somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বিবিসি বাংলার প্রতিবেদন : শেখ হাসিনাকে ভারত ধীরে ধীরে ‘আনলক’ করতে দিচ্ছে ?

০৫ ই নভেম্বর, ২০২৫ রাত ১১:০৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


প্রায় নয় মাস আগের ঘটনা। ঢাকার ধানমন্ডির ৩২ নম্বর ঠিকানায় অবস্থিত শেখ মুজিবের বাসভবনে ভাঙচুরের পর, বাংলাদেশ সরকার সরাসরি ভারতকেই অভিযোগের কাঠগড়ায় তোলে। তাদের দাবি ছিল, ভারতে অবস্থানরত বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সোশ্যাল মিডিয়ায় লাগাতার মিথ্যা ও উসকানিমূলক বক্তব্য দিয়ে দেশের পরিস্থিতি অস্থিতিশীল করে তোলার চেষ্টা করছেন। এই বিষয়ে ভারত যেন অবিলম্বে তার মুখে রাশ টেনে ধরে, এই মর্মে ঢাকায় নিযুক্ত ভারতীয় রাষ্ট্রদূতকে তলব করে আনুষ্ঠানিক প্রতিবাদ ও জানানো হয়।

পরদিনই আসে ভারতের কড়া প্রতিক্রিয়া। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় পাল্টা বিবৃতি দিয়ে দাবি করে, শেখ হাসিনা যা বলছেন, তা তিনি ‘ব্যক্তি শেখ হাসিনা হিসেবে’ বা তাঁর ‘ইন্ডিভিজুয়াল ক্যাপাসিটি’তে বলছেন এবং এর সঙ্গে ভারত সরকারের কোনো সম্পর্ক বা ভূমিকা নেই। একই সঙ্গে, বাংলাদেশকে স্পষ্ট মনে করিয়ে দেওয়া হয় যে, ভারতকে ‘নেতিবাচক’ দৃষ্টিতে তুলে ধরলে বা বাংলাদেশের ‘অভ্যন্তরীণ প্রশাসনিক ব্যর্থতা’র জন্য ভারতকে দায়ী করলে তা দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের জন্য সহায়ক হবে না। এর পাল্টায় দিল্লিতে বাংলাদেশের ভারপ্রাপ্ত হাই কমিশনারকেও তলব করা হয়।

এই পুরো ঘটনাটিই জন্ম দিয়েছিল এক নজিরবিহীন কূটনৈতিক তিক্ততা। গত সোয়া বছর ধরে ভারতে আশ্রয় ও আতিথেয়তায় থাকা সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে প্রকাশ্যে কথা বলতে দেওয়া উচিত কি না, তা নিয়েই তৈরি হয় এই মতবিরোধ। এমনকি বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির মধ্যে আলোচনাও হয়েছিল। বাংলাদেশের প্রধান যুক্তি ছিল, জুলাই গণহত্যায় অভিযুক্ত সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে ভারত আশ্রয় দিতে পারে, কিন্তু দু’দেশের বিদ্যমান প্রত্যর্পণ চুক্তি অনুসারে ঢাকা যখন তাঁকে বিচারের মুখোমুখি করার জন্য হস্তান্তরের দাবি জানাচ্ছে, তখন সেই নিষ্পত্তির আগেই যদি তিনি ভারতে বসে প্রকাশ্যে মুখ খোলেন এবং দলীয় নেতা-কর্মীদের উসকানি দিয়ে দেশে অস্থিরতা সৃষ্টি করেন, তবে তা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।

কিন্তু ততদিনে বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী অনলাইনে আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের উদ্দেশে নিয়মিত ভাষণ দিতে শুরু করে দিয়েছেন—কখনও রেকর্ড করা, কখনও আবার ‘লাইভ’। গত এপ্রিলে ব্যাংককে বিমস্টেক শীর্ষ সম্মেলনের অবকাশে মুহাম্মদ ইউনূস যখন তাঁর এই যুক্তি নরেন্দ্র মোদির কাছে তুলে ধরেন, তখন ভারতের প্রধানমন্ত্রী স্পষ্ট জানিয়ে দেন: আজকের এই সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে কারও মুখে লাগাম পরানো সম্ভব নয় এবং শেখ হাসিনার ক্ষেত্রেও ঠিক সেটাই ঘটছে। ভারত মনে করে, বিশেষ পরিস্থিতি ও সুরক্ষার প্রয়োজনে তাঁকে আশ্রয় দেওয়া হলেও তিনি কোনো রাজনৈতিক বন্দী নন, যার ফলে তাঁর ইন্টারনেট, ফোন, খবর বা টিভিতে প্রবেশে কোনো বিধিনিষেধ প্রযোজ্য হবে না।

এই পাল্টাপাল্টি যুক্তির মধ্যেই সম্প্রতি (গত ২৯ অক্টোবর) বিশ্বের তিনটি আন্তর্জাতিক মিডিয়া আউটলেটে (রয়টার্স, এএফপি ও দ্য ইন্ডিপেন্ডেন্ট) একযোগে শেখ হাসিনার তিনটি আলাদা সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়। যদিও সেই সাক্ষাৎকারগুলো লিখিত প্রশ্নোত্তরের ভিত্তিতে করা, তবুও দিল্লিতে পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন, তাঁর ‘হোস্ট’ ভারত সরকারের সম্মতিতেই এটি হয়েছে। এর মাস তিনেক আগে আওয়ামী লীগের পলাতক নেতাদের বেশ কয়েকজনের সঙ্গে শেখ হাসিনার সশরীরে সাক্ষাৎ পর্যন্ত হয়েছে এবং এটাও ভারত সরকারের অনুমোদন ছাড়া সম্ভব ছিল না। এই ঘটনাক্রম দেখে বিশ্লেষকরা ধারণা করছেন, তাঁর ওপর শুরুতে আরোপিত কঠোর বিধিনিষেধগুলোর অনেকগুলোই ধীরে ধীরে শিথিল করা হচ্ছে যাকে তাঁরা ‘আনলকিং’ প্রক্রিয়া হিসেবে বর্ণনা করছেন।

কিন্তু কেন এই ‘আনলকিং’? এর প্রধান উদ্দেশ্য হলো আওয়ামী লীগকে বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে প্রাসঙ্গিক রাখা। মনোহর পারিক্কর ইনস্টিটিউট ফর ডিফেন্স স্টাডিজ অ্যান্ড অ্যানালিসিসের সিনিয়র ফেলো স্ম্রুতি পট্টনায়ক মনে করেন, বাংলাদেশে ঐকমত্য কমিশন সংস্কার, জুলাই সনদ সই : এমন একের পর এক গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ডেভেলপমেন্ট ঘটে চলেছে, যেখানে আওয়ামী লীগ কোনো স্পেস পাচ্ছে না। ভারত এই বৃহৎ ও ঐতিহাসিকভাবে সুসম্পর্কযুক্ত রাজনৈতিক শক্তির অনুপস্থিতি বুঝতে পেরেই শেখ হাসিনাকে আরও বেশি করে কথা বলার সুযোগ দিচ্ছে, কারণ তিনিই এখনও আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের শেষ কথা ।

আবার অনেকে মনে করছেন, ভারত শেখ হাসিনাকে দিয়ে পাল্টা আক্রমণে’ যেতে চাইছে। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিশেষজ্ঞ বলদাস ঘোষাল মনে করেন, ভারত আনুষ্ঠানিকভাবে বা প্রকাশ্যে যা বলতে পারে না, তার অনেক কথাই শেখ হাসিনার মুখ দিয়ে বলানো হচ্ছে। বাংলাদেশে সাম্প্রতিক কিছু ঘটনা, যেমন পাকিস্তানের সামরিক জেনারেলদের ঘন ঘন সফর বা সেভেন সিস্টার্স নিয়ে উসকানিমূলক বক্তব্যকে দিল্লি ভারত-বিরোধী পদক্ষে বলে মনে করছে। তাই বাংলাদেশকে পাল্টা চাপে ফেলার এবং আওয়ামী লীগের হতোদ্যম নেতা-কর্মীদের চাঙ্গা করার প্রচেষ্টায় ভারতের নীতিনির্ধারকদের একটি অংশ সুকৌশলে শেখ হাসিনাকে কাজে লাগাচ্ছেন। এই সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে একদিকে যেমন টেস্টিং দ্য ওয়াটার হচ্ছে, তেমনি অন্যদিকে বার্তা দেওয়া হচ্ছে যে শেখ হাসিনা দলের হাল ধরেছেন এবং ভারত তাঁর পাশেই আছে।

লন্ডন-ভিত্তিক লেখক প্রিয়জিৎ দেবসরকার শেখ হাসিনার ভারতে অবস্থানের প্রথম দিনগুলোকার কঠোর গোপনীয়তাকে কোভিড লকডাউনের সঙ্গে তুলনা করেন। মহামারীর সময়ে যেমন হঠাৎ করে সব বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, তাঁর ক্ষেত্রেও ব্যাপারটা ছিল তেমনই—সুরক্ষার প্রয়োজনে কঠোর বিধিনিষেধ। কিন্তু লকডাউন যেমন অনন্তকাল চলতে পারে না, তেমনি তাঁর ক্ষেত্রেও বিধিনিষেধগুলো পর্যায়ক্রমে তুলে নিতেই হতো, আর এখন সেটাই হচ্ছে। তাঁর মতে, ভারত এখন এই বিশেষ অতিথির আনলকিং-এর প্রক্রিয়া শুরু করেছে। খুব শিগগিরই তাঁর আরও কিছু গণমাধ্যমে লিখিত সাক্ষাৎকার বেরোনোর আভাস পাওয়া গেছে এবং আগামী নির্বাচনের আগে যদি তাঁকে ভিডিও ক্যামেরার সামনে বসে সাক্ষাৎকার দিতে দেখা যায়, তাহলেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। তবে দিল্লিতে বসে তিনি প্রকাশ্য চলাফেরা, অবাধ গতিবিধি বা রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড কতটা করতে পারবেন, তা নির্ভর করবে আরও নানা ফ্যাক্টরের ওপর।


সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই নভেম্বর, ২০২৫ রাত ১১:০৮
১৭টি মন্তব্য ১৭টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ছি , অবৈধ দখলদার॥ আজকের প্রতিটি অন‍্যায়ের বিচার হবে একদিন।

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:১০



ধিক ‼️বর্তমান অবৈধভাবে দখলদার বর্তমান নরাধমদের। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশে । বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ক্ষমা চাইতে হলো ! রাজাকার তাজুলের অবৈধ আদালতে। এর চাইতে অবমাননা আর কিছুই হোতে পারেনা।... ...বাকিটুকু পড়ুন

আম্লিগকে স্থায়ীভাবে নিষিদ্ধে আর কোন বাধা নেই

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:২২


মঈন উদ্দিন ফখর উদ্দিনের ওয়ান-ইলেভেনে সরকারের ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে ভারতের সহায়তায় পাতানো নির্বাচনে হাসিনা ক্ষমতায় বসে। এরপরই পরিকল্পিত উপায়ে মাত্র দুই মাসের মধ্যে দেশপ্রেমিক সেনা অফিসারদের পর্যায়ক্রমে বিডিআরে পদায়ন... ...বাকিটুকু পড়ুন

মিশন: কাঁসার থালা–বাটি

লিখেছেন কলিমুদ্দি দফাদার, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৯:২৭

বড় ভাই–ভাবীর ম্যারেজ ডে। কিছু একটা উপহার দেওয়া দরকার। কিন্তু সমস্যা হলো—ভাই আমার পোশাক–আশাক বা লাইফস্টাইল নিয়ে খুবই উদাসীন। এসব কিনে দেওয়া মানে পুরো টাকা জ্বলে ঠালা! আগের দেওয়া অনেক... ...বাকিটুকু পড়ুন

আওয়ামী লীগের পাশাপাশি জামায়াতে ইসলামীকেও নিষিদ্ধ করা যেতে পারে ।

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১২:৪৫


বাংলাদেশে আসলে দুইটা পক্ষের লোকজনই মূলত রাজনীতিটা নিয়ন্ত্রণ করে। একটা হলো স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি এবং অন্যটি হলো স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি। এর মাঝে আধা পক্ষ-বিপক্ষ শক্তি হিসেবে একটা রাজনৈতিক দল... ...বাকিটুকু পড়ুন

J K and Our liberation war১৯৭১

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৯



জ্যাঁ ক্যুয়ে ছিলেন একজন ফরাসি মানবতাবাদী যিনি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্সের একটি বিমান হাইজ্যাক করেছিলেন। তিনি ৩ ডিসেম্বর, ১৯৭১ তারিখে প্যারিসের অরলি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×