
রাজবাড়ীর গোয়ালন্দে ইমাম মাহদি দাবিদার নুরা পাগলার লাশ পোড়ানোর ঘটনা বাংলাদেশের নেটিজেনদের মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে। এই নির্মম ঘটনাকে অন্তর্বর্তী সরকারের চরম ব্যর্থতা হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছে। ভারতীয় উপমহাদেশে স্বঘোষিত ইমাম মাহদিদের সংখ্যা নিতান্ত কম নয়, কিন্তু মৃত ব্যক্তির দেহ অগ্নিদাহ করার মতো জঘন্য কর্মকাণ্ড এই প্রথমবারের মতো ঘটেছে। তৌহিদি জনতার মুখোশ পরে কারা এই নোংরা কাজে লিপ্ত হয়েছে? কেনই বা নুরা পাগলার মৃতদেহ তাদের মনে এমন আতঙ্ক সৃষ্টি করেছিল যে অগ্নিদাহ ছাড়া আর কোন বিকল্প তাদের কাছে ছিল না?
আশির দশকের শেষ দিকে নুরা পাগলা নিজেকে ইমাম মাহদি দাবি করেন। নিজের বাড়িতে গড়ে তোলেন দরবার শরীফ। স্থানীয় অসন্তোষের কারণে ১৯৯৩ সালে মুচলেকা দিয়ে এলাকা ছাড়লেও আবার ফিরে এসে কার্যক্রম চালু করেন। ২৩ আগস্ট বার্ধক্যজনিত কারণে তার মৃত্যু হয়। মৃত্যুর আগে ভক্তদের কাছে ওসিয়ত রেখে যান: তাকে যাতে ভূমি থেকে ১২ ফুট উচ্চতায় দাফন করা হয়, কবরটি কাবা শরীফের মতো কালো রঙ করতে হবে, আর বোর্ডে লিখতে হবে "ইমাম মাহদির কবর।" ভক্তরা সেটাই করল। ফলে একটি "বাংলা লালসালু"র মতো কবর জেগে উঠল। প্রশাসন নীরব দর্শক হয়ে থাকল।
মৃত্যুর পর ভক্তদের প্রচারণা ছিল আরও রহস্যময়। দাবি করা হলো: ১২ দিন পরও নুরা পাগলার লাশ পচেনি, কোনো গন্ধ নেই, দাড়ি-চেহারা অক্ষত। এসব বয়ান ছড়িয়ে পড়ল সোশ্যাল মিডিয়ায়। ভক্তরা তাকে পীর-আওলিয়ার মর্যাদা দিল। অন্যদিকে "ইমান আকিদা কমিটি" যার অনেক নেতা জামাত-বিএনপি রাজনীতির সাথে যুক্ত, টানা দুই সপ্তাহ ধরে অভিযোগ করলেও প্রশাসন কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। অবশেষে ৫ সেপ্টেম্বর নুরার লাশ কবর থেকে তুলে আগুনে পোড়ানো হয়।
ভারতে প্রায়শই দেখা যায় যে বিভিন্ন নারী যারা নিজেদের আধ্যাত্মিক শক্তির অধিকারী দাবি করেন, তাদের ডাইনি উপাধি দিয়ে ভয়ের কারণে জ্যান্ত অবস্থায় পুড়িয়ে মারা হয়। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও নুরা পাগলার লাশ পোড়ানোর পেছনে অনুরূপ মানসিকতা কাজ করেছে বলে মনে হয়। ইমান আকিদা কমিটি কি নুরার লাশের রহস্যময় অবস্থা নিয়ে কোন ধরনের দ্বিধায় পড়েছিল? তারা কি ভক্তকূলের অলৌকিক দাবিগুলো দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিল? এই মানসিক দ্বিধাই হয়তো তাদের এমন চরম পদক্ষেপ নিতে উদ্বুদ্ধ করেছে। মৌলবাদী গোষ্ঠী হয়তো এই অলৌকিকতার বিশ্বাসকে ভাঙতে চেয়েছিল, যাতে নূরা পাগলার কবর একটি মাজারে পরিণত হতে না পার
শেখ হাসিনার পতনের পরে এটি স্পষ্ট ছিল যে আওয়ামী লীগ ও ভারত বাংলাদেশে মৌলবাদীদের উত্থানের বিষয়টি প্রচার করতে শুরু করবে। যদিও প্রফেসর ইউনুসের নেতৃত্বাধীন সরকারের উপস্থিতিতে এই প্রোপাগান্ডা খুব একটা কার্যকর হবে না বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হয়েছিল। কিন্তু একের পর এক মাজার ভাঙা, নারীদের ফুটবল খেলায় বাধা সৃষ্টি এবং এখন নুরা পাগলার লাশ পোড়ানোর মতো ঘটনার কারণে সরকারের কঠোর পদক্ষেপের অভাব স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। ফলে "মৌলবাদীদের কবলে বাংলাদেশ" এই ন্যারেটিভ আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ক্রমাগত শক্তিশালী হচ্ছে।
শেখ হাসিনাকে দীর্ঘ সময় ক্ষমতায় রাখার পেছনে একটি প্রধান যুক্তি ছিল মৌলবাদ ও জঙ্গিবাদের উত্থান প্রতিরোধ করা এবং বাংলাদেশকে স্থিতিশীল রাখা। তিনি রাষ্ট্রযন্ত্রের মাধ্যমে এসব দমন করে রেখেছিলেন, কিন্তু পাশাপাশি শিক্ষাব্যবস্থা ধ্বংস করে দিয়েছিলেন। যতদিন তিনি ক্ষমতায় ছিলেন ততদিন এসব নিয়ন্ত্রণে থাকলেও, তার চলে যাওয়ার পর যাতে এসব সমস্যা বৃদ্ধি পায় তার সমস্ত বন্দোবস্ত তিনি করে গিয়েছেন। এটি একটি সুদূরপ্রসারী কৌশল যা এখন কার্যকর হতে দেখা যাচ্ছে।
প্রতিটি উগ্রপন্থী ঘটনায় কারো প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ইন্ধন রয়েছে কিনা তা গভীরভাবে অনুসন্ধান করা প্রয়োজন। প্রতিটি ঘটনায় অতি উৎসাহী কিছু ব্যক্তি নেতৃত্ব দিয়ে এমন সব কাজ করছে যা অন্তর্বর্তী সরকারের সুনাম নষ্ট করে। নুরা পাগলার লাশ পোড়ানোর ঘটনা কেবল একটি নৃশংস হত্যাকাণ্ড নয়, বরং একটি সুপরিকল্পিত রাজনৈতিক চাল। এই ঘটনার মাধ্যমে একটি পক্ষ অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ব্যর্থতাকে তুলে ধরতে চাইছে, আবার অন্য একটি পক্ষ মৌলবাদের উত্থান দেখিয়ে রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের চেষ্টা করছে।
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই সেপ্টেম্বর, ২০২৫ সন্ধ্যা ৭:১৭

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



