
জুলাই আন্দোলনের পর বাংলাদেশের রাজনীতিতে সবচেয়ে বেশি যে নতুন শব্দগুলো শোনা যাচ্ছে, তার মধ্যে ‘এনসিপি’ বা জাতীয় নাগরিক পার্টি অন্যতম। একসময় যারা দেশজুড়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছেন, তারাই এখন দেশের ভবিষ্যৎ দিকনির্দেশনা নিয়ে ভাবছেন। আর এই ভাবনার প্রক্রিয়াটিও বেশ অভিনব। সাধারণত রাজনৈতিক নেতারা যখন ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তাভাবনা করেন, তখন তারা দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে বা কোনো নীতিনির্ধারণী বৈঠকে বসেন। কিন্তু আমাদের নতুন যুগের এই নেতারা দেখালেন, বড় বড় চিন্তাভাবনা করার জন্য সাগর পাড়ের শান্ত পরিবেশই উপযুক্ত।
সম্প্রতি, এনসিপি'র মুখ্য সমন্বয়ক নাসিরুদ্দীন পাটোয়ারী ঘোষণা করেছেন যে তিনি ‘ঘুরতে গিয়েছিলেন’, তবে এটি কেবল সাধারণ ঘোরাঘুরি ছিল না। এর পেছনে ছিল এক গভীর দার্শনিক উদ্দেশ্য: ‘রাজনীতির ভবিষ্যৎ দিকনির্দেশনা নিয়ে একান্ত চিন্তাভাবনা করা।’ তিনি সাগর পারে বসে গভীর মনোযোগে ধ্যান করেছেন গণ-অভ্যুত্থান, নাগরিক কমিটি, নাগরিক পার্টির কাঠামো, ভবিষ্যৎ গণপরিষদ এবং একটি নতুন গণতান্ত্রিক সংবিধানের রূপরেখা নিয়ে।
এই দৃশ্যটি একদিকে যেমন হাস্যকর, অন্যদিকে তেমনি চিন্তার খোরাক জোগায়। যেখানে পুরো দেশজুড়ে এনসিপি'র বিরুদ্ধে আর্থিক দুর্নীতির অভিযোগ উঠছে, তাদের রাজনৈতিক এজেন্ডা নিয়ে অস্পষ্টতা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে, সেখানে দলের একজন বড়ো নেতা সাগর পাড়ে বসে নতুন সংবিধান রচনার রূপরেখা নিয়ে ভাবছেন। বিষয়টি অনেকটা এমন যে, নৌকা ফুটো হয়ে জল ঢুকছে, কিন্তু নৌকার মাঝি নৌকার কোথায় নতুন নকশা করা যায়, তা নিয়ে ভাবছেন। এই 'সাগরকূলীয় দর্শন' কি এনসিপি'র রাজনৈতিক অস্পষ্টতারই প্রতিফলন? নাকি এটি সাধারণ মানুষের মনোযোগ অন্য দিকে সরিয়ে নেওয়ার একটি অভিনব কৌশল?
আমরা জানি, রাজনীতিতে স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এনসিপিকে ঘিরে যে অভিযোগগুলো উঠেছে, তার সুনির্দিষ্ট জবাব না দিয়ে এভাবে 'দার্শনিক' ভঙ্গিমায় ঘুরে বেড়ানো সাধারণ মানুষের মনে আরও প্রশ্ন তৈরি করে। জনগণের প্রত্যাশা ছিল, জুলাই আন্দোলনের পর এই তরুণ নেতৃত্ব দেশের পুরনো রাজনৈতিক সংস্কৃতি থেকে বের হয়ে আসবে এবং একটি সৎ ও স্বচ্ছ রাজনীতির দৃষ্টান্ত স্থাপন করবে। কিন্তু এক বছরের মাথায়ই যদি তাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে, তাহলে প্রশ্ন জাগে: এই আন্দোলন কি শুধু শাসক পরিবর্তনের জন্য ছিল, নাকি সত্যিই একটি গুণগত পরিবর্তনের জন্য?
নাসীরুদ্দীন পাটোয়ারীর এই ‘একান্তে চিন্তাভাবনা’র পর হয়তো এনসিপি একটি নতুন রাজনৈতিক দর্শন নিয়ে হাজির হবে। হয়তো তারা ঘোষণা করবে, তাদের নতুন সংবিধানের প্রথম ধারা হবে 'সাগর দর্শনের মূলনীতি'। আমরা আশা করি, সেই নতুন সংবিধানে অন্তত একটি বিষয় পরিষ্কার থাকবে: দলের তহবিলের হিসাব কি সাগর পাড়ের ঢেউ গুনে গুনে করা হবে, নাকি তা প্রকাশ্য করা হবে। কারণ, জনগণের আস্থাই যেকোনো রাজনৈতিক দলের সবচেয়ে বড় শক্তি। আর সেই আস্থাকে ধরে রাখতে গেলে সাগর পাড়ের দর্শন নয়, প্রয়োজন মাঠের রাজনীতিতে স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহি।
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই আগস্ট, ২০২৫ রাত ৯:১৭

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



