
নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস সম্প্রতি বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে একটি সাক্ষাৎকারে গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য করেছেন। তিনি পূর্ববর্তী সরকারকে "ফ্যাসিবাদী শাসন ব্যবস্থা" আখ্যায়িত করেছেন। সিএনএ-এর প্রশ্নে তিনি জানান, অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা নির্বাচিত হওয়ার এক বছর পর চারটি নির্দিষ্ট লক্ষ্য অর্জনের পথ চলছিল। তার মধ্যে একটি প্রধান লক্ষ্য ছিল সংস্কার, বিশেষ করে রাজনৈতিক ও নির্বাচন ব্যবস্থার দুর্নীতি ও শোষণ দূর করা, যা তাঁর মতে ফ্যাসিস্ট সরকারকে গড়ে তুলে দেশের অর্থনীতি ও সমাজকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। সিএনএ সাংবাদিক জিজ্ঞাসা করেন, "আপনি এটাকে ফ্যাসিবাদী শাসন ব্যবস্থা বলছেন?" ড. ইউনূস বললেন, "হ্যাঁ, অবশ্যই।" যখন সিএনএ জানতে চায়, "এটা কোন দিক দিয়ে ফ্যাসিবাদ?" ড. ইউনূস উত্তর দেন, "কারণ, এটি কোনো আইনের শাসন তৈরি করে না।" এটা খুব সাধারণ অভিযোগ, কিন্তু ফ্যাসিবাদের বৈশিষ্ট্য ব্যাখ্যা করার জন্য একটু বেশি নির্দিষ্টতা দরকার ছিল। শুধু আইনের শাসন নেই বললে সেটা কেন ফ্যাসিবাদ, সেই যৌক্তিক সেতুটা পুরোপুরি স্পষ্ট হয় না।
একজন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ব্যক্তিত্ব হিসাবে ‘ফ্যাসিবাদ’ শব্দটি ব্যবহারের যথার্থতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা যায় । ফ্যাসিবাদের সুনির্দিষ্ট অর্থ এবং ঐতিহাসিক ব্যাখ্যা অনুসারে, এটি একটি রাজনীতির মতাদর্শ যা রাষ্ট্রের সর্বোচ্চত্ব, জাতিগত বিশুদ্ধতা এবং সহিংস নিধনের ওপর গুরুত্ব দেয়। হিটলার ও মুসোলিনির সময়কার রাষ্ট্রগুলো ছিল এই ফ্যাসিবাদের প্রকৃত রূপ। ইউরোপীয় রাজনীতিবিদরা শেখ হাসিনার শাসনামলকে ‘কর্তৃত্ববাদী স্বৈরশাসক’ হিসেবে বিবেচনা করেন, কিন্তু ফ্যাসিবাদ বলে প্রকাশ করেন না। কারণ, তারা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতা প্রত্যক্ষ করেছে এবং ফ্যাসিবাদের প্রকৃত অর্থ ও ভয়াবহতা সম্পর্কে ভালোভাবে জানেন। আইনের শাসনহীনতা বা দুর্নীতি এবং স্বৈরতন্ত্র মানেই ফ্যাসিবাদ নয়।
শেখ হাসিনা সরকারের গত ৫ আগস্টের নিন্দনীয় কর্মকাণ্ড আন্তর্জাতিক আইনের দৃষ্টিকোণ থেকে এটিকে 'মানবতাবিরোধী অপরাধ' (Crimes Against Humanity) এর অধীনে ফেলা যায়, 'গণহত্যা' (Genocide) বা ‘ফ্যাসিবাদী শাসন’ হিসাবে চিহ্নিত করা যায় না । কারণ এখানে কোনো নির্দিষ্ট জাতি বা ধর্মের উদ্দেশ্যমূলক ধ্বংস ছিল না। শেখ হাসিনার শাসন ব্যবস্থায় স্বৈরাচারী উপাদান থাকলেও এটি ঐতিহাসিক ফ্যাসিবাদের সঙ্গে সরাসরি তুলনীয় নয়। এখানে জাতিগত শ্রেষ্ঠত্ব, পূর্ণাঙ্গ ফ্যাসিস্ট পার্টি-মিলিশিয়া কাঠামো বা গণহত্যার মতো ব্যাপার নেই। বরং এটি আধুনিক, স্বৈরাচারী শাসনের একটি রূপ যা বিরোধী দল ও মতাদর্শের ওপর সীমাবদ্ধতা আরোপ করে, নির্বাচনী এবং সাংবিধানিক নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখে।
একজন নোবেল বিজয়ী হিসেবে ড. ইউনূসের মন্তব্য বিশ্বব্যাপী গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ করা হয়। তাই রাজনৈতিক শব্দের যথার্থ ব্যবহার এবং দায়িত্বশীলতা তার কাছ থেকে বিশেষ জরুরি। যদি তিনি ‘ফ্যাসিবাদ’ ও ‘স্বৈরতন্ত্র’ এর প্রকৃত পার্থক্য না বুঝেন, তবে আন্তর্জাতিক পরিভাষার ভুল প্রয়োগ করা থেকে বিরত থাকা উচিত । আবার যদি সচেতনভাবে অতিরঞ্জিত ভাষা ব্যবহার করে থাকেন, তবে তা তার একাডেমিক ও নৈতিক অবস্থানের সঙ্গে বৈপরীত্যপূর্ণ।
গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা ও নোবেল বিজয়ী হিসেবে ড. ইউনূসের উচিত ছিল রাজনৈতিক বিতর্কে সংযত ও সঠিক ভাষা ব্যবহার করে দেশের ঐক্য ও সংহতির পথ সুগম করা। উদাহরণস্বরূপ, তিনি বলতে পারতেন, “এটি একটি কর্তৃত্ববাদী শাসন ব্যবস্থা, যেখানে আইনের শাসন ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের চরম অবনতি হয়েছে।” এই বক্তব্য আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য, একাডেমিকভাবে সঠিক এবং বিভক্তিকরও নয়।
ড. ইউনূসের ‘ফ্যাসিবাদ’ মন্তব্য একটি গুরুতর সংকেত বহন করে তিনি হয় গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক পরিভাষার প্রকৃত অর্থ বোঝেন না, অথবা রাজনৈতিক সুবিধার জন্য অতিশয়োক্তিপূর্ণ ভাষা ব্যবহার করছেন। বাংলাদেশের মতো সংবেদনশীল রাজনৈতিক পরিবেশে এ ধরনের মন্তব্য পরিমিত, সঠিক ও গঠনমূলক হওয়া উচিত। শব্দের শক্তি অপরিসীম; তাই একজন বিশ্বমানের ব্যক্তিত্বকে তার প্রতিটি কথাতে দায়িত্বশীল হতে হবে, রাজনৈতিক মনোভাব থেকে নয়।
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই আগস্ট, ২০২৫ রাত ১১:৫৯

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



