউজ সংগ্রহ করতে পারে না। সারাদিন বাসায় শুয়ে বসে পানু দেখলে কেবল মানুষের মধ্যে এমন অক্ষমতা দেখা যায়।
বাংলাদেশের মিডিয়া এনসিপি নেতাদের সাথে কক্সবাজারে আমেরিকার সাবেক রাষ্ট্রদূত পিটার ডি হাসের গোপন বৈঠকের খবর পায় ইউটিউব চ্যানেল নাগরিক টিভির সাংবাদিক নাজমুস সাকিবের কাছ থেকে। বিএনপিপন্থী এই ইউটিউবার এক গল্প ফেঁদেছিলেন যে নির্বাচন বানচাল করতে নাকি এই বৈঠক করেছেন এনসিপি নেতারা। তারা পিটার ডি হাসকে হাতে পায়ে ধরে নাকি অনুরোধ করেছেন যাতে প্রধান উপদেষ্টা নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা না করেন। মুহূর্তেই এই খবরে সয়লাব হয়ে যায় নিউজ মিডিয়া। যুগান্তরের বরাতে আমরা জানতে পারি সি পার্ল হোটেলের ১/২ জন স্টাফ নাকি দেখেছেন পিটার হাসের মতো একজনকে হোটেলে। ব্যস, শুরু হয়ে গেল ইউটিউবারদের ভিডিও বানানোর উৎসব।
গুজববাজ পিনাকি-ইলিয়াসের পদাঙ্ক অনুসরণ করে এমন সব ভিডিও বানানো শুরু করলো ইউটিউবাররা যা সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করে । এর সাথে বিভিন্ন খবরের কাগজ ফটোকার্ড ছাপাতে শুরু করে একটা গুজবকে সত্য ঘটনা বলে প্রচার করতে থাকে। বিএনপি সমর্থিত পেইজগুলো ও ইউটিউবার শাহেদ আলম কড়া স্ট্যাটাস এবং ভিডিও বানিয়ে পরিস্থিতি আরো জটিল করে তোলেন। এদিকে পতিত শক্তি নিষিদ্ধ দলটিও নিজ নিজ পেইজ ও গ্রুপ থেকে সোশ্যাল মিডিয়ায় এসব শেয়ার করতে থাকে। আওয়ামী ঘরানার গুজববাজ ইউটিউবার মাসুদ কামাল এবং মনজুরুল পান্নার আগুনে ঘি ঢালার কাজটি সুন্দরভাবে সম্পন্ন করলেন।
এনসিপির চার থেকে পাঁচজন নেতা কক্সবাজার গিয়েছিলেন অবকাশ যাপন করতে। যখন পিটার ডি হাসের সাথে তাদের যোগাযোগের গুঞ্জন ওঠে, তখন নাসিরুদ্দিন পাটোয়ারী জানান এসব গুজব। তারা কারো সাথে দেখা করতে আসেননি। জুলাই পদযাত্রার পরে তাদের রিফ্রেশমেন্টের জন্য তারা কক্সবাজারে এসেছিলেন। এদিকে ইউটিউবার সাংবাদিক মাসুদ কামাল তার ইউটিউব ভিডিওতে প্রশ্ন তুলেছেন : সি পার্ল হোটেলে প্রতি রুম ভাড়া আঠারো হাজার টাকা, এত টাকা নেতারা কোথা থেকে পেলেন? তারা কেন জুলাই ঘোষণাপত্রের অনুষ্ঠানে যোগ দিলেন না? কেন মাত্র একজন নারী নেত্রী ও বাকি সব পুরুষ নেতা গেলেন? কেন পুরুষ নেতারা স্ত্রী নিয়ে গেলেন না? কেন মাত্র চার ঘণ্টার জন্য অবসর বিনোদনে গেলেন? নানা রকম হাবিজাবি কথায় পরিস্থিতিকে জটিল করে তোলার কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন।
সাংবাদিক গোলাম মর্তুজার বরাতে আমরা জানতে পারি পিটার ডি হাস নাকি এখন আমেরিকায়। আমেরিকান দূতাবাস থেকে জানানো হয় পিটার ডি হাস এখন অবসরে, দূতাবাসের সাথে এখন তার যোগাযোগ নেই। গতবছর জুলাই মাসে বাংলাদেশ থেকে বিদায়ী রাষ্ট্রদূত হিসাবে চলে যান পিটার ডি হাস। পরে তিনি আমেরিকার সরকারি চাকরি থেকেও অবসর নেন। এর মাত্র তিনদিন পর তিনি যুক্তরাষ্ট্রের এলএনজি কোম্পানি এক্সিলারেট এনার্জির স্ট্র্যাটেজিক অ্যাডভাইজার হিসাবে বাংলাদেশে চাকরি নিয়ে আসেন। তার এই নিয়োগ নিয়ে নানারকম কানাঘুষা রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের অবসরপ্রাপ্ত রাষ্ট্রদূতেরা কমপক্ষে ছয় মাস থেকে দুই বছরের মধ্যে বেসরকারি কোনো কোম্পানিতে, যেসব দেশে রাষ্ট্রদূত হিসাবে ছিলেন সেসব দেশে চাকরি করতে পারবেন না।
সোশ্যাল মিডিয়ায় নাকি ভিডিও ছড়িয়ে পড়ে যেখানে দেখা যায় পিটার ডি হাস বোরখা পরে এনসিপির নেতাদের সাথে ঘুরতে দেখা যায়। বাংলা সিনেমা দেখে দেখে মানুষের মাঝে এমন সব ধারণা তৈরি হয়েছে যা এসব গুজব ছড়াতে সহায়তা করছে। পিটার ডি হাসের মতো ব্যক্তি কেন এতো গোপনীয়তা কিংবা বোরখা পরে এনসিপি নেতাদের সাথে দেখা করতে হবে? সরাসরি ঢাকায় দেখা করলে তাদের ক্ষতি করার সাহস কার পাবে? পিটার ডি হাসের পক্ষে কি এখন যুক্তরাষ্ট্রের বার্তা বহন করা সম্ভব? যেখানে যুক্তরাষ্ট্রের চার্জ ডি অ্যাফেয়ার্স ট্রেসি এন এখনো দেশে আছেন, সেখানে আমেরিকা কেন অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা দিয়ে এনসিপি নেতাদের সাথে যোগাযোগ করবে?
এনসিপির চার-পাঁচজন নেতা কেন জুলাই ঘোষণাপত্রে যোগ দেননি তা নিয়ে চলছে বিস্তর গবেষণা। বাংলাদেশে অপ্রয়োজনীয় বিষয় নিয়ে গবেষণা হয় বেশি। হান্নান মাসুদ সকালেই বলেছেন তারা যাবেন না জুলাই ঘোষণাপত্রের অনুষ্ঠানে কারণ ১৫৮ জন সমন্বয়ককে দাওয়াত দেওয়া হয়নি। হাসনাত, পাটোয়ারীও সে কারণে যোগ দিচ্ছেন না। আসল কারণ হচ্ছে তারা আগে থেকেই জানেন এই ঘোষণাপত্রে কী লেখা রয়েছে। দুইজন ছাত্র উপদেষ্টা সরকারে আছেন, তারাই জুলাই ঘোষণাপত্র আগেই জানিয়ে দিয়েছেন। যেহেতু দায়মুক্তি দেওয়া হয়েছে তাই আর এসব নিয়ে বেশি লাফালাফি করার দরকার নেই।
এদিকে এসব ঘটনাকে কেন্দ্র করে মিলিয়ন ভিউ কামিয়ে নিলো নিকৃষ্ট মিডিয়া ও ইউটিউবাররা। এ ঘটনা থেকে এনসিপি গোষ্ঠীর শেখার বিষয় হলো - তারা যেমন অন্য দলের বিপক্ষে গুজববাজদের দিয়ে গুজব ছড়িয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করেন, একই কাজ তাদের বিরুদ্ধে করার জন্যও লক্ষ মানুষ বসে আছেন। তাই সাধু সাবধান।

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।


