somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

অধ্যাপক ইউনূস কি জেনেবুঝে 'ফ্যাসিবাদ' শব্দটি ব্যবহার করছেন?

১৪ ই আগস্ট, ২০২৫ রাত ১১:৫৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস সম্প্রতি বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে একটি সাক্ষাৎকারে গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য করেছেন। তিনি পূর্ববর্তী সরকারকে "ফ্যাসিবাদী শাসন ব্যবস্থা" আখ্যায়িত করেছেন। সিএনএ-এর প্রশ্নে তিনি জানান, অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা নির্বাচিত হওয়ার এক বছর পর চারটি নির্দিষ্ট লক্ষ্য অর্জনের পথ চলছিল। তার মধ্যে একটি প্রধান লক্ষ্য ছিল সংস্কার, বিশেষ করে রাজনৈতিক ও নির্বাচন ব্যবস্থার দুর্নীতি ও শোষণ দূর করা, যা তাঁর মতে ফ্যাসিস্ট সরকারকে গড়ে তুলে দেশের অর্থনীতি ও সমাজকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। সিএনএ সাংবাদিক জিজ্ঞাসা করেন, "আপনি এটাকে ফ্যাসিবাদী শাসন ব্যবস্থা বলছেন?" ড. ইউনূস বললেন, "হ্যাঁ, অবশ্যই।" যখন সিএনএ জানতে চায়, "এটা কোন দিক দিয়ে ফ্যাসিবাদ?" ড. ইউনূস উত্তর দেন, "কারণ, এটি কোনো আইনের শাসন তৈরি করে না।" এটা খুব সাধারণ অভিযোগ, কিন্তু ফ্যাসিবাদের বৈশিষ্ট্য ব্যাখ্যা করার জন্য একটু বেশি নির্দিষ্টতা দরকার ছিল। শুধু আইনের শাসন নেই বললে সেটা কেন ফ্যাসিবাদ, সেই যৌক্তিক সেতুটা পুরোপুরি স্পষ্ট হয় না।

একজন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ব্যক্তিত্ব হিসাবে ‘ফ্যাসিবাদ’ শব্দটি ব্যবহারের যথার্থতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা যায় । ফ্যাসিবাদের সুনির্দিষ্ট অর্থ এবং ঐতিহাসিক ব্যাখ্যা অনুসারে, এটি একটি রাজনীতির মতাদর্শ যা রাষ্ট্রের সর্বোচ্চত্ব, জাতিগত বিশুদ্ধতা এবং সহিংস নিধনের ওপর গুরুত্ব দেয়। হিটলার ও মুসোলিনির সময়কার রাষ্ট্রগুলো ছিল এই ফ্যাসিবাদের প্রকৃত রূপ। ইউরোপীয় রাজনীতিবিদরা শেখ হাসিনার শাসনামলকে ‘কর্তৃত্ববাদী স্বৈরশাসক’ হিসেবে বিবেচনা করেন, কিন্তু ফ্যাসিবাদ বলে প্রকাশ করেন না। কারণ, তারা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতা প্রত্যক্ষ করেছে এবং ফ্যাসিবাদের প্রকৃত অর্থ ও ভয়াবহতা সম্পর্কে ভালোভাবে জানেন। আইনের শাসনহীনতা বা দুর্নীতি এবং স্বৈরতন্ত্র মানেই ফ্যাসিবাদ নয়।

শেখ হাসিনা সরকারের গত ৫ আগস্টের নিন্দনীয় কর্মকাণ্ড আন্তর্জাতিক আইনের দৃষ্টিকোণ থেকে এটিকে 'মানবতাবিরোধী অপরাধ' (Crimes Against Humanity) এর অধীনে ফেলা যায়, 'গণহত্যা' (Genocide) বা ‘ফ্যাসিবাদী শাসন’ হিসাবে চিহ্নিত করা যায় না । কারণ এখানে কোনো নির্দিষ্ট জাতি বা ধর্মের উদ্দেশ্যমূলক ধ্বংস ছিল না। শেখ হাসিনার শাসন ব্যবস্থায় স্বৈরাচারী উপাদান থাকলেও এটি ঐতিহাসিক ফ্যাসিবাদের সঙ্গে সরাসরি তুলনীয় নয়। এখানে জাতিগত শ্রেষ্ঠত্ব, পূর্ণাঙ্গ ফ্যাসিস্ট পার্টি-মিলিশিয়া কাঠামো বা গণহত্যার মতো ব্যাপার নেই। বরং এটি আধুনিক, স্বৈরাচারী শাসনের একটি রূপ যা বিরোধী দল ও মতাদর্শের ওপর সীমাবদ্ধতা আরোপ করে, নির্বাচনী এবং সাংবিধানিক নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখে।

একজন নোবেল বিজয়ী হিসেবে ড. ইউনূসের মন্তব্য বিশ্বব্যাপী গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ করা হয়। তাই রাজনৈতিক শব্দের যথার্থ ব্যবহার এবং দায়িত্বশীলতা তার কাছ থেকে বিশেষ জরুরি। যদি তিনি ‘ফ্যাসিবাদ’ ও ‘স্বৈরতন্ত্র’ এর প্রকৃত পার্থক্য না বুঝেন, তবে আন্তর্জাতিক পরিভাষার ভুল প্রয়োগ করা থেকে বিরত থাকা উচিত । আবার যদি সচেতনভাবে অতিরঞ্জিত ভাষা ব্যবহার করে থাকেন, তবে তা তার একাডেমিক ও নৈতিক অবস্থানের সঙ্গে বৈপরীত্যপূর্ণ।

গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা ও নোবেল বিজয়ী হিসেবে ড. ইউনূসের উচিত ছিল রাজনৈতিক বিতর্কে সংযত ও সঠিক ভাষা ব্যবহার করে দেশের ঐক্য ও সংহতির পথ সুগম করা। উদাহরণস্বরূপ, তিনি বলতে পারতেন, “এটি একটি কর্তৃত্ববাদী শাসন ব্যবস্থা, যেখানে আইনের শাসন ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের চরম অবনতি হয়েছে।” এই বক্তব্য আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য, একাডেমিকভাবে সঠিক এবং বিভক্তিকরও নয়।

ড. ইউনূসের ‘ফ্যাসিবাদ’ মন্তব্য একটি গুরুতর সংকেত বহন করে তিনি হয় গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক পরিভাষার প্রকৃত অর্থ বোঝেন না, অথবা রাজনৈতিক সুবিধার জন্য অতিশয়োক্তিপূর্ণ ভাষা ব্যবহার করছেন। বাংলাদেশের মতো সংবেদনশীল রাজনৈতিক পরিবেশে এ ধরনের মন্তব্য পরিমিত, সঠিক ও গঠনমূলক হওয়া উচিত। শব্দের শক্তি অপরিসীম; তাই একজন বিশ্বমানের ব্যক্তিত্বকে তার প্রতিটি কথাতে দায়িত্বশীল হতে হবে, রাজনৈতিক মনোভাব থেকে নয়।

সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই আগস্ট, ২০২৫ রাত ১১:৫৯
১৮টি মন্তব্য ১৮টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

জামাত কি দেশটাকে আবার পূর্ব পাকিস্তান বানাতে চায়? পারবে?

লিখেছেন ঋণাত্মক শূণ্য, ১৭ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৭:২৮

অন্য যে কোন সময়ে জামাতকে নিয়ে মানুষ যতটা চিন্তিত ছিলো, বর্তমানে তার থেকে অনেক বেশী চিন্তিত বলেই মনে করি।



১৯৭১ এ জামাতের যে অবস্থান, তা নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের অস্তিত্বের বিরুদ্ধে... ...বাকিটুকু পড়ুন

১৯৭১ সালে পাক ভারত যুদ্ধে ভারত বিজয়ী!

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ১৭ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৯


দীর্ঘ ২৫ বছরের নানা লাঞ্ছনা গঞ্জনা বঞ্চনা সহ্য করে যখন পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বীর বাঙালী অস্ত্র হাতে তুলে নিয়ে বীরবিক্রমে যুদ্ধ করে দেশ প্রায় স্বাধীন করে ফেলবে এমন সময় বাংলাদেশী ভারতীয়... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইন্দিরা গান্ধীর চোখে মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশ-ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক: ওরিয়ানা ফলাচির সাক্ষাৎকার

লিখেছেন শ্রাবণধারা, ১৭ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১১:৫৫


১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ইতালীয় সাংবাদিক ওরিয়ানা ফলাচি ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সাক্ষাৎকার নেন। এই সাক্ষাৎকারে মুক্তিযুদ্ধ, শরনার্থী সমস্যা, ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক, আমেরিকার সাম্রাজ্যবাদী পররাষ্ট্রনীতি এবং পাকিস্তানে তাদের সামরিক... ...বাকিটুকু পড়ুন

=যাচ্ছি হেঁটে, সঙ্গে যাবি?=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ১৭ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সন্ধ্যা ৭:০৬


যাচ্ছি হেঁটে দূরের বনে
তুই কি আমার সঙ্গি হবি?
পাশাপাশি হেঁটে কি তুই
দুঃখ সুখের কথা ক'বি?

যাচ্ছি একা অন্য কোথাও,
যেখানটাতে সবুজ আলো
এই শহরে পেরেশানি
আর লাগে না আমার ভালো!

যাবি কি তুই সঙ্গে আমার
যেথায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

আগামী নির্বাচন কি জাতিকে সাহায্য করবে, নাকি আরো বিপদের দিকে ঠেলে দিবে?

লিখেছেন জেন একাত্তর, ১৭ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৮:১২



আগামী নির্বচন জাতিকে আরো কমপ্লেক্স সমস্যার মাঝে ঠেলে দিবে; জাতির সমস্যাগুলো কঠিন থেকে কঠিনতর হবে। এই নির্বাচনটা মুলত করা হচ্ছে আমেরিকান দুতাবাসের প্রয়োজনে, আমাদের দেশের কি হবে, সেটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

×